জিতে কোথায় হারালেন বিজেপি’র ১৮?
-
চন্দন দাস
- Jul 04, 2020 11:54 [IST]
- Last Update: Jul 04, 2020 11:54 [IST]
এখন ঘোর দুর্দিন। বড় কষ্টে আছে
প্রায় সবাই। পরিযায়ী, যাঁরা পরিযায়ী নন—
সবাই বিপদে। কাজ নেই। মাঠে নেই। কারখানাতেও নেই। হাতে টাকা নেই। ঘরে চাল বাড়ন্ত।
বাজারে সবজির দামে আগুন। অটোর ভাড়া যেমন খুশি। বাসের ভাড়া ঠিক হয়নি। বাস চলছে না।
রাজ্য সরকার কিছুই করতে পারছে না। তারই মধ্যে দরদামে ডিজেল-পেট্রল যমজ ভাই—
ইতিহাসে প্রথম। বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা বন্ধ — কারণ অনলাইনে পড়াশোনা করার
সুযোগ নেই তাঁদের।
চারিদিকে এক অনাসৃষ্টি— মন্দা, বিপন্নতা।
এমন সময় ১৭ জন নিখোঁজ। বিলকুল
হাওয়া! ১জনকে বাদ দিতে হচ্ছে। কারণ তাঁকে দেখা যাচ্ছে। তৃণমূল কংগ্রেস তাঁর
প্রচারের দায়িত্ব নিয়েছে। মেদিনীপুরের সাংসদ সেই দিলীপ ঘোষকে মাঝেমাঝে বাংলার
চ্যানেলগুলির সৌজন্যে উত্তর কলকাতায় দলের কার্যালয়ে সাংবাদিক বৈঠক করতে দেখা
যাচ্ছে। তাঁর প্রচারের অভাব পড়লেই তৃণমূল কংগ্রেস তাঁর গাড়ি ভাঙছে। নাহলে রাস্তা আটকাচ্ছে।
দিলীপ ঘোষ ‘ফুটেজ খাচ্ছেন’ — সুযোগ পেয়ে।
কিন্তু বাকি ১৭ জন কোথায়? মাত্র এক বছর আগে বিজেপি’র ১৮ জনকে জিতিয়ে সংসদে পাঠিয়েছে
পশ্চিমবঙ্গ। তাঁরা এই দুর্দিনে নেই?
এ প্রশ্ন জরুরি। কারণ আমরা
শুনেছিলাম, কারণ আমাদের শোনানো হয়েছিল, কারণ রাজ্যবাসীর একাংশ শুনতে শুনতে তৃণমূল কংগ্রেসের নিপীড়ন
থেকে পরিত্রাণের স্বপ্নে বিভোর হয়েছিলেন, বিশ্বাস করে আনন্দিত হয়েছিলেন যে, ‘মমতাকে আটকাতে পারে একমাত্র বিজেপি।’ তৃণমূল কংগ্রেসীরা যে অসামাজিক ভাষায়
কথায় বলে,
তার পালটা একই ভাষা আরও জোরদারভাবে চাই — ন্যারেটিভ নিভৃতে
নামছিল সমাজের শিকড়ে। জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ওরফে বালুদা বলেছিলেন ‘সিপিএম সাপের
বাচ্চা।’ নাট্যকার ব্রাত্য বসু ‘অনুপ্রাণিত’ হয়ে বলেছিলেন,‘সিপিএম ডালকুত্তার দল।’ এই ভাষায় সিপিআই(এম) কথা বলতে পারবে
না। বিজেপি পারছে। তাই বিজেপি-কে চাই। এমনই মনোভাব সমাজে গড়ে তোলা হয়েছিল। অসুস্থ
মানসিকতার বিস্তার— ঠিকই। ফ্যাসিবাদের ভিজিটিং কার্ড— সন্দেহ নেই। কিন্তু বাস্তবতা
তাই হয়ে উঠেছিল।
বিজেপি ১৮টি লোকসভা আসনে জিতেছিল।
তৃণমূল কংগ্রেসের ২২টি আসনের পালটা বিজেপি’র ১৮টি আসন। তারপর মানুষের কিছু আশা, আকাঙ্ক্ষা থাকবেই। সবাই তো সেই ‘৭%’ নয়, যাঁরা জানতেন — তৃণমূল কংগ্রেস মারাত্মক। বিজেপি-ও
মারাত্মক। এই দুটোকেই হারাতে হবে। একসাথে।
এখন, এই জরাসন্ধ-সময়ে সেই অমূল্য ১৮কে রাজ্যের কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। আমফান
আছড়ে পড়ল। অনেক ক্ষয়ক্ষতি হলো। ৮৬জনের মৃত্যু হলো। কয়েক লক্ষ মানুষ ঘর হারালেন।
তারপরও জল গড়ালো মুড়িগঙ্গা, মৃদঙ্গভাঙা, তালপাটি দিয়ে। ত্রাণ জমা হলো তৃণমূল নেতাদের বাড়িতে, দলের অফিসে। ত্রিপল পেল তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মীরা। বাড়ির
ক্ষতিপূরণের টাকা ঢুকলো তৃণমূল কংগ্রেসের নেতাদের বানানো তালিকা অনুসারে। অনেক
গরিব অসহায় বাদ পড়লেন। বহুতলের মালিক পেল মাটির ঘর ভাঙার খরচ।
তাই রাজ্য জুড়ে বিক্ষোভ।
তবু কিন্তু সেই ১৮ জন সাংসদের দেখা
মিলল না। ত্রাণ নিয়ে, সহায়তা নিয়ে
বিজেপি’র সাংসদ, বিধায়করা ঝাঁপিয়ে পড়বেন, প্রতিবাদে তোলপাড় হবে রাজ্য, নবান্নের চোদ্দতলা থরহরি কম্প হবে, ব্লকে ব্লকে বিডিও, পঞ্চায়েত সমিতির
সভাপতি নামক তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মীদের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করবেন বিজেপি’র নেতা, সাংসদ, বিধায়করা— এই তো
আশা ছিল।
কিন্তু দেবশ্রী রায় আর বাবুল
সুপ্রিয়র মাঝে ইকুয়াল টু চিহ্ন ছাড়া রাজ্যবাসী আর কিছু পেল না। অভিষেক ব্যানার্জি
আর মনোজ টিগ্গা (অনেকে জানেন না, ইনি বিধানসভায়
বিজেপি’র দলনেতা) সমান হয়ে গেলেন করোনা-আমফানের প্রেক্ষাপটে। সবাই ভ্যানিশ।
বামপন্থী গণসংগঠনগুলির কর্মীরা
ত্রাণ নিয়ে পৌঁছালেন ভাঙা বাঁধের ধারে, ধসে পড়া বাড়ির কাছে কোনোক্রমে টিকে থাকা মানুষের কাছে। শুধু তাঁরাই নন।
বিভিন্ন সংগঠন, সংস্থাও নিজের সাধ্যমতো এগিয়ে এলেন
মানুষের পাশে। নবান্ন থেকে মমতা ব্যানার্জির নির্দেশ ছিল— কোনও সংগঠন ত্রাণ দিতে
পারবে না। সব সরকারের মাধ্যমে দিতে হবে। পুলিশ কয়েকটি জায়গায় বাধা দেওয়ার চেষ্টা
করেছিল। পরে তারা হাত পা গুটিয়ে থানায় বসে পড়ল। কারণ, তারাও বুঝলো আমফান বিধ্বস্ত মানুষের পাশে তাদের সরকারকে খুঁজে
পাওয়া যাচ্ছে না। এখন ত্রাণ দিতে বাধা দিলে অন্য ঝামেলায় পড়তে হতে পারে। মানুষ খুব
মারমুখী।
মমতা ব্যানার্জির নির্দেশ মানলো কে? শুধু বিজেপি। তাদের কোথাও ত্রাণ হাতে চোখে পড়ল না।
করোনাতেও একই ঘটনাপ্রবাহ।
পরিযায়ীদের ট্রেন নিয়ে বিজেপি-তৃণমূলের বিতণ্ডা দেখলাম আমরা। আর পরিযায়ীরা ফিরলেন
চরম অব্যবস্থায়। ফিরেও হেনস্তা জুটলো। সঙ্গে কাজ না থাকার নৈরাশ্য। পথে মৃত্যু হলো
কয়েকজনের। পরিযায়ীরা ভিন রাজ্য থেকে নবান্নের কন্ট্রোল রুমে ফোন করে করে হয়রান
হলেন। তৃণমূল কংগ্রেসের নেতাদের ফোন করে ঠোক্কর খেলেন। কিন্তু তাঁদের ভিন রাজ্যে
খাদ্যের ব্যবস্থা অথবা অন্য যোগাযোগের ক্ষেত্রে সাহায্য করলেন বামপন্থীরা।
বিজেপি’র কোনও সাংসদ, বিধায়ক, নেতাকে পাওয়া গেল না তাঁদের জন্য। করোনার সময় গরিব মানুষ
যখন সঙ্কটে খাবার দিতে দেখা গেল সেই বামপন্থীদের। রাজ্যে আটশোর বেশি কমিউনিটি
কিচেনের উদ্যোক্তা সেই বামপন্থীরা। লক্ষ লক্ষ মানুষ সাহায্য পেলেন। বিশেষত শ্রমিক, খেতমজুর, অসংগঠিত শ্রমিকরা।
দুটি পক্ষ মানুষের থেকে বহুদূরে
থেকে ঝগড়ার অভিনয় করে গেল— তৃণমূল কংগ্রেস আর বিজেপি।
এই ক্ষেত্রে এসএফআই-কে দেখুন।
আমাদের শেখানো হচ্ছিল ওরা বিশ্ববিদ্যালয়ে হল্লা করে। ওরা ‘আজাদি’ দাবি করে। বিজেপি
বলল দেশদ্রোহী। তৃণমূল কংগ্রেস চুপ। সেই ‘দেশদ্রোহী’ পুঁচকের দল করোনার আবহে
গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হাজির করল— অনলাইনে পড়াশোনা করার সাধ্য নেই রাজ্যের বেশিরভাগ
পরিবারের ছাত্রছাত্রীদের। ল্যাপটপ, ডেস্কটপ তো দূরের কথা, অনেকের বাড়িতে
কারো কাছেই অনলাইনের ক্লাসের উপযোগী ফোন নেই। ফলে এই পদ্ধতিতে পড়াশোনা সবাইকে
বিচার্য মাধ্যম হতে পারে না। এই কারণে অবসাদে এক ছাত্রী আত্মঘাতীও হয়েছেন।
বিজেপি’র এই নিয়ে কোনও কথা নেই। আর বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা এই দাবিতে
আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গেই হাসনাবাদ থেকে নামখানায় ছুটছেন। বই খাতা থেকে ত্রিপল, চাল— যতটুকু পারছেন নিয়ে যাচ্ছে। দেশ মানে মানুষ, দেশপ্রেম মানে তাঁদের সঙ্গে থাকা— ওরা দেখিয়ে দিচ্ছেন।
সূর্য সেন অথবা চে’র ছবি আঁকা টি শার্ট পরে ওরা। সেই টি শার্টের নিচে, বুকের গভীরতম উত্তাপে আগলে রাখে জ্যোতি বসুকে।
আপনারা কোথায় হে মোদী-বাহিনী? কোথায় ভাইপো-পিকে টিম?
তাদের দেখা গেল ফের পাশাপাশি, কয়লা খনিতে।
গত ১৮জুন দেশের ৪১টি কয়লা ক্ষেত্রের
নিলামের দিন ছিল। মমতা ব্যানার্জি চুপ ছইলেন। তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদরা বোবা। কয়লা
ব্লক নিলামে চড়িয়েছেন মোদীর সরকার। ‘আত্মনির্ভর ভারত’ গঠনের নমুনা। তবে সেদিনই
ধর্মঘটের নোটিস ধরিয়েছিলেন শ্রমিকরা। জাতীয় সম্পদ কয়লাকে দেশি বিদেশি কর্পোরেটদের
হাতে তুলে দিতে দেবেন না শ্রমিকরা— এই হলো প্রত্যয়। ২ জুলাই থেকে ৪ জুলাই— টানা
তিন দিন ধর্মঘটের ডাক। ঐক্যবদ্ধ শ্রমিকরা। প্রতিটি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে
শামিল হতে বাধ্য হলো আরএসএস’র বিএমএস’ও!
নেই কে? মমতা ব্যানার্জিতে অনুপ্রাণিত তৃণমূল কংগ্রেসের শ্রমিক
সংগঠন। তৃণমূল কংগ্রেস সেই ধর্মঘটে যোগ দেয়নি। তাই শুধু নয়, তারা পশ্চিমবঙ্গে ধর্মঘট ভাঙার চেষ্টা করেছে।
‘মমতাকে ছাড়া বিজেপি বিরোধী লড়াই হয়
না’— এমন নিদারুণ ভাবনায় মথিত কিছু মানুষ এখনো এরাজ্যে বাস করেন। কিন্তু বিজেপি’র
এই প্রশ্নে এমন কোনও শিশুসুলভ বোঝাপড়া নেই। কাশ্মীরের বিশেষ অধিকার খর্ব করার
ইস্যুতে মাননীয়া চুপ করে থাকেন। কাশ্মীরের দুটি অঙ্গরাজ্যে অবনমিত হওয়ার সময় মমতা
ব্যানার্জির অস্ত্র সেই নীরবতা। লাদাখে সংঘর্ষের বিষয়ে দেশের অখণ্ডতার প্রশ্নে
দৃঢ় অবস্থান জানিয়েও যখন সিপিআই(এম) সহ অনেকে জানতে চাইছে ঠিক কী ঘটেছিল সেখানে, কেন প্রধানমন্ত্রী বললেন কেউ ঢোকেইনি ভারত ভূখণ্ডে— তখন
মমতা ব্যানার্জির কোনও প্রশ্ন নেই। তৃণমূল কংগ্রেস কী বলল? তারা বলল, জাতীয় স্বার্থে
তারা সবসময় দেশের পাশে আছে।
কে নেই? কিন্তু ‘জাতীয় স্বার্থ’ মানে কী? কয়লা খনির বেসরকারিকরণ জাতীয় স্বার্থ? তৃণমূল কংগ্রেস কয়লা শ্রমিকদের ধর্মঘট ভাঙতে গেল কেন? কেন বিরোধিতা করল দেশজোড়া ঐক্যবদ্ধ শ্রমিকদের ধর্মঘটের?
এই প্রথম নয়। বিজেপি’র কোনও
ছলচাতুরির বিরুদ্ধে মমতা ব্যানার্জি প্রশ্ন করেননি। বরং পাশে থেকেছেন। অনেক
উদাহরণ। একটাই থাক আপাতত।
কী হয়েছিল ২০০০-র ৬ জুলাই?
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী
বাজপেয়ী কালীঘাটে মমতা ব্যানার্জির বাড়ইতে মালপোয়া খেয়েছিলেন। তার আগে
শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানে, নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে বাজপেয়ীর উপস্থিতিতে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী বলেছিলেন,‘‘শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিও ‘অটল’ ছিলেন। আর অটলজীও ‘অটল’। তাই
তাঁদের মধ্যে এত মিল।’’ সেদিনই নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠানের আগে রাজভবনে
এক প্রতিনিধি দলকে মাত্র পাঁচ মিনিট সময় দিয়েছিলেন বাজপেয়ী। সেই প্রতিনিধি দলে
ছিলেন রাজ্যসভার তৎকালীন সাংসদ, কমরেড দীপঙ্কর
মুখার্জি। আর ছিলেন সেই চারটি কারখানার শ্রমিকরা, যেগুলি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তার আগে, ২৩ জুন বি জে পি-জোট সরকারের মন্ত্রীসভা দেশের অনেকগুলি
রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বেসরকারিকরণ, বিলগ্নিকরণের
সিদ্ধান্ত নেয়। দেশের কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বন্ধের সিদ্ধান্তও সেদিন নিয়েছিল
কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা। মমতা ব্যানার্জি ছিলেন সেই সিদ্ধান্তের শরিক। যে
কারখানাগুলি বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তার মধ্যে চারটি ছিল পশ্চিমবঙ্গে। সেগুলি হলো — ভারত প্রসেস, এমএএমসি, ওয়েবার্ড ইন্ডিয়া
এবং আরআইসি। সেই সিদ্ধান্ত ঘোষিতও হয়েছিল। বিজেপি’র জোটসঙ্গী ছিলেন রাজ্যের সংস্থা
বন্ধের সিদ্ধান্তে সহমত ছিলেন মমতা ব্যানার্জি।
সেদিন বামপন্থীদের নেতৃত্বে
শ্রমিকদের প্রতিনিধিরা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নিকরণের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর
কাছে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। আর ‘শ্যামাপ্রসাদের মতো অটলজী’-কে মালপোয়া খাইয়েছিলেন
মমতা ব্যানার্জি।
১৮জন বিজেপি সাংসদ
নিখোঁজই থাকবেন রাজ্যের বিপন্নতায়। কেন্দ্রের মোদী সরকারের ‘পঙ্গু ভারত’ গড়ার
পদক্ষেপেও মমতা ব্যানার্জি নীরবই থাকবেন। এই সব বোঝাপড়ার কথা ভোলা অন্যায় হবে।
বেইমানি করা হবে— রাজ্যের সঙ্গে, মানুষের সঙ্গে।