মানুষকে সঙ্গে নিয়ে লড়াই
-
বিমান বসু
- Oct 17, 2020 19:49 [IST]
- Last Update: Oct 17, 2020 19:49 [IST]
১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর রুশ দেশের তাসখন্দে কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম হয়। প্রবাসে ভারতের কমিউনিস্টি পার্টির গড়ে ওঠার পরে বিভিন্ন সময়ে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের আলোচনা অনুযায়ী ভারতের বুকে পার্টি গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়। কখনও কখনও তাসখন্দে পার্টি গড়ে তোলার জন্মলগ্নে যুক্ত থাকা এমএন রায়ের পাঠানো বক্তব্য হ্যান্ডবিল আকারে প্রকাশ হত এবং জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে তা বিলি করা হত। এই ইতিহাসের বর্ণনা দেওয়া আমার লেখার উদ্দেশ্য নয়।
কোন দেশে কমিউনিস্ট পার্টি তার নীতি, আদর্শের কথা জনগণের কাছে তুলে ধরে আন্দোলন সংগ্রামে যুক্ত না হলে যথার্থ অর্থে কমিউনিস্ট পার্টি হিসাবে গড়ে ওঠা সম্ভব না। পার্টির গড়ে তোলার পথিকৃৎরা স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে জাতীয় কংগ্রেসের পতাকাতলে থেকেও এই কর্মধারা পরিচালনা করেছেন। সুষ্ঠুভাবে আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনার স্বার্থেই ১৯২০ সালে শ্রমিক সংগঠন এআইটিইউসি গড়ে ওঠে, ১৯৩৫ সালে কৃষকদের সংগঠিত করতে সারা ভারত কৃষকসভা গঠিত হয় এবং ১৯৩৬ সালে ছাত্র সমাজকে সংগঠিত করতে এআইএসএফ গড়ে তোলা হয়। পরাধীন ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুগপৎ শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র আন্দোলন গতি পেতে থাকে। একই সঙ্গে জনগণের মধ্যে সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের প্রসার ঘটাতে এবং তা আন্দোলন সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে গড়ে উঠেছিল আইপিটিএ।
আন্দোলন পরিচালনার জন্য বিভিন্ন গণ-ফ্রন্টের বর্ণনা আমি উল্লেখ না করে আন্দোলন সংগ্রামের প্রভাব জনগণের জীবনে যে আলোড়ন তৈরি করেছিল তার সাধারণ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমার নিজের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাকে ঝালিয়ে নিতে চাই।
এক হিসাবে ১৯৪৬ সাল একটি স্মরণীয় বছর। এই বছরে ২৯ জুলাই সারা ভারতে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের ধর্মঘট এবং মুম্বাই বন্দরে নৌ-বিদ্রোহ ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। যেমন প্রভাব সৃষ্টি করেছিল মজুতদার মুনাফাখোর সুদখোরদের দ্বারা অমানবিক কৃত্রিম খাদ্য সঙ্কট তৈরি করে ১৯৪৩ সালে যা ইতিহাসের পাতায় ‘গ্রেট ফ্যামিন’ নামে পরিচিত। এই দূর্ভিক্ষে ৩০ লক্ষ মানুষের জীবনহানি ঘটেছিল। কমিউনিস্টদের উদ্যোগে অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন জেলায় ‘লঙ্গরখানা’ খোলা হয়েছিল। এই সময় মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির জন্ম হয়েছিল এবং গৌরবের সঙ্গে ত্রান কার্য পরিচালনা করেছিল। সব দিক থেকে ত্রাণকার্যে কমিউনিস্টরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আবার কৃষক সংগ্রাম নতুন গতিবেগ লাভ করেছিল ইতিহাসখ্যাত তেভাগা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন কমিউনিস্টরাই যারা কৃষক আন্দোলন পরিচালনা করতেন সেই সময়ে। এসব তো পরাধীন ভারতে কমিউনিস্টদের কথা।
কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠার একশো বছরে দাঁড়িয়ে আমার মনে হয় ১৯৫৩ সালে ব্রিটিশ মালিকানাধীন ট্রাম ওয়েজ কোম্পানির বিরুদ্ধে এক পয়সা ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে যে আন্দোলন কলকাতা শহরে গড়ে উঠেছিল এবং তা ধীরে ধীরে সারা রাজ্যে প্রসারিত হওয়ার যে ঘটনা, তার প্রভাব অনেক দীর্ঘ। ট্রামে ভাড়া বৃদ্ধির কোন প্রয়োজন না হলেও স্রেফ অতিরিক্ত মুনাফার লক্ষ্যে তা ব্রিটিশ কোম্পানি করতে চেয়েছিল। এনিয়ে আলোচনা জুন মাসের বিভিন্ন সময়ে তৎকালীন রাজ্য সরকারের সঙ্গে বিস্তারিতভাবে হওয়ার পরেও সরকার রাজী হয়েছিলেন ভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাবে। ঐ বছরের ২৫জুন ট্রাম কোম্পানি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত জানায়। ঘটনাচক্রে, চালু করার দিন নির্দিষ্ট হয়েছিল মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের জন্মদিন ১ জুলাই থেকে। ঐ সময়ে ট্রামের দ্বিতীয় শ্রেণিতে ছাত্র ও সাধারণ মধ্যবিত্ত কর্মচারী, মানুষজনই যাতায়াত করতেন। যেহেতু বেশ কিছুদিন ধরে আলোচনা হয়েছে এবং তা স্বাধীনতা পত্রিকা সহ অন্যান্য সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়, কমিউনিস্টদেরও আন্দোলন সংগ্রামের কর্মসূচি সাজাতে সহজ হয়।
কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতি বসু বিধানসভায় তথ্য দিয়েই দেখিয়েছিলেন ট্রাম কোম্পানি মুনাফা করছে, তাদের আয়ের কোন ক্ষতি হচ্ছে না। স্বাধীন দেশে অতীতের ব্রিটিশ শাসকের অধীনস্থ কোম্পানি অতিরিক্ত মুনাফা লোটার জন্য ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্তকে কলকাতার সাধারণ নাগরিক, বুদ্ধিজীবীরা মেনে নিতে পারেননি বলেই আন্দোলনে গতিবেগ সঞ্চারিত হয়েছিল। বিধান রায়ের পুলিশ আন্দোলনকারীদের দমাতে লাঠি, টিয়ার গ্যাস, এমনকি গুলি চালাতেও কুন্ঠাবোধ করেনি। আমার নিজের একটা অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ করতে চাই। ঐ বছর জুলাই মাসের কোন একটা দিনে আমি দুই বন্ধুর সঙ্গে কলেজস্ট্রিট পাড়ায় বই কিনে ফেরার সময় হেঁটে হেঁটে শ্রদ্ধানন্দ পার্কের সামনে দাঁড়িয়ে বাদাম খাচ্ছিলাম। আমাদের তিনজনেরই হাফ প্যান্ট পরা ছিল। হঠাৎ এক হাফ প্যান্ট পরা খাঁকি পোশাকের পুলিশ অতর্কিতে আমার পেটে লাঠির গুঁতো দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠেছিল, ‘ক্যায়া করতা হ্যায়’! সত্যিকারের তখন কোথায় কী ঘটেছে আমরা তিন বন্ধুই কেউ জানিনা। যদিও পরে সব জেনেছি এবং খবরের কাগজে পড়েছি।
জ্যোতি বসু ট্রাম কোম্পানির প্রতিনিধিকে আহ্বান জানান, সেকেন্ড ক্লাসে পুরাতন ভাড়ায় ফিরে যাওয়ার জন্য। ট্রাম কোম্পানি কোনো আশ্বাস দিতে পারেনি, তবে বিবেচনা করবে বলে ঘোষণা করে। দাবি মেনে না নিলে জ্যোতি বসুও ট্রাম-বয়কট চালিয়ে যাবার কথা ঘোষণা করেন।
সেদিন বিকালেই সদ্য জামিনে মুক্তি পাওয়া জ্যোতি বসু এবং প্রতিরোধ কমিটির কয়েকজন নেতা কর্মীকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। অবস্থার অবনতি দেখে মেঘনাদ সাহা, হীরেন মুখার্জির মতো পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতিমান ব্যক্তিরা প্রধানমন্ত্রী নেহরুকে সমাধানে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানান।
৫জুলাই আসানসোলে ইন্ডিয়ান স্টিল কোম্পানির বিক্ষোভরত শ্রমিকদের ওপরে গুলি চালায় পুলিশ। এতে পাঁচজন নিহত হয় এবং অনেকেই আহত হয়। ট্রামের ভাড়া বৃদ্ধির আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে ওঠা কলকাতা নগরীতে আসানসোলের ঘটনা পৌঁছাবার সাথে সাথে তা ভিন্নরূপ ধারণ করে। ফুঁসে ওঠে পুরো কলকাতার শ্রমিক শ্রেণি। ক্ষোভের স্ফূলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে দিগ্বিদিক।
শ্রমিক ও মধ্যবিত্তদের নানান স্তরের মানুষ আন্দোলনে যোগ দেয়। জুলাইয়ের ১৫ তারিখে সম্মিলিত হরতালের ডাক দেয়। হরতাল ঠেকাতে সর্বাত্মক চেষ্টা করে সরকার। তবুও হরতাল সফল হয়। পুলিশের হামলা চলে। বিদ্যাসাগর কলেজের একজন ল্যাব অ্যাসিসন্টান্টও মারা যান পুলিশের গুলিতে। আঠার বছর বয়সের এক ছাত্রও মারা যায়। এরপরেই ১৬ তারিখে জারি করা হয় ১৪৪ ধারা।
আমার বিচারে এবং খানিকটা অভিজ্ঞতায়, ট্রামের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে যুক্ত গণআন্দোলন স্বাধীন ভারতে আন্দোলনের ইতিহাসে একটা মাইলফলক। আন্দোলন সংগ্রামের চাপেই ব্রিটিশ মালিকানাধীন ট্রাম কোম্পানি ভাড়া বৃদ্ধি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। এই পরিবেশে ১৯৫৪ সালে খাদ্য সঙ্কট দেখা দিলে তার বিরুদ্ধে খাদ্য আন্দোলন গড়ে তুলতে যেমন সাহায্য করেছিল, ঠিক তেমন ১৯৫৬ সালে বাংলা-বিহার সংযুক্তি বিরোধী আন্দোলনে গতিবেগ সৃষ্টি করতেও সহায়তা করেছিল। তারপরে ১৯৫৮ সালে খাদ্য আন্দোলন এবং ছাত্রদের কলেজে বেতন বৃদ্ধির প্রতিবাদে আন্দোলনে গতিবেগ সঞ্চার করে। সাতটি বড় কলেজে দু’টাকা করে যে বেতন বেড়েছিল তা কলেজ কর্তৃপক্ষ প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। এই আন্দোলন সংগ্রামের পৃষ্ঠভূমিতে দাঁড়িয়েই ১৯৫৯ সালের রাজ্যব্যাপী জেলায় জেলায় তিন মাস ধরে ব্যাপক প্রচার ও দাবিপত্র পেশের কর্মসূচি শেষে কলকাতায় ৩১ আগস্টের ঐতিহাসিক খাদ্য আন্দোলন। যা আজও আলোচিত হয়ে থাকে।
শতবর্ষে কমিউনস্ট পার্টি আসলে লড়াই সংগ্রামের দীর্ঘ, আপসহীন পথ চলারই উপাখ্যান। সব বর্ণনা এই ছোট্ট লেখায় তুলে ধরা সম্ভব নয়।
সেই লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই, আন্দোলন সংগ্রামের বিকাশের ধারাতেই ১৯৬৭ সালে এবং ৬৯ সালে দুটো অকংগ্রেসী যুক্তফ্রন্ট সরকার গড়ে ওঠে। একটি সরকারের ৯ মাস ও আরেকটির ১৩ মাসে পতন হয়। উল্লেখ্য, এর দশ বছর আগেই ১৯৫৭ সালে ভারতের ইতিহাসে প্রথম কেরালায় ইএমএস নাম্বুদিরিপাদের নেতৃত্বে কমিউনিস্টদের পরিচালিত সরকার তৈরি হয় যা কেন্দ্রীয় সরকারের চক্রান্তের শিকারও হয় এবং পতন ঘটে।
আন্দোলন সংগ্রামের ধারাতেই ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার তৈরি হয়। বামফ্রন্ট সরকার গঠনও নিশ্চিতভাবে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। পশ্চিমবঙ্গ,কেরালা, ত্রিপুরায় বিকল্পের দিশা দেখিয়েছে বামপন্থী সরকার। গণতন্ত্রের প্রসার ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। ভুমি সংস্কার, জমি বন্টন গ্রামাঞ্চলের ক্ষমতার বিন্যাস বদলে দেয়। গরিব মানুষ মাথা তুলে দাঁড়ায়। পঞ্চায়েত ব্যবস্থা গোটা দেশেই মডেল হয়ে উঠেছিল। জনহিতকর কর্মসূচীর পাশাপাশি রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতার দাবিতেও আন্দোলন চলে, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক পুনর্বিন্যাসের দাবি তোলে সরকার। রাজ্য তালিকাভুক্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে নজির সৃষ্টিকারি সাফল্য অর্জিত হয়। যেমন কৃষিক্ষেত্রে, ক্ষুদ্র কুটির শিল্প যেখানে বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ জড়িয়ে আছে। আবার শিক্ষা যুগ্ম তালিকা হলেও বামফ্রন্ট সরকারের সময় তার ব্যাপকতম প্রসার, গরিবতম পরিবারের সন্তানদেরও শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসা, গ্রামে গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় গঠনের শপথ নিয়ে শুরু হয়েছিল পথ চলা। গরিব আদিবাসী, তফসিলী, মুসলিম সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েদেরও শিক্ষার আঙিনায় যুক্ত করা ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
একশো বছর দীর্ঘ পথ। পরাধীন ভারতে কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। আট বছর পরে সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হয়। জন্মলগ্ন থেকেই নানান উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলন, নানান ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেই এগিয়েছে সেই লড়াই। এক গৌরবজনক মুহুর্তে আমাদের সকলের সামনে। দীর্ঘ ঐতিহ্যকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের পথ চলা।
আমাদের এক মুহুর্তের জন্য ভূলে গেলে চলবে না করোনা কালে আন্দোলন সংগ্রামের গতি রুদ্ধ করতে কেন্দ্রে বিজেপি সরকার এবং রাজ্যে তৃণমূল সরকার নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলেও কমিউনিস্ট, সব ধরনের বামপন্থী ও সহযোগী দলসমূহের সঙ্গে জাতীয় কংগ্রেসেরও ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন সংগ্রামের ময়দানে শামিল হওয়া প্রয়োজন। অবশ্যই যারা বিজেপি ও তৃণমূল বিরোধী রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত তাঁদেরও ভাবতে হবে দেশের পক্ষে বিজেপি ও রাজ্যের পক্ষে তৃণমূল কংগ্রেস এক বড় বিপদ।
বর্তমান উদ্ভূত পরস্থিতি পরিবর্তনের জন্য আসুন সকলে মিলিতভাবে দুর্জয় লড়াই সংগ্রাম গড়ে তুলি।