কৃতিত্বের এত লোভ কেন?
-
-
- Jan 05, 2021 09:43 [IST]
- Last Update: Jan 05, 2021 09:43 [IST]
অত্যধিক তৎপরতার সঙ্গে দু’টি করোনা প্রতিষেধক টিকাকে ছাড়পত্র দিয়ে দিয়েছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার। তার একটি বিদেশি কোভিশিল্ড (অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং অ্যাস্ট্র্যাজেনেকার তৈরি)। অন্যটি দেশীয় কোভ্যাক্সিন (সরকারি সংস্থা আইসিএমআর’র সহায়তায় বেসরকারি ভারত বায়োটেকের তৈরি)। ছাড়পত্র দেবার সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং আত্মনির্ভর ভারতের সাফল্যের জয়গান শুরু করে দিয়েছেন। অন্যদিকে তাঁর অনুগত ভক্তবৃন্দ মোদীর নেতৃত্বে আত্মনির্ভর ভারতের ধ্বজা উড়িয়ে দিয়েছেন। তারা বোঝাতে চেয়েছেন করোনার টিকা শুধু বিদেশে আবিষ্কার হয়নি, ভারতেও হয়েছে এবং সেটা সম্ভব হয়েছে নরেন্দ্র মোদীর ‘বিচক্ষণতায়।’
স্বদেশে তৈরি টিকা দিয়ে যদি ভারতবাসীকে করোনার আক্রমণ থেকে রক্ষা করা যায়, তারচেয়ে আনন্দের ও গৌরবের কিছু হতে পারে না। কিন্তু সত্যিই কি সেই আনন্দে উদ্বেল হবার সময় এসেছে? চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে আজ পর্যন্ত কোনও টিকা দশ বছরের আগে গণটিকাকরণে ব্যবহার হয়নি। কারণ যে-কোনও টিকারই স্বল্পকালীন, মধ্যকালীন ও দীর্ঘকালীন প্রতিক্রিয়া যাচাই করেত, বিজ্ঞান স্বীকৃত সমস্ত স্তরের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল উচ্চমার্গের বিজ্ঞান পত্রিকায় প্রকাশ করে সারা বিশ্বের বিশেষজ্ঞদের মতামত জেনে অর্থাৎ সব ধরনের প্রশ্ন, সন্দেহ এবং আশঙ্কার নিরসন ঘটিয়ে আমজনতার ব্যবহারের জন্য আসতে এতটা সময় লাগে। এই প্রথম কার্যত সারা বিশ্বকে মহামারীতে ডুবিয়ে দেওয়া একটি ভয়ানক ভাইরাসের বিরুদ্ধে তৈরি টিকা গণব্যবহারের ছাড়পত্র পেল এক বছরেরও কম সময়ে। স্বাভাবিকভাবেই করোনা আতঙ্কে কার্যত থমকে যাওয়া মানুষের জীবনে অনেকটা আশার আলো বয়ে আনলেও পুরোপুরি অনিশ্চয়তামুক্ত হবার উপায় নেই।
বিভিন্ন দেশে বেশ কয়েক ডজন করোনা টিকা আবিষ্কার হলেও, তার কার্যকারিতা নিয়ে কিছুটা হলেও নিশ্চয়তা মিলেছে গুটি কয়েকের। বেশিরভাগই রয়েছে মানব শরীরে প্রয়োগ সংক্রান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিভিন্ন স্তরে। প্রধানত তিনটি পর্যায়ে এই প্রয়োগ পরীক্ষা চলে। প্রতিটি স্তরে পরীক্ষার পর ফলাফল সংক্রান্ত রিপোর্ট আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-গবেষণা পত্রিকায় প্রকাশ করা হয় বিশেষজ্ঞদের পর্যালোচনার জন্য। এইভাবে তিনটি পর্যায়ে উত্তীর্ণ হবার পর গণ-প্রয়োগের কথা বিবেচিত হয়। কোভিশিল্ড এই তিনটি পর্ব অতিক্রম করেছে। পরীক্ষা হয়েছে ব্রিটেন এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রয়োগ করে। কোভিশিল্ডের গণটিকাকরণের ছাড়পত্র মিলেছে ব্রিটেন, আমেরিকা ও ইওরোপের অন্যান্য দেশে। অতঃপর ভারতেও তার ছাড়পত্র মিলেছে। দীর্ঘ মেয়াদে এই টিকার প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে অনিশ্চয়তা থাকলেও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মেনে পরীক্ষা-নিরীক্ষার গুরুত্বপূর্ণ ধাপ অতিক্রম করেছে। তিনটি পর্বের ফলাফল আন্তর্জাতিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এবং সারা বিশ্বের মানুষের গোচরে এসেছে। কিন্তু কোভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে এসব কিছুই হয়নি।
কোভ্যাকসিন সবে প্রথম দুটি ধাপ পেরিয়ে তৃতীয় ধাপে পা দিয়েছে। তারচেয়েও বড় কথা, প্রথম দুই ধাপের প্রয়োগ সংক্রান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল কোনও পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়নি। ফলে মানব শরীরে এই টিকার ঠিক কি প্রতিক্রিয়া, কেউ জানেন না। প্রথম দুই ধাপের পরীক্ষার ফলাফল গোপন রেখে তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা শেষ হবার আগে কিভাবে এমন এক গুরুত্বপূর্ণ টিকা মানব শরীরে প্রয়োগের ছাড়পত্র দেওয়া যেতে পারে, তার কোনও জবাব মোদী সরকার দেয়নি। টিকার ক্ষেত্রে এমন অস্বচ্ছতা মেনে নেওয়া যায় না। এটা পুরোপুরি বিজ্ঞান-বিরোধী। বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে গিয়ে ভারতবাসীকে গিনিপিগ বানানোর এই চেষ্টা শুধু অমানবিক নয়, অনৈতিকও। শুধুমাত্র রাজনৈতিক লোভ ও লাভের তাগিদে মোদীরা এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন এবং ন্যূনতম আন্তর্জাতিক বিধি লঙ্ঘন করে মানুষকে ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিতে দ্বিধা করেননি। আত্মনির্ভর ভারতের গৌরব গাঁথা নিজের মুকুটে প্রোজ্জ্বল করার প্রধানমন্ত্রী সাধারণ মানুষকে ভয়ঙ্কর বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন না তো?