নিজেদের দাবিতে, মানুষের দাবিতে লড়তেই হবে ছাত্রদের
-
গৌতম দেব
- Dec 30, 2020 12:47 [IST]
- Last Update: Dec 30, 2020 11:41 [IST]
বিপ্লব শুধু মাত্র ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপার না। বিপ্লব দেশে দেশে ধাত্রীর কাজ করে। শোষক- শাসকের জগদ্দল পাথরটিকে দুহাতে তুলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। শুধু তাই নয়; বিপ্লব মানুষ মানুষে শোষণ বন্ধ করতে চাইলে এবং এটা শান্তিপূর্ণভাবে শ্রমিক কৃষকরা করতে চাইলেও শাসকেরা, সামন্তপ্রভু অথবা বুর্জোয়ারা তাদের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে বিপ্লবী শক্তিকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। মার্কস ও এঙ্গেলস বিপ্লব সম্পর্কে সঠিক ধারণা আমাদের সামনে উপস্থিত করেছেন।
ভারতের ছাত্র আন্দোলন সংগঠিত আকারে দেশের সামনে আসে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে। বিশেষ করে ছাত্র সমাজের সামনে হাজির হয়েছে পঞ্চাশ বছর হলো। তার আগে দেশব্যাপী ছাত্র সমাজ ঘুমোচ্ছিল না। কিন্তু তা সমগ্র দেশব্যাপী সুসংহত রূপে দেখা যায়নি – তা ছিল প্রদেশজুড়ে আলাদা আলাদাভাবে, বিভিন্ন ইস্যুতে। কিন্তু সারা দেশে একটি বামপন্থী গণতান্ত্রিক সংগঠনের অনুপস্থিতিতে গণআন্দোলনে ছাত্ররা একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে ভূমিকা পালন করছিল। কিন্তু ছাত্ররা যারা দুনিয়াজুড়ে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখে তাদের বাংলা বা ওডিশা বা কেরালার মধ্যে আটকে রাখবেন কিভাবে? এই আর্তি থেকে পশ্চিম বাংলায় বিপিএসএফ বা কেরালায় কেএসএফ সহ দেশের বিভিন্ন রাজ্যের বামমার্গী অগ্রণী ছাত্র সংগঠনগুলি একত্রিত হয়ে কেরালার তিরুবনন্তপুরমে মিলিত হয়ে ভারতের ছাত্র ফেডারেশন গঠন করে। বহুদিনের একটা শূন্যতা পূরণ হলো। ছাত্ররা নিজেরা কোনও আলাদা শ্রেণি নয়, তারা সমাজের বিভিন্ন অংশ থেকে আসে। প্রকৃত পক্ষে তিনটি বাহু তাদের কাজের মধ্যে প্রতিফলিত। প্রথমত, দেশের কোটি কোটি ছাত্র-ছাত্রীদের একটা অংশকে দারিদ্র, ক্ষুধা বেকারি সহ নানা অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। এই কারণগুলি এবং তাদের শ্রমিক-কৃষকদের পরিবারের সাথে অন্তরঙ্গতা এবং সদস্যভুক্তি আছে বলে তারা শ্রেণি সংগ্রামের আঁচ ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে বহন করতে পারে। দ্বিতীয়ত, এদের বয়সসীমা যা তাতে তারা বয়সজনিত দুঃসাহসিক স্বপ্ন দেখার সাহস দেখায় যে পৃথিবীটাকে পালটাবে – চোখে সেই চাহনি, চোখেমুখে সেই দৃঢ়তা, প্রাণে সেই আবেগ – এ বয়সকে স্বতন্ত্র মর্যাদা দেয়। এটা কেবল ভারতের ব্যাপার নয় – সব দেশেই প্রযোজ্য। অন্যদিকে এই বয়স প্রতিক্রিয়ার শাণিত তরোয়ালে পরিণত হতে পারে, সেই কারণে দেশে দেশে রাষ্ট্র বার বার চেষ্টা করে ছাত্রদের কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলতে। ’৭২-’৭৭এ আমরা দেখেছি ছাত্রপরিষদ আর যুব কংগ্রেসকে— অকল্পনীয় খুন, ক্যাম্পাসে রক্তারক্তি, এসএফআই’র উপর নির্মম আক্রমণ ঘটাতে। তৃতীয়ত, অভিজ্ঞতার কিছুটা অভাব হলেও চিন্তা এবং কাজের গতি অকুতোভয়ে শত্রুশিবিরের সামনে বুক পেতে দাঁড়ানো অথবা ঝুঁকিপূর্ণ কাজে আগুয়ান হওয়া, প্রশ্ন করার প্রবণতা এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানার সীমাহীন ক্ষুধা এবং অন্বেষা এই সমাজকে স্বতন্ত্র মর্যাদা দেয়। রাশিয়ার বিপ্লবেও শ্রমিক-কৃষকের পাশাপাশি ছাত্রদের দেখা গেছে এই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে। তাই লেনিন বলেছেন “ ছাত্ররা বিপ্লবের বাণী বাহক”। এ ছাড়া ছাত্র আন্দোলন দেশের গণতান্ত্রিক এবং বিপ্লবী আন্দোলনে জোগান দেয় অসংখ্য উদ্যোগী কমরেডদের যাদের সাহসী স্নেহচ্ছায়ায় দেশে দেশে গড়ে ওঠে কমিউনিস্ট পার্টি। ভারতের দিকে দিকে তাকালে ক’দিন আগের ছাত্রনেতা আজ শ্রমিক কৃষক সর্বোপরি পার্টিনেতা হিসাবে উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করছেন। এছাড়াও মনে রাখতে হবে ছাত্ররা ১৮ বছর পূর্ণ হবার জন্য স্কুলে কিছু সংখ্যক এবং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় সবাই ভোটার। ভোটার হিসাবে সংখ্যাটা একেবারে নগণ্য নয়। এছাড়া দেশ গঠনে ছাত্রদের বিপুল ভূমিকাকেই বা অস্বীকার করবে ? আজকের ছাত্রদের একটা অংশ ভয়ংকর করোনার হাত থেকে বাঁচার জন্য যে ঔষধাদির প্রয়োজন, তাও আবিষ্কার করার কাজে পঠন পাঠনে এবং গবেষণায় নিয়োজিত। তাই এসএফআই স্লোগান দেয় ‘Study and struggle’। আধুনিক সংশোধনবাদের জনক বার্নস্টাইনের মতের সাথে ছাত্রদের বিপ্লবীচেতনা খাপ খায় না। বার্নস্টাইন বলেছিলেন “struggle is everything: the ultimate aim is nothing”। তাই ছাত্রদের শুধু বিপ্লবের বাণী প্রচার করলে হবে না, পরিবর্তনশীল দুনিয়ায় রাষ্ট্রবিপ্লব বার বার অধ্যয়ন করতে হবে, আয়ত্ত করতে হবে। এ বিষয়ে কলেজ, ক্যান্টিন, কমনরুম, সাংস্কৃতিক কাজকর্মের মধ্যে ছাত্র-ছাত্রীরা তুমুল বিতর্ক করবেন – চালু সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা এবং টিকে থাকার অপ্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে।
দিল্লির জেএনইউ যে সাধারণ হস্টেলের ফি কমানোর আন্দোলনকে রাষ্ট্রের সাথে জনতার সংঘর্ষকে সারা দেশের আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করে অথবা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতন্ত্র রক্ষা ও বিস্তারে রাজ্যপালকে পর্যন্ত মোকাবিলা করে – তা কি শুধু ছাত্রদের অনুপ্রেরণা দেয়? এসএফআই তৈরি হবার পর রাজ্যে রাজ্যে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের যে অগ্রগতি ঘটেছে তা অন্য সংগঠনগুলির কাছে ঈর্ষণীয়।
ছাত্র-ছাত্রীরা অসাম্প্রদায়িকতা এবং দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি নিরন্তর শ্রদ্ধাশীল থাকতে চায়। বয়সজনিত কারণে ছাত্র-ছাত্রীদের উদারমনা দৃষ্টিভঙ্গির কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে এমন কোনও কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে এবিভিপি এক নম্বর সংগঠন। পঞ্চাশ/ষাট বছরের এক আরএসএস নেতা এবিভিপি সভাপতি। তিনিই শেষ কথা। এবিভিপি প্রতিক্রিয়াশীল, দক্ষিণপন্থী সংগঠন আজ ছেলেমেয়েরা কে কাকে ভালোবাসবে তাও ঠিক করে দিতে চাইছে। বানর,সাপ, প্রস্তর খণ্ড থেকে শুরু করে ময়ূর, হরিণ, সূর্য, চন্দ্র, ঝড়, নদী সবই দেব দেবী? সঙ্ঘ পরিবারের কামিকাপি আর হিটলারের গেস্টাপো বাহিনী যাদের হাতে মুসলমান, ইহুদি, গণতান্ত্রিক শক্তি বিশেষ করে কমিউনিস্টরা বার বার আক্রান্ত হচ্ছে। আরএসএস-বিজেপি দিল্লির শাসন ক্ষমতা হাতে পেয়ে তাণ্ডবনৃত্য শুরু করেছে। এরা দেশের চরম দুর্নীতি নিয়ে নরম মনোভাব নেয় এবং সেই সব দুর্নীতিগ্রস্তদের নিজের দলে নিতে কোনও অসুবিধা হয় না – তখন কেউ প্রশ্ন করলে ক্যাসেট উলটে দেয়।
দেশের ক্ষমতা চাই বাম গণতান্ত্রিক শক্তির হাতে। চাই বললে তো কেউ দেবে না – কেড়ে নিতে হবে। বিপ্লব করুন আর ভোট করুন, লোক লাগে। লোক কমে গেলে ভোটও কমে যাবে। বিপ্লবের জন্য দৌড়ও শ্লথ হবে। দশ হাজার বছরের মানব ইতিহাসে পঞ্চাশ বছর কিছুই না। আর লেনিন লাগে, স্তালিন লাগে, মাও জে দঙ লাগে, ফিদেল কাস্ত্রো, চেগুয়েভারা লাগে, হো চি মিন লাগে। এরা দেশে দেশে সংগ্রামের সেরা পুষ্পডালি। তাই জ্যোতি বসু সবার থেকে স্বতন্ত্র। তাই ছাত্ররা বোঝার চেষ্টা করবে কী করে লেনিন লেনিন হলেন। সর্বাগ্রে ছাত্রদের মনোভাব হবে বাজপাখির মতো উদার, শালিখের মতো পলকা কলিজা না। জয় করতে হবে গোটা দুনিয়া। কলেজের ক্লাসে আমার পাশে সব ছেলেকে পাওয়া যাচ্ছে না – এ কি অনিবার্য এবং অবশ্যম্ভাবী না আপনারও কোনও ত্রুটি আছে ? সংগঠনের ইউনিটে যদি এ নিয়ে আলোচনা না হয় তবে কি হবে চায়ের দোকানে বা কফি হাউসে? ক্ষমতার গর্বে উন্মাদপ্রায় বিজেপি, বেপরোয়া মোদী, লাখো কৃষক প্রচণ্ড শীতে দিল্লিতে খোলা আকাশের নিচে দিবারাত্র বিক্ষোভ দেখাচ্ছে, আর মোদী, অমিত শাহ দম্ভ এবং আত্মম্ভরিতায় তাদের দাবি মানতে সরাসরি অস্বীকার করছে। এরা নাকি ভগবানের দল! বলরামদের ঘৃণা করতে কোনও রাম বা কৃষ্ণ শিখিয়েছে ! কিন্তু অযোধ্যায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুত্ববাদীদের বিরাট জয়, যদিও কোনও কার্বন টেস্ট ওখানে করা হয়নি – রামের জন্মস্থান সুনিশ্চিত করার জন্য। দীর্ঘকাল ধীরগতিতে অযোধ্যার ইস্যু মানুষের কাছে তুলতে পেরেছে, একাংশের মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে, আর এটাও সত্যি শক হুন, পাঠান, মোগল থেকে ইংরেজ সাহেব এদেশ দখল করেছে বার বার দেশের কিছু বীর নেতা বাধা দিয়েছেন অসীম বিক্রমে। কিন্তু এই সব যুদ্ধবাজ জাতিগুলি ঝাঁপিয়ে পড়েছে ভারতের উপর। এরা সবাই প্রায় এসেছে দেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে খাইবারপাশ দিয়ে। মধ্য এশিয়া থেকে বেশি এসেছেন। গ্রিসদেশ থেকে এসেছেন। মঙ্গোলিয়া থেকে এসেছেন। ইরান, আরব মুলুক থেকেও এসেছেন।
এখন বিজেপি হুংকার দিচ্ছে মথুরায় আর একটা অযোধ্যা বানানোর। কারণ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্ম ওখানে। তাই, দ্রুততার সাথে না, মথুরা ইস্যু তোলা হচ্ছে ধীরে ধীরে। আরএসএস সভাপতি লন্ডন পর্যন্ত গিয়ে মথুরায় শ্রীকৃষ্ণ জন্মেছিলেন – একথা প্রচার করে আসছেন। আর কদিন আগে দেশবাসীকে দেখানো হলো গঙ্গাবক্ষে প্রধানমন্ত্রী মোদীর কাশীযাত্রা। কাশীতেও শেষ না, এরপর ঘোষিত কর্মসূচির মধ্যে আছে মথুরা। অযোধ্যা হয়ে গেল, দেশময় শান্তিপূর্ণ সাধারণ মানুষ ভাবছেন – এবার নিশ্চয় বিজেপি ঠান্ডা হবে। কিন্তু এ সে বান্দা নয়। একে ঠান্ডা করতে গেলে অন্য অস্ত্র দরকার – কোর্ট কাছারিতেও হবে না। ‘আদানি, আম্বানিকে লক্ষাধিক কোটি টাকার সম্পত্তি করতে দিলাম – ওরা আমাকে ভোটের সময় কমিউনিস্টদের মাথা ভাঙার জন্য, তাদের হারানোর জন্য কয়েক হাজার কোটি টাকা দেবে, এর মধ্যে বেশি কিন্তু, কেন খোঁজার কি আছে?’ তাই লাজ-লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে প্রধানমন্ত্রী বলতে পারেন, ‘আমি তো কর্পোরেটদের কথা দিয়েছি, কথাটা রাখতে দিন, তারপর আপনাদেরটাও (কৃষকদের) দেখবো’।
ছাত্র সমাজ নিজের দাবিতে রাস্তায়, কৃষকের দাবিতে রাস্তায়, বন্ধ কল কারখানা খোলার দাবিতে শ্রমিকদের পাশে রাস্তায়। শ্রমিক বিরোধী আইনের বিরুদ্ধে রাস্তায়, মেয়েদের বিরুদ্ধে অসহনীয় অত্যাচারের বিরুদ্ধে রাস্তায়, শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে রাস্তায়। ছাত্র সমাজ বুঝেছে এই সরকার হটানোর কাজে তাদের রাস্তায় নামতে হবে। আর এই সংগ্রামের প্রথম সারিতে থাকবে অন্যদের সাথে পশ্চিমবঙ্গের ছাত্রসমাজ এসএফআই’র নেতৃত্বে।