পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হোক জনগণের সাধারণতন্ত্র
-
নীলোৎপল বসু
- Jan 26, 2021 11:35 [IST]
- Last Update: Jan 26, 2021 11:35 [IST]
২৬জানুয়ারি, ২০২১। সাধারণতন্ত্র দিবস। সত্তর বছর পর। কিন্তু অচেনা।
একেবারেই নতুন চেহারায়, ঘোষণায়। বলা ভালো
হুঙ্কারে। যাদের জন্য ‘তন্ত্র’, সেই সাধারণ, সংবিধানের স্বীকৃতির উদ্যাপনের মুহূর্তকে জীবন্ত করে তুলতে
তাদের সাধারণতন্ত্রে, তাদের সংবিধানে
নিজেদের অধিকারের হিসাব বুঝে নিতে তারা আসছে রাজধানীতে।
কৃষক। দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক তারা।
চোখে চোখ রেখে সরকারের সঙ্গে পাঞ্জা কষছে তারা। দু’মাস ধরে। ২৬ নভেম্বর থেকে। তারা
চাইছিল রাজধানীতে আসতে। তাদের যন্ত্রণার কথা, বিরুদ্ধতার কথা, প্রতিবাদের কথা
নিয়ে গোটা দেশের মানুষের সামনে সোচ্চারে মুখর হতে। কিন্তু নিষেধ প্রবেশাধিকারে।
আগে সীমানার অর্থ ছিল দেশের আন্তর্জাতিক সীমান্ত। পাঞ্জাব থেকে হরিয়ানা আসতেও
সীমান্ত। রাজস্থান থেকেও। আর তারপর রাজধানী দূর অস্ত! প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর
সীমান্তেও তথৈবচ; উত্তর প্রদেশ, উত্তরাখণ্ডের কাছেও রাজধানী অধরা। তাই রাজধানী লাগোয়া
সবগুলি রাজ্যের কৃষকরা ঘাঁটি গেড়েছেন। দিল্লি ঢোকার পাঁচটা প্রবেশপথেই। জল কামান, কংক্রিটের বোল্ডার, রাস্তা খুঁড়ে, স্টিলের ব্যারিয়ার
কিছুই আটকে রাখতে পারেনি তাঁদের। প্রায় শূণ্য ডিগ্রি তাপমাত্রা, প্রবল বৃষ্টি কিছুই দমাতে পারেনি তাঁদের ইস্পাতদৃঢ় ঐক্য, ধৈর্য, শান্তিপূর্ণ
সংগঠিত প্রতিবাদ, প্রতিরোধকে।
সারা দেশের পাঁচশোর বেশি কৃষক সংগঠন
এককাট্টা। তিনটি কৃষি আইন বাতিল করতে। কৃষকদের মৃত্যু পরোয়ানা এগুলি। আদানি, আম্বানি আর কর্পোরেটদের স্বার্থে। কৃষি ক্ষেত্রের সম্পূর্ণ
নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে তুলে দিতে।
সরকার শুরুতে গোঁ ধরেছিল। কৃষক
সংগঠনগুলির সঙ্গে আলোচনায় বসবে না। অনেক ষড়যন্ত্রও হলো। সন্ত্রাসবাদী। খালিস্তানী।
মাওবাদী। তারপর পরিচিত কায়দায়, এনআইএ লেলিয়ে
দেওয়া। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা! কোনও কিছুই দমাতে পারল না কৃষকদের। প্রতিদিন নতুন
নতুন রাজ্য থেকে, এলাকা থেকে হাজারে
হাজারে তারা যোগ দিয়েছেন। আর যাঁরা আসতে পারলেন না, স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল! সারা দেশ জুড়েই। কৃষকের সঙ্গে শ্রমিক। ছাত্র,যুব, মহিলা, অন্যান্য গণতান্ত্রিক অংশ। ৮ ডিসেম্বর দেশ স্তব্ধ করে দেওয়া
বন্ধ।
সরকার বাধ্য হয়েছে আলোচনায় বসতে। ১১
রাউন্ড হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সরকার মূল দাবি মেনে নেয়নি। আইন বাতিল করবার। শেষমেশ
একটা অর্থহীন প্রস্তাব। আইন স্থগিত করতে রাজি। দেড় থেকে দু’বছর। সরকারের ক্ষমতাই
নেই এটা করার। পাশ হয়ে যাওয়া আইন রদ করা যায় না; বাতিল করতে পারে সংসদ, আর সংশোধন। সুতরাং
শিরদাঁড়া সোজা রাখা লড়াই জারি। এই আবহেই ২৬ জানুয়ারি, ২০২। সাধারণতন্ত্র দিবস।
উৎস কী: এই চোয়াল শক্ত লড়াইয়ের
অবশ্যই কৃষক সাধারণের অবর্ণনীয়
বিপন্নতার। সত্তর বছরের সাধারণতন্ত্র। কিন্তু এক সময় দেশের জিডিপি’র ৫০ শতাংশের
বেশি অবদান রাখা কৃষির, কৃষকের অবস্থা
ভয়ঙ্কর। পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে গত তিন দশকে। নয়া উদারবাদী আর্থিক সংস্কারের
পটভূমিতে। কৃষি ক্ষেত্রেও হয়েছে উদারীকরণ। কৃষিতে এর প্রভাব কৃষকের রুটি-রুজিকে
করেছে বিপন্ন। চাষের খরচ বেড়েছে বহুগুণ। সার, বীজ,
কীটনাশক, সেচ সব কিছুই
হয়েছে মহার্ঘ। সবটাই প্রায় দেশি-বিদেশি কর্পোরেটের স্বাধীন বদান্যতায়। অন্যদিকে
মূলত বর্ষার জলের উপর ভরসা রাখা কৃষকের নিদারুণ কষ্টে অর্জিত ফসলের দামও
আনুপাতিকভাবে বাড়েনি। ফসল মজুত এবং বাজারজাত করবার পরিকাঠামোতেও ক্রমশ বেড়েছে
বেসরকারি কর্পোরেট ভূমিকা। বাজেটে কৃষির জন্য সরকারি বিনিয়োগ কমেছে। ফলে যা হওয়ার
তাই হয়েছে। কৃষি ক্রমশই অলাভজনক হতে থেকেছে। বেড়েছে ঋণের বোঝা। দায়গ্রস্ত কৃষকদের
আত্মহত্যার মিছিল হয়েছে দীর্ঘতর। সঙ্কট আরও বেড়েছে কারণ রপ্তানির ক্ষেত্রেও ভারতীয়
কৃষকদের প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে আকাশ সমান মার্কিন এবং ইউরোপীয় কৃষকদের বিপুল
পরিমাণে সরকারি ভরতুকি পাওয়া উৎপাদিত ফসলের সাথে। নিদারুণ এই অবস্থা কৃষকদের
দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দিয়েছে মোদী সরকার। ২০১৬ সালে কৃষকদের জমি প্রায় বাধাহীন ভাবে
অধিগ্রহণের অর্ডিন্যান্স জারি করেছিল তারা। প্রতিক্রিয়ায় গড়ে উঠেছিল ভূমি অধিকার
আন্দোলন। অনেকটা জায়গা জুড়েই। কৃষির কাঠামোর যে মৌলিক কৃষক বিরোধী উপাদান তা তীব্র
হলো ২০১৬ নভেম্বরে নোটবন্দির নাটকীয় সিদ্ধান্তে। নগদ টাকা উধাও। খেতে দাঁড়িয়ে
রয়েছে তৈরি ফসল। ফড়েদের হাতে টাকা নেই। জলের দরে ফসল বেচতে বাধ্য হলো কৃষক।
প্রতিবাদ হলো। গুলি চললো মধ্য প্রদেশের মান্দসোরে সোয়াবিন চাষিদের উপর। প্রতিক্রিয়ায়
গড়ে উঠলো সারা ভারত কৃষক সংগ্রাম কমিটি। একা এই লড়াই জেতা যাবে না, বুঝল কৃষক। বুঝল দল মত নির্বিশেষে সমস্ত কৃষক সংগঠন।
১৫০-২০০ কৃষক সংগঠন চলে এল এক ছাতার তলায়। সমন্বয় কমিটির যৌথ কার্যকলাপে। দাবি উঠল
নায্য এমএসপি কার্যকরী না হওয়া স্বামীনাথন কমিশনের ফসলের খরচের অতিরিক্ত ৫০
শতাংশের দাবি নিশ্চিত করতে। মোদী ২০১৪ নির্বাচনে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সরকারে
এসেই এটা কার্যকর করার। কিন্তু ক্ষমতায় এসেই চোখ উলটে গেল। বছরও গেল না ২০১৪
সেপ্টেম্বরেই সুপ্রিম কোর্টকে হলফনামা দিয়ে বলে দিল এটা কিছুতেই কার্যকরী করা
সম্ভব নয় সরকারের। পাশাপাশি ফসল কেনার ক্ষেত্রে ক্রমশ সঙ্কুচিত হতে থাকল সরকারের
ভূমিকা। এফসিআই কোথা থেকে টাকা পয়সা পাবে কেনবার মজুত বাড়াবার। দেশের বেশিরভাগ
অংশে এপিএমসি মান্ডি গড়ে তোলবার! এফসিআই’কে সরকারের পক্ষ থেকে যে টাকা দেবার কথা
সেই বকেয়াও বাড়তে থাকল সাইক্লোনের গতিতে। এই শূন্যতায় পৌষ মাস হলো বেসরকারি
কর্পোরেটদের। আনুপাতিক হারে কমতে থাকল কৃষকদের ফসলের দাম। তাই এমএসপি’র সাথে
সুনিশ্চিত ফসল ক্রয় সরকারের ভূমিকার দাবি উঠল সোচ্চারে। কৃষির এই সমস্যা জর্জরিত
ব্যবস্থায় কৃষকের বিপন্নতা ছড়িয়ে পড়লো দেশ জুড়েই। কিন্তু হলে কী হবে! মোদী সরকারের
নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণে থাকা মূল মাধ্যমের কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত ভাষ্যে অধরা থেকে গেল
কৃষকদের বিপন্নতার এই মর্মন্তুদ ইতিবৃত্ত। বড়জোর থেকে গেল কিছু কৃষক আত্মহত্যার
বিক্ষিপ্ত মানবিক বিবরণ। এই সময়ই গড়ে ওঠা ছোট-বড় অসংখ্য লড়াইয়ের কথাও অজানা থেকে
গেল। কিন্তু কৃষক সংগঠনগুলি হাত গুটিয়ে বসে থাকেনি। সমন্বয় কমিটির নেতৃত্বে
প্রস্তুতি চালিয়ে গেছে ঝড় তোলবার। সরকারি নীতির বিরোধিতাই শুধু নয়, বিকল্প আইনের খসড়াও পেশ হয়েছে সংসদে। এই আবহেই তিনটি কৃষি
আইন। কর্পোরেট স্বার্থে চুক্তি চাষ। দূরবীন দিয়ে দেখতে হয় এরকম নগণ্য সংখ্যার
এপিএমসি মান্ডিগুলিকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া। আর মজুতদারির ঊর্ধ্বসীমা
তুলে দিয়ে কালোবাজারির স্বাধীনতার চাবিকাঠি বেসরকারি কর্পোরেটদের হাতে দিয়ে দিতে
অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনের সংশোধন। বিপন্ন কৃষক উপলব্ধি করল এটাই কফিনের শেষ পেরেক।
কৃষকের মৃত্যু পরোয়ানা। এটাই অর্ডিন্যান্স জারি হওয়ার পর থেকেই চলমান কৃষক আন্দোলন
শক্তির উৎস। ঐক্যের, দৃঢ়তার, সংঘবদ্ধতার স্বাধীনতা-উত্তর সবচেয়ে শক্তিশালী, ঐক্যবদ্ধ, শান্তিপূর্ণ কৃষক
আন্দোলন দেখছে ভারত।
কৃষক আন্দোলন দেশের স্বার্থের
প্রশ্নকেও সামনে এনেছে। কৃষি উৎপাদন এবং খাদ্যপণ্য সহ কৃষি পণ্যের সম্পূর্ণ
ব্যবসাই যদি বেসরকারি কর্পোরেটের হাতে চলে যায়, তবে খাদ্যপণ্য সংগ্রহ এবং রেশন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। খাদ্যের
আত্মনির্ভর দেশ সম্পূর্ণ ভাবেই নির্ভরশীল হয়ে পড়বে বেসরকারি কর্পোরেটের মুনাফার
যূপকাষ্ঠে। ফলে এই আন্দোলন আর শুধু কৃষকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না। দিল্লির
প্রবেশপথগুলি থেকে আপসহীন লড়াইয়ের বার্তা পৌঁছে গেছে দেশের গ্রাম শহরের প্রত্যন্ত
প্রদেশে। কোনও দমন পীড়ন ষড়যন্ত্রই তাকে স্তব্ধ করতে পারছে না।
রিক্লেইম দ্য রিপাব্লিক: এটাই
রণধ্বনি
অভিনব সাধারণতন্ত্র দিবস উদ্যাপন
দেখবে দেশ। এর আগে সত্তর বার হয়েছে অন্য রকম। সাধারণতন্ত্র ধীরে ধীরে কুক্ষিগত
হয়েছিল সরকারি নিয়ন্ত্রণে। ট্যাবলো, বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা ভারতের সামরিক পেশিশক্তির প্রদর্শন। কিন্তু আজ
সাধারণতন্ত্রই আক্রান্ত। আক্রান্ত দেশের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সংবিধান। আদানি-আম্বানি
দেশ চালাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর হাত ধরে। প্রশাসন, আইনসভা, বিচার ব্যবস্থা, তাদের স্বাধীন ভূমিকা অনেকটাই খুইয়ে ফেলেছে কর্পোরেট
হিন্দুত্বের তীব্র আগ্রাসনে। তাই এই নতুন আবহ। নতুন স্লোগান। কৃষি আইন বাতিল না
করতে পারার কারণ আন্দোলনের ভাষায় ‘‘সরকার কি আসলি মজবুরি/ আদানি-আম্বানি অউর
জমাখোরি’’।
সমান্তরাল উদ্যাপন
মানুষের। প্রধানত কৃষকদের। কিন্তু সাথে রয়েছে শ্রমিক সহ সমাজের অন্যান্য
গণতান্ত্রিক অংশের মানুষও। হার না মানা প্রতিরোধের মুখ কৃষক। তাই এই উদ্যাপনের
প্রধান হাতিয়ার ট্রাক্টর। দিল্লিকে ঘিরে থাকা রিং রোড জুড়ে ১০০ কিলোমিটারে থাকবে
লক্ষ-লক্ষ ট্রাক্টর আর মানুষ। কৃষক নেতৃত্বের ভাষ্যে ‘‘আমরা দিল্লি আসছি যুদ্ধ
জয়ের জন্য নয়, দেশের মানুষের হৃদয় জয়
করতে’’। আর শুধুই কি দিল্লি! গোটা দেশের সর্বত্র লক্ষ-লক্ষ কর্মসূচি এই উদ্যাপনের।
রাজধানী, জেলা, ব্লক, গ্রাম, সর্বত্র হবে এই শোভাযাত্রা জাঠা। কৃষি আইন বাতিল করো।
সাধারণতন্ত্রকে ফিরিয়ে দাও সাধারণের কাছে। এই ‘সাধারণ’তন্ত্র ফিরে পাওয়ার আকুতি
আসলে তিন কৃষি আইন রূপায়ণ করতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গত ছয়-সাত মাস চলতে
হলো দেশকে তার অভিজ্ঞতাই এই লড়াইয়ের মর্মবস্তু।