অর্ণবের গোস্বামীর চ্যাটের রহস্য
-
সুশোভন
- Jan 22, 2021 15:11 [IST]
- Last Update: Jan 22, 2021 15:05 [IST]
আপনি স্বাধীন ভারতের নাগরিক হিসাবে নিশ্চয় বহু দুর্নীতির কথা শুনেছেন। কয়লা, স্পেকট্রাম, বোফর্স কিম্বা রাফালে; এমনকি কারগিল সংঘর্ষে মৃত জওয়ানের লাশ বয়ে আনা কফিন—ভারতের রাজনীতির সঙ্গে দুর্নীতির সম্পর্ক পান্তা ভাতের সঙ্গে একটুকরো ছাঁচি পেঁয়াজের মতো। অবশ্য আপনি বলতে পারেন, দুর্নীতি খুঁজতে অত দূরই বা কেন যেতে হবে? ‘ঘরের লক্ষ্মী’র অনুপ্রেরণায় এসএসসি, টেট, সারদা, নারদ, আমফান–লিস্ট কি কম লম্বা নাকি? পাড়ায় পাড়ায় তৃণমূল নেতাদের তোলাবাজির পয়সায় গজিয়ে ওঠা বাড়ির সামনে দাঁড়ালেই তো বোঝা যায় দুর্নীতিতে ‘এগিয়ে বাংলা’।
ভারতীয় রাজনীতির দুর্নীতির এই লম্বা লিস্টে নতুন সংযোজন TRP দুর্নীতি। নতুন বললে সত্যের অপলাপ হয়। কারণ, এর আগেও, ২০১৭তে একবার এবং ২০০২-০৩ আরেকবার TRP দুর্নীতির কিছু অভিযোগ জনসমক্ষে এসেছিল। কিন্তু অন্যবারের তুলনায় এবারের TRP দুর্নীতির অভিযোগের ব্যাপ্তি, গভীরতা এবং রাজনৈতিক তাৎপর্য বহু গুণ বেশি। সৌজন্যে রিপাবলিক টিভি এবং ‘গদি মিডিয়ার’ স্বঘোষিত শাগরেদ অর্ণব গোস্বামী।
কিন্তু TRP আসলে কী? খায় না মাথায় দেয়? TRPমাপেই বা কীভাবে? TRPনিয়ে দুর্নীতি করেই বা কী করে? তাতে লাভ বা কী? ঠিকই, আমাদের পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতো করে প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে বিষয়টার প্রেক্ষাপটটা বোঝা দরকার।
২।
TRP মানে, Television Rating Point। সহজে বললে কোনও টিভি চ্যানেল কত বেশি দেখা হচ্ছে সেটা যে একক দিয়ে মাপা হয় সেটাই TRP। মানে ধরুন চ্যানেল ‘ক’ ১০জন মানুষ প্রতিদিন ৫ মিনিট করে দেখেন। তাহলে চ্যানেল ‘ক’-র Television Rating Point হলো, ১০X৫=৫০। আবার ধরুন চ্যানেল ‘খ’ ৩জন মানুষ প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে দেখেন। তাহলে চ্যানেল ‘খ’-র Television Rating Point হলো, ৩০X৩=৯০। এই সমীকরণ অনুযায়ী চ্যানেল ‘খ’-র TRP, চ্যানেল ‘ক’-র থেকে বেশি। মোদ্দা কথা হলো, কোনও চ্যানেলের TRP বলতে সেই চ্যানেল কত বেশিক্ষণ দেখা হচ্ছে তার একটা পরিমাপ।
কারা মাপে দেশের এর সব চ্যানেলের TRP? আর কিভাবেই বা মাপে? প্রথম প্রশ্নের উত্তর ছোট্ট, BARC মানে, Broadcast Audience Research Council। আমাদের দেশের প্রায় ৪৪,০০০ ঘরে BAR-O-meter নামের একটা যন্ত্র বসানো আছে। যে যন্ত্রের প্রতি সপ্তাহের রিডিং থেকে BARC দেশের সমস্ত চ্যানেলের TRP গণনা করে। মানে আপনি বলতে পারেন, দেশের সমস্ত চ্যানেলের Television Rating Point মাপার জন্য BARC-র প্রতিনিধিত্বমূলক ‘স্যাম্পল সাইজ’ হলো ৪৪,০০০। এখানে দুটো তথ্য জেনে রাখা জরুরি।
এক, দুর্নীতি এড়াতে এই প্রতিনিধিত্বমূলক ‘স্যাম্পল সাইজ’-এর সমস্ত তথ্য গোপন থাকার কথা। কারণ না হলে, বিভিন্ন চ্যানেল সেই প্রতিনিধিত্বমূলক ‘স্যাম্পল সাইজ’-এর ঘরে গিয়ে তাদের চ্যানেলের TRP বাড়ানোর জন্য ঐ পরিবারের মানুষগুলিকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করতে পারেন।
দুই, এই প্রতিনিধিত্বমূলক ‘স্যাম্পল সাইজ’ খুঁজে বের করা এবং সেই সমস্ত ঘরগুলিতে BAR-O-meter বসানোর কাজ, BARC নিজে করে না। করে ‘হান্সা রিসার্চ’ বলে একটি প্রাইভেট কোম্পানি।
এ পর্যন্ত পড়ে আপনি বলতে পারেন, দূর মশাই, BARC, ‘স্যাম্পল সাইজ’, BAR-O-meter– সবই তো বুঝলাম কিন্তু আগে বলুন TRP দুর্নীতি করে লাভ কী? লাভ বলতে, যে চ্যানেলের TRP যত বেশি সেই চ্যানেলের বিজ্ঞাপন পাওয়ার সম্ভাবনা এবং বিজ্ঞাপন প্রতি দর বাড়িয়ে রাখার সুযোগ তত বেশি। অর্থাৎ TRP বেশি হলে সেই চ্যানেলের আয় বেশি। সিম্পল!
৩।
এখানেই গল্পে এন্ট্রি নিচ্ছেন অর্ণব গোস্বামী! তাঁর চ্যানেল রিপাবলিক টিভির বিরুদ্ধে মুম্বাই পুলিশের নির্দিষ্ট অভিযোগ হলো, রিপাবলিক টিভি ঘুষ দিয়ে ‘হান্সা রিসার্চ’ থেকে ঐ ৪৪,০০০ প্রতিনিধিত্বমূলক ‘স্যাম্পল সাইজ’-এর গোপন তথ্য আদায় করেছে। তার ভিত্তিতে ঐ ‘স্যাম্পল সাইজ’-এর বিভিন্ন ঘরে যোগাযোগ করে, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে, ঘুষ দিয়ে, তাদেরকে রিপাবলিক টিভি চ্যানেলে বেশিক্ষণ চালিয়ে রাখতে বাধ্য করেছে। ফলে BARC-র গণনায় রিপাবলিক টিভির TRP বেশি হয়েছে এবং বিজ্ঞাপন সংস্থার কাছ থেকে বেশি দামে বেশি বিজ্ঞাপন আদায় করেছে।
বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন। তাই এই প্রসঙ্গে এর বেশি চর্চা এখন নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু ‘কার্টেন রেসার’ হলো এই অভিযোগের তদন্ত করতে গিয়ে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কেউটে বেরিয়ে আসার জোগাড়। মুম্বাই পুলিশ তদন্তের চার্জশিটে অর্ণবের ৩৪০০ পাতার একটি হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট প্রমাণ হিসাব দাখিল করেছে। চার্জশিটের সেই চ্যাট আবার পাবলিক ডোমেনে ‘লিক’ হয়েছে।
কে করল এই ‘লিক’? কিম্বা মুম্বাই পুলিশই বা কীভাবে পেলো এই চ্যাট? প্রথম প্রশ্নের কোনও সদুত্তর আপাতত নেই। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে বলা হচ্ছে, অর্ণব যার সাথে চ্যাট করেছিলেন, অর্থাৎ BARC-র প্রাক্তন CEO পার্থ দাশগুপ্ত, তিনি এখন একটি অন্য মামলায় পুলিশি হেপাজতে। ফলে পুলিশ তার বাজেয়াপ্ত মোবাইল থেকে এই চ্যাট উদ্ধার করেছে, এই সম্ভাবনাই প্রবল। এখন, লাখ টাকার প্রশ্ন হলো কী আছে সেই চ্যাটে যা নিয়ে তোলপাড় হচ্ছে গোটা দেশ?
৪।
চ্যাটে একাধিক জায়গায় ফুটে উঠেছে, সরকারের বিভিন্ন দপ্তর থেকে শুরু করে বিজেপি’র শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে অর্ণবের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তো রয়েইছে, এমনকি সরকারি নীতির প্রণয়নের, দেশের মিলিটারি সিক্রেটের অগ্রিম তথ্যও রয়েছে অর্ণবের কাছে। উদাহরণ চাই ? আচ্ছা দিচ্ছি!
এক, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, অর্ণব চ্যাটে পার্থ দাশগুপ্তকে লিখছেন, “Something big will happen. Govt. is confident of striking in a way that people will be elated. Exact word used”। আচ্ছা, বালাকোটে তথাকথিত সার্জিকাল স্ট্রাইক কবে হয়েছিল? ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯। অর্থাৎ বালাকোটের বিষয়ে খবর ৩ দিন আগেই ছিল অর্ণবের কাছে! কীভাবে? দেশের ‘টপ মিলিটারি সিক্রেট’ সাংবাদিকদের কাছে অগ্রিম প্রকাশ করা তো আইনত ‘দেশদ্রোহিতা’। সরকারের মধ্যে থেকে কে করলেন এই কাজ?
দুই, ভারতীয় জওয়ানদের উপর পুলওয়ামাতে যে ‘সন্ত্রাসবাদী হামলা’ হয়েছিল তার সাপেক্ষে নিজেদের চ্যানেলের গ্রাউন্ড কভারেজের শ্লাঘা বোঝাতে অর্ণব চ্যাটে লিখেছেন “This attack we have won like crazy।” অর্থাৎ পুলওয়ামার ‘সন্ত্রাসবাদী হামলা’য় দেশ যখন শোকস্তব্ধ তখন TRP আদায় করে উল্লাস প্রকাশ করছেন অর্ণব। আচ্ছা বলুন তো, ইনিই কি সেই অর্ণব গোস্বামী যিনি সবাইকে কথায় কথায় দেশদ্রোহী দাগিয়ে দেন?
তিন, ২০১৭-র ১৭ মে কথোপকথনের মাঝে অর্ণব লিখছেন, “All ministers with us”। আবার ১৬ অক্টোবর ২০১৯ পার্থ দাশগুপ্ত অর্ণবকে অনুরোধ করেছেন যে, “Please get me a job as Media Advisor with PMO”-র।
চার, এমনকি বিচার ব্যবস্থাকেও রেয়াত করেননি অর্ণব । চ্যাটের মধ্যে এক জায়গায় তিনি লিখেছেন “Buy the Judge”।
এছাড়াও লিক হওয়ার দীর্ঘ চ্যাটে দেখা যাচ্ছে, অর্ণব কখনও সংবাদ মাধ্যমের অন্য চ্যানেলের সঞ্চালকদের সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন, বারবার বিজেপি’র শীর্ষ নেতা মন্ত্রীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কথা বলেছেন।
এই ‘লিক’ চ্যাট ‘ফেক’ কিনা? আদালতে নিশ্চয় বিষয়টি আলোচনায় আসবে। কিন্তু তথ্য-প্রযুক্তির দিক থেকে বলা যেতে পারে যে, চ্যাটের সঙ্গে অ্যাটাচড টাইম ষ্ট্যাম্প এবং সেই অনুযায়ী বিষয়বস্তু অনুসারে ‘লিক’ চ্যাট ‘ফেক’ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
৫।
কিন্তু সামগ্রিকভাবে এই ঘটনায়, অর্ণব গোস্বামী নেহাত বোড়ে। রাজা মন্ত্রীটা কে? অর্থাৎ, অর্ণব দেশের মিলিটারি সিক্রেট অগ্রিম পেলেন কী করে? একজন সাংবাদিক হিসাবে তিনি ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার অজিত দোভালের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগ পান কী করে? সরকারের শীর্ষ মন্ত্রীদের সঙ্গে সাংবাদিক অর্ণবের গোপন যোগাযোগ থাকে কী করে? এমনকি ইনফরমেশন এবং ব্রডকাস্টিং মন্ত্রকের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী অর্ণবের নির্দেশে অভিযোগের ‘ফাইল’ দিনের পর ব্যবস্থা না নিয়ে ফেলে রাখেন কী করে? সত্যি কি তাহলে ভারতীয় বিচার ব্যবস্থায় আজকাল বিচারপতি কেনাবেচা হচ্ছে? বিচার কি প্রভাবিত হচ্ছে? হাজার প্রশ্ন উঠেছে এই চ্যাট সামনে আসার পরে।
আসলে, অর্ণবের ‘লিক’ চ্যাট যেন বর্তমান সময়ের ভারতের রাজনীতির আয়না। যে আয়নায় সামনে দাঁড়ালে দেখা যাচ্ছে ভঙ্গুর ভারতের গণতন্ত্রের কঙ্কালসার চিত্র। দেখা যাচ্ছে, সংবাদ মাধ্যমের এথিক্স, সরকারের দায়বদ্ধতা, মিলিটারি সিক্রেট, সন্ত্রাসবাদী হামলা, জওয়ানদের লাশ এবং সংবিধান অনুযায়ী নাগরিকদের মৌলিক অধিকার – সব কিছুই পণ্য হয়ে যাওয়ার চিত্রনাট্য। সৌজন্যে বিজেপি সরকার।
বোঝা যাচ্ছে ব্যবসার সহজ হিসাবটা! অর্ণব চ্যানেলে বসে প্রতিদিন নিষ্ঠার সাথে আপনাকে-আমাকে মানুষের জীবন-জীবিকার মূল সমস্যাগুলি থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে, হিন্দু-মুসলিম, পাকিস্তান কিম্বা উগ্র জাতীয়তাবাদের আফিমে মশগুল রাখবে, বকলমে সরকারের পিআর এজেন্সির মতো কাজ করবে, সরকারকে কঠিন প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকবে। আর বিনিময়ে ঐ চ্যানেল সরকারের কাছ থেকে অনৈতিক, বেআইনি সুবিধা পেয়ে নিজের চ্যানেলের আখের গোছাবে!
আমরা সংবাদমাধ্যমের ন্যক্কারজনক ভূমিকা বলতে, হিটলারের জার্মানির কথা বলি। গোয়েবলসের উদাহরণ দিয়ে থাকি। এই ‘লিক’ হওয়া চ্যাট যদি আদালতে সত্যি প্রমাণ হয়, তাহলে আধুনিক গণতন্ত্রের ইতিহাসে সংবাদমাধ্যমের ন্যক্কারজনক ভূমিকা বোঝাতে এই ঘটনা হিটলার জার্মানি গোয়েবলসের সঙ্গে একইরকম ঘৃণা নিয়েই উচ্চারিত হবে।