শুধু দলবদল নয়, মিডিয়ারও ফুল বদল
-
অতনু সাহা
- Jan 03, 2021 14:02 [IST]
- Last Update: Jan 03, 2021 13:21 [IST]
দলবদলের ধুম পড়েছে রাজ্যে। যা একসময়
তৃণমূল শুরু করেছিল ধুমধাম করে, এখন বিজেপি তাকেই
উদ্যাপন করছে মহাসমারোহে। সংবাদমাধ্যম ঘটা করে সেটাই তুলে ধরছে রাজ্য রাজনীতি
বলে।
সাধারণের দিন যাপনের যাবতীয় বিষয়
আপাতত শিকেয় তোলা থাক। মনোযোগ দিন নির্বাচনী বিনোদনে।
মিডিয়া সেই আয়োজন করছে তাদের সমস্ত
কৃৎকৌশল উজাড় করে। মহা দ্বৈরথ থেকে যেন চোখ সরে না যায় দু’চারটে অনর্থক প্রসঙ্গে।
যুযুধান দুই শিবির যখন টিভির পর্দা
জুড়ে তখন তৃণমূলের অফিসিয়াল ওয়েব পেজে মিলল দু’মিনিট কুড়ি সেকেন্ডের একটি ভিডিও।
নির্বাচনের আগে সেই ভিডিওতে তুলে ধরা
হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের তেইশ বছরের ‘লড়াকু’ ইতিহাস। সেই ইতিহাসে আছে
মহাকরণ অভিযান, আছে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, আছে ‘৩৪ বছরের বাম অপশাসন’। কিন্তু কোথাও বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার বিরুদ্ধে তৃণমূল
নেত্রীর কোনও কথা নেই, নেই বিজেপির
বিরুদ্ধে একটি শব্দও। নেই গুজরাটে দাঙ্গার প্রসঙ্গ। এটাই তো স্বাভাবিক। ‘বিজেপি
অচ্ছ্যুৎ নয়’ বলে যে মমতা ব্যানার্জির তৃণমূলের যাত্রা শুরু, এতদিনের পথ চলা, বেড়ে ওঠা-টিকে থাকা যাবতীয় কিছু, অন্য কথা থাকে কী করে?
বোঝাই যাচ্ছে রাজ্য রাজনীতির পরিসর
দুই মেরুতে সীমাবদ্ধ রাখার নির্মাণে মিডিয়ার ধারাভাষ্য কতটা জরুরি। বলাই বাহুল্য, দলবদলে নীতি-নৈতিকতার বিষয় কেউ তুলবে না, এ প্রসঙ্গ সংবাদমাধ্যমে গুরুত্বহীন। কারণ নেতা-নেত্রীর
দলবদলই একমাত্র বিষয় নয়, মিডিয়ারও ভোলবদল
ঘটছে অহরহ, সুবিধামত ফুলবদল করে নিচ্ছে এরাজ্যে
গণতন্ত্রের বহুবিজ্ঞাপিত চতুর্থ স্তম্ভ। এখানে সাংবাদিকরা তো নিমিত্ত মাত্র।
পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়ছে
এবং তা আরও বাড়বে। বরং বলা ভালো, নেতা-মন্ত্রীদের
দাপাদাপি বাড়ছে এবং তা আরও বাড়বে। এতদিন মমতা ব্যনার্জি ছিলেন, দিলীপ ঘোষ ছিলেন, ছোট বড় নেতারা ছিলেন, মন্ত্রীরা ছিলেন।
এখন অহরহ আসছেন অমিত শাহ। আদিবাসী ঘরে লাঞ্চ সারছেন, তা দেখে মুখ্যমন্ত্রীও গরিবপাড়ায়, খুন্তি হাতে, ছবিও হলো। এই
চিত্রনাট্যে এরপর যুক্ত হবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী। এমনটাই তাঁর
কর্মসূচির আগাম খবর। অতএব আগামী দু-পাঁচটা মাস রাজ্যবাসীর নিস্তার নেই। এমন
দ্বিপাক্ষিক তরজাই আপাতত সংবাদমাধ্যমের ‘জনপ্রিয় ঘণ্টাখানেক’।
তাহলে দেশ এবং রাজ্যের রাজনৈতিক
চালচিত্র কি এইটুকুই?
২০২০ যখন আমরা শুরু করেছিলাম তখন
ঠান্ডায় রাত জাগছিল দিল্লি নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতায়। দেশজুড়ে প্রতিবাদের
কণ্ঠস্বর জাগিয়ে তুলছিল অন্য এক ভারতকে। মাঝখানে অতিমারীর করাল গ্রাস জীবন-জীবিকার
সব কিছু লন্ডভন্ড করে দিলেও শাসকের স্বৈরাচার কিন্তু থামেনি। এবার নতুন বছর যখন
আমরা শুরু করেছি তখন দিল্লির রাস্তা আটকে, জান বাজি রেখে রাত জাগছেন কৃষকরা। গোটা দেশ উত্তাল হচ্ছে সংহতিতে— কৃষি আইন
ফেরত নাও।
মিডিয়ার প্রচার প্যাকেজে এতে
বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।
বরং মিডিয়ার আলোয় এরাজ্যে দুর্নীতি, ঘুষ খাওয়ার দৃশ্য এখন দলবদলের পুঁজিতে পরিণত হয়েছে।
দুর্নীতিই দলবদলের ভিত্তি। কয়লা পাচারে তল্লাশি হওয়ার মুহূর্তেই মুখ্যমন্ত্রীর ‘সৌজন্যমূলক’ ফোন যায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর
পুত্রের কাছে। মুখ্যমন্ত্রীর ছবিকাণ্ডের তদন্ত যখন গতি পায় তখন দিল্লিতে
প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর সঙ্গে ‘সৌজন্য
সাক্ষাৎ’ করেন আরএসএসের ‘দুর্গা’ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। বেমালুম বদলি হতে হয় ছবি
বিক্রির তদন্তে যুক্ত সিবিআই আধিকারিককে। শুভেন্দু অধিকারীর দুর্নীতির মামলায়
সিবিআই’র আইনি প্রক্রিয়া আবেদন মাসের পর মাস ফেলে রাখে মোদী সরকার। দুর্নীতির ফাইল
চেপে এখন ‘ফসল’ ঘরে তুলেছে বিজেপি, ফুল বদলেছেন শুভেন্দু অধিকারী। গত ছয় বছর ধরে চিট ফান্ডকাণ্ডের তদন্তের
পরিকল্পিত শ্লথতা, তদন্তের
বিশ্বাসযোগ্যতায় যে প্রশ্ন উঠেছে, তা আসলে
দুর্নীতিবাজদেরই বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা।
যে অনৈতিক আগ্রাসন তৃণমূল একসময়
শুরু করেছিল তা আরও বিপুল পরাক্রমে ক্ষমতা দেখাচ্ছে বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গে
সাম্প্রদায়িক উসকানিকে তৃণমূল রাজনৈতিক চেহারা দিয়েছিল, বিজেপি আরও হিংস্র চেহারা বেআব্রু করে দেখাচ্ছে।
সাম্প্রদায়িকতা সবসময়ই এদের কাছে বড় হাতিয়ার। এরাজ্যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি আগে
দাঁত ফোটাতে পারতো না। তৃণমূল সুবর্ণসুযোগ করে দিয়েছে। গত এক দশকে সেই সুযোগ
ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। দুই দলই নির্বাচনের এই মরশুমে ভেদাভেদের রজনীতিতে উঠেপড়ে
লাগবে এই মহাসত্যটি এখনই বোঝা যাচ্ছে। দুই বিপরীত শিবিরের সাম্প্রদায়িকতা কীভাবে
একে অপরের শক্তি বৃদ্ধি করতে পারে বেশ কয়েক বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গ মর্মে মর্মে টের
পাচ্ছে। এরসঙ্গে রয়েছে টাকার খেলা। তোলাবাজি, দুর্নীতি, জবরদখলের পর তৃণমূল বলছে ‘পাড়ায়
সমাধান’,
দাঙ্গা, কর্পোরেট
তোলাবাজির রেকর্ড করা বিজেপির স্লোগান ‘আর নয় আন্যায়’। এ এক চমকপ্রদ সমাপতন।
বোঝাই যাচ্ছে জল ঘোলা করার তৎপরতা
শুরু হয়ে গেছে। এবং ভোট যত এগিয়ে আসবে, সেই তৎপরতা ততই বাড়তে থাকবে। সেখানে বিদ্বেষ থাকবে, টাকার খেলা থাকবে, সাধারণের জন্য কিছু প্রসাধনী প্রলোভনও থাকবে।
যেমন শীতের এই মরশুমে দুটি পরিযায়ী
প্রকল্প বেশ জমে উঠেছে। ‘দুয়ারে সরকার’ নামে হাটে-মাঠে সরকারি তাঁবু ফেলছে তৃণমূল।
আর কর্মসংস্থানের নাম করে কার্ড বিলি করছে বিজেপি। দুই পক্ষেই সরকার, অতএব সাধারণ মানুষের পক্ষে, কিছু হবে না জেনেও এড়িয়ে যাবার রাস্তা নেই।
নির্বাচন মানে দুই শিবিরের
নেতা-নেত্রীর অগুন্তি প্রতিশ্রুতি, যা স্বাভাবিক নিয়মে দাঁড়িয়েছে। শেষ অবধি তাঁরা যে সেই সেই প্রতিশ্রুতি রাখবেন
না,
তাও স্বাভাবিক বিষয় হয়ে গেছে। মানুষ জানেন এসবই নির্বাচনের
অঙ্গ,
নির্বাচনী তরজা মাত্র, স্রেফ কথার কথা। কেইবা প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে জানতে চাইবেন, বছরে এক কোটি কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি কোথায় গেল? কিংবা ব্যাঙ্কে পনেরো লক্ষ টাকা? মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও বহুবার বহুভাবে বহু লক্ষ
কর্মসংস্থানের কথা বলেছেন, প্রতিশ্রুতির পর
প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। যেখানে যেমন পারেন বলেছেন। কোথায় গেল সেসব গালভরা কথা? এযাবৎ নির্বাচনের আগে বিজেপি যে প্রতিশ্রুতিগুলি দিয়েছিল,কার্যত তার কোনটাই বাস্তবায়িত হয়নি। তৃণমূলের ক্ষেত্রেও
তাই। যে প্রশ্নটাই ছিল স্বাভাবিক, সংবাদমাধ্যমের
কাছে তা এখন মামুলি প্রসঙ্গ।
ফলে এই নির্বাচনের আগে নতুন প্রতিশ্রুতিগুলি
যেমনভাবেই আলোকিত করা হোক না কেন, এটা মনে করার কোনও কারণ নেই যে রাজ্যবাসীর বহু সঙ্কটের প্রত্যাশিত মীমাংসা
এবার বেরিয়ে আসবে। বরং ঠিক উলটো, এতদিন আপনার আমার
উত্থাপিত যাবতীয় দাবি, রাস্তায় দাঁড়িয়ে
লড়াই বেমালুম লোপাট করে দেবার আয়োজন চলছে। সাধারণের কাছে পৌঁছাবে অমোঘ সব বাণী, মন্ত্রমুগ্ধের মতো মানুষ শুনবেন, তারই আয়োজন বিস্তৃত হচ্ছে সুনিপুণ দক্ষতায়।
আরও পাঁচটা রাজ্যের সাথে কয়েক মাসের
মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন। এই নির্বাচন শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়, প্রশ্নাতীতভাবেই জীবন-জীবিকার সামনেও চ্যালেঞ্জ। নির্বাচন
ঘিরে চ্যালেঞ্জ আগেও ছিল, কিন্তু নানা কারণে
এ-বারের পরিস্থিতি অভূতপূর্ব এবং জটিল। ইতিমধ্যেই ভোটের তুফান উঠতে শুরু করেছে।
কিন্তু দিনে-রাতে যেকোন সময়ে সংবাদ
চ্যানেল দেখুন, সংবাদপত্র খুলুন, জানতেই পারবেন না
বেঁচে থাকার দাবি নিয়ে কত শত মানুষ প্রতিদিন কত জায়গায় সোচ্চার হচ্ছেন।
অনিবার্যভাবেই লড়াই একটা চলছে।
অতিমারীর নিদারুণ দিনগুলিতে, কাজ হারানো অসহায়
জীবনযাপনে, আমফানে বিধ্বস্ত হবার পরেও যে লড়াই
থামেনি। বরং গতি পেয়েছে। দুই সরকারের অপরিমেয় ঔদ্ধত্য সত্ত্বেও তা চলমান। এ’লড়াইয়ে
সাড়া দিয়ে সাধারণ মানুষ পথে নামছেন। সাড়া যে মিলছে, এই ভরসা যাতে ছড়িয়ে না যায় তার জন্য বাড়তি উদ্যোগ মিডিয়ায়।
কিন্তু তাসত্বেও এই লড়াইয়ের উদ্যাপন
যদি নির্বাচনী যুদ্ধে উঠে আসে, তা হলে অনেকের
অনেক হিসাব পালটে যেতে পারে। নির্বাচনের প্রস্তুতি, তার প্রচার, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, সংগঠন, মানুষের কাছে যাওয়া
এবং তাদের সঙ্গে কথোপকথন এসব ক্রমশ প্রত্যয় বাড়াচ্ছে। তার বহু নজির আমরা দেখেছি
পথেঘাটে,
এমনকি সাধারণ সামাজিক মাধ্যমে মানুষের দাবিদাওয়ার মধ্যে।
অতিমারীর সঙ্কটে মানুষের পাশে থাকার অদম্য জেদ কম মূল্যবান নয়। মানুষের আলোচনায়
অবধারিতভাবেই আছে বাপন্থীদের কথা। বাম-কংগ্রেস, গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের একসাথে নামার ঘোষণাও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দুই
মেরুর বাইরে বিকল্পের কথা সংবাদমাধ্যম এড়িয়ে যেতে পারে, পাড়ায় পাড়ায়, ঘরোয়া আলোচনায় কিন্তু থেমে থাকছে না। এটাও কম বড় ভরসার কথা নয়।
সংবাদমাধ্যমে এ লড়াই দেখতে পাবার
আশা করে কোনও লাভ নেই। উলটে নির্বাচনী রাজনীতিকে অনায়াসে যাতে চোরাবালি গ্রাস করে
সেই উদ্যোগ দেখতে পাবেন, ইতিমধ্যে তা দেখাও
যাচ্ছে। মিডিয়ার মহার্ঘ প্রচারে জনজীবনের দাবি হাতড়াবার কোনও কারণ নেই, পরিচিত মুখ খুঁজতে যাবারও দরকার নেই। বরং সাধারণ মনুষের
সমবেত উচ্চারণে জীবন-জীবিকার দাবিকে সামনে আনাটাই এখন প্রথম ও প্রধান রাজনৈতিক
কর্মসূচি। তা হয়তো মিডিয়ায় নেই, কিন্তু রাজ্যব্যপী
রাজনৈতিক আলোচনায় জড়িয়ে আছে।
তাই প্রচারে নিজস্ব মুনশিয়ানা
ঘটাতেই হবে। এটা আমাদের অভিজ্ঞতাই বলছে প্রচার মাধ্যম এখন আক্ষরিক অর্থেই ফাঁদ
পেতে রেখেছে। বিশেষত ফেক নিউজ, বিদ্বেষের বিষ
ছড়িয়ে দেওয়া। পশ্চিমবঙ্গ বিদ্বেষী প্রচারে ধ্বস্তহতে আগেও দেখেছে, এবারে রেহাই মিলবে এমনটা আশা করা যায় না। অতএব সাবধান তো
হতেই হবে।
সংবাদমাধ্যমের যে প্রশ্নে অনীহা, মানুষের সে কথা তুলে ধরতেই আমরা গণশক্তির কর্মীরা
বদ্ধপরিকর।
এই প্রেক্ষিতেই গণশক্তি।
৫৪ বছর আগে ১৯৬৭ সালের ৩ জানুয়ারি সাধারণ মানুষের জীবন যুদ্ধের কথা তুলে ধরার যে
লক্ষ্য নিয়ে গণশক্তির পথ চলা শুরু, সে লক্ষ্য আজও অপরিবর্তিত। প্রতিকূলতা পেরিয়েই
প্রতিদিনের গণশক্তি। পাঠক, শুভানুধ্যায়ী, লড়াইয়ে থাকা মানুষের সমর্থন ও সাহচর্য সাহস জোগাচ্ছে গণশক্তিকে।