‘ফৌজদারি মামলা প্রত্যাহার জঘন্যতম অপরাধ’, রাজ্যকে ভর্ৎসনা হাইকোর্টের
-
নিজস্ব প্রতিনিধি
- Mar 04, 2021 09:26 [IST]
- Last Update: Mar 04, 2021 09:26 [IST]
কলকাতা, ৩ মার্চ— খুনের মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় রাজ্য সরকারকে ভৎর্সনা করল কলকাতা হাইকোর্ট। বুধবার আদালত স্পষ্ট ভাষায় বলেছে, ফৌজদারি মামলা প্রত্যাহার করা জঘন্যতম অপরাধ।
বিধানসভা নির্বাচনের আগে রাজ্য সরকার বিভিন্ন মামলা তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। এই মামলাগুলির মধ্যে রয়েছে বহু ফৌজদারি অপরাধের মামলা। ২০০৭ সালের পর থেকে নন্দীগ্রামে খুন, সন্ত্রাস, লুটতরাজের অভিযোগে তৃণমূল কংগ্রেস কর্মীদের বিরুদ্ধে বহু মামলা রয়েছে। সেই সমস্ত মামলা প্রত্যাহারের জন্য বুধবার কলকাতা হাইকোর্টে দু’টি আবেদন জমা পড়ে। সেই আবেদনগুলি দেখেই কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি টিবি রাধাকৃষ্ণানের ডিভিসন বেঞ্চ রাজ্য সরকারকে ভর্ৎসনা করে মন্তব্য করে, ফৌজদারি মামলা প্রত্যাহার জঘন্যতম অপরাধ। আগামী শুক্রবার মামলাটি শুনানির জন্য রাখা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি নন্দীগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্রে প্রার্থী হবেন বলে জানিয়েছেন। ফলে নন্দীগ্রামে ভোটের কাজে তৃণমূল কর্মীদের নামানোর চেষ্টা রয়েছে। এমনকী যে সমস্ত তৃণমূল কর্মী খুনের মামলার সঙ্গে জড়িত, তাদেরও ভোটের কাজে দরকার বলে তৃণমূল মনে করছে। তাই যাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের মামলা রয়েছে, যারা জেলে রয়েছে, তাদের সকলকেই মুক্ত করার চেষ্টা চলছে।
ঠিক এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে দার্জিলিঙে। বিমল গুরুঙ সহ তাঁর সহকর্মীদের মামলা থেকে মুক্ত করা হয়েছে। বিমল গুরুঙের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা ছিল। রাজ্য সরকার সেই সব মামলাই প্রত্যাহার করে নিয়েছে। পাঁশকুড়ার বিজেপি নেতা আনিসুর রহমান জেলে বসে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেওয়ায় তার বিরুদ্ধে থাকা খুনের মামলাও প্রত্যাহার করে নিয়েছিল রাজ্য সরকার। তবে এক্ষেত্রে বাধ সেধেছে কলকাতা হাইকোর্ট। গত মঙ্গলবার কলকাতা হাইকোর্ট বলেছে, আনিসুর রহমানকে ছাড়া যাবে না।
এদিকে আনিসুর রহমানের মামলায় কলকাতা হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে বুধবার ডিভিসন বেঞ্চে আপিল মামলা দায়ের করেছেন আনিসুরের আইনজীবীরা। আগামী সোমবার মামলার শুনানি হওয়ার সম্ভাবনা। ২৬ ফেব্রুয়ারি বিজেপি নেতা আনিসুর রহমানের বিরুদ্ধে চলা কুরবান শাহ খুনের মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রাজ্য সরকার। সেই অনুযায়ী বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পাশাপাশি গত সোমবার পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুক দায়রা আদালতে আনিসুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের আবেদন জানায় রাজ্য সরকার।
তাতে সম্মতিও দেয় তমলুক দায়রা আদালত। এরপরেই জরুরি ভিত্তিতে কুরবান শাহর পরিবার কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়। বিচারপতি সব্যসাচী ভট্টাচার্য সব পক্ষের বক্তব্য শোনার পর গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাজ্য সরকারের বিজ্ঞপ্তি এবং তমলুক দায়রা আদালতের নির্দেশ খারিজ করে দেন। কীসের ভিত্তিতে বিচারপতি সব্যসাচী ভট্টাচার্য রাজ্যের বিজ্ঞপ্তি এবং তমলুক আদালতের নির্দেশের উপর স্থগিতাদেশ জারি করলেন, বুধবার সেই প্রশ্ন তুলেই আপিল করেন আনিসুর রহমানের পক্ষের আইনজীবীরা।
এই মামলায় প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানানো হয়, আত্মপক্ষ সমর্থনে আনিসুর রহমানের বক্তব্য শোনা হয়নি এবং তমলুক আদালতের নির্দেশনামা বিচারপতি সব্যসাচী ভট্টাচার্য দেখেননি। ফলে এই মামলার পুনরায় শুনানি হোক।
প্রসঙ্গত, একসময়ে তৃণমূলে থাকা আনিসুর রহমান যোগ দিয়েছিলেন বিজেপি’তে। পাঁশকুড়ার তৃণমূল নেতা কুরবান শাহ খুনে অভিযুক্তদের তালিকায় রয়েছে তার নাম। এরপরেই আনিসুরকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিছু দিন ধরে আবার আনিসুর রহমানের তৃণমূলে যোগ দেওয়া নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছিল। এরপরেই রাজ্য সরকার তাঁর বিরুদ্ধে চলা মামলা প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেয়। মঙ্গলবার জরুরি ভিত্তিতে কুরবান শাহের ভাগ্নে জহর শাহ কলকাতা হাইকোর্টে আবেদন জানিয়ে আবেদন করেন, যাতে আনিসুর রহমানের বিরুদ্ধে চলা মামলা প্রত্যাহারের আবেদন খারিজ করা হয়।
মামলাকারীর তরফে আইনজীবী রাজদীপ মজুমদার জানান, ‘‘রাজ্য সরকার কখনো পাবলিক প্রসিকিউটরকে দিয়ে মামলা প্রত্যাহার করার জন্য বলতে পারে না। আনিসুর রহমান একজন ঘৃণ্য অপরাধী। তাঁকে এইভাবে ছেড়ে দিতে পারে না রাজ্য সরকার।’’
তমলুক দায়রা আদালত রাজ্যের আবেদন গ্রহণ করে আনিসুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের পক্ষে রায় দিয়েছিল। কিন্তু সব পক্ষের বক্তব্য শোনার পর কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি সব্যসাচী ভট্টাচার্য নির্দেশ দেন, রাজ্য সরকার ২৬ ফেব্রুয়ারি যে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল, সেই বিজ্ঞপ্তিকে খারিজ করা হচ্ছে। পাশাপাশি দায়রা আদালত যে নির্দেশ দিয়েছিল, তাও এখন কার্যকরী হবে না। বিচারপতি ভট্টাচার্য তাঁর নির্দেশে আরও বলেছিলেন, আনিসুর জেল থেকে ছাড়া পেলে তাকে ফের গ্রেপ্তার করতে হবে। মঙ্গলবার আদালতের নির্দেশ মতো কোলাঘাট থেকে পুলিশ পুনরায় আনিসুরকে গ্রেপ্তার করে। সিঙ্গল বেঞ্চের এই নির্দেশের বিরুদ্ধেই বুধবার ডিভিসন বেঞ্চে আপিল করেছেন আনিসুর রহমান।
প্রসঙ্গত, আনিসুরের নামে যে মামলা চলছে, তা প্রত্যাহার করার জন্য গত ২৬ ফেব্রুয়ারি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল রাজ্য সরকার। সেই বিজ্ঞপ্তি সোমবার তমলুক দায়রা আদালতে জমা দিয়েছিলেন সরকারি আইনজীবী। মঙ্গলবার তমলুক দায়রা আদালতের বিচারক রাজ্য সরকারের সেই আবেদন গ্রহণ করেন। কলকাতা হাইকোর্ট তা খারিজ করতেই আবার আনিসুরকে ধরে পুলিশ। এরপরই হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চের রায়ের বিরুদ্ধে ডিভিসন বেঞ্চে আপিল করেন আনিসুর রহমান। মঙ্গলবার বিচারপতি সব্যসাচী ভট্টাচার্য নির্দেশে জানিয়েছিলেন, গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাজ্য সরকার যে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল, তা কার্যকরী থাকছে না। কারণ, একসময়ে রাজ্য সরকারই এই আনিসুর রহমানের জামিনের আবেদনের বিরোধিতা করেছিল। এখন হঠাৎ করে কী এমন হলো যে, দ্রুত তাঁর বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারে সায় দিচ্ছে রাজ্য। মঙ্গলবার এই প্রশ্ন তুলেই দায়রা আদালতের নির্দেশকে নাকচ করেছিল কলকাতা হাইকোর্ট। তমলুক আদালতে আইনের অপব্যবহার নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিচারপতি। তিনি বলেছিলেন, সরকারি আইনজীবী জনস্বার্থে এই ধরনের আবেদন দায়রা আদালতে করতেই পারেন। কিন্তু তাঁর কাজ যেন রাজ্যের এক জন শুধুমাত্র সরকারি এজেন্টের মতো না হয়। প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে পাঁশকুড়ায় কুরবান শাহ খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়েছিল বিজেপি নেতা আনিসুর রহমান।