Narendra Modi

মোদীর ১১বছর কার সঙ্গে কার উন্নয়ন

বিশেষ বিভাগ ফিচার পাতা

২০১৪-তে নির্বাচনী ইশ্‌তেহারে বিজেপি’র ঘোষণা ছিল তাদের সরকারের একমাত্র দর্শন হবে —  ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’। কী হয়েছে?
ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ল্যাবের তথ্য অনুযায়ী ভারতে বর্তমান আর্থিক বৈষম্যের পরিমাণ স্বাধীনতা পূর্ব ১৯২২ সালের পরবর্তী সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছে। দেশের এক শতাংশ ধনীরা স্বাধীনতার সময় জাতীয় আয়ের ১৩ শতাংশের অধিকারী ছিল যা এখন বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ২২.৬ শতাংশ। দেশের সর্বোচ্চ ধনী দশ হাজার মানুষের আয়, ভারতীয়দের গড় আয়ের ২০৬৯ গুণ। 
ডলারের মানদণ্ডে ভারতে বিলিয়নেয়ার আছেন ২১৭ জন। সম্পদ বৃদ্ধির তালিকার একেবারে শীর্ষে যথারীতি রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর অতি ঘনিষ্ঠ দুই শিল্পপতি মুকেশ আম্বানি এবং গৌতম আদানি। মহামারীর দুঃসময়েও মুকেশের সম্পদ বেড়েছে ২৪শতাংশ। ফোর্বস-এর হিসাবে ২০২৪-এর ১০ ডিসেম্বর বিলিয়নেয়ারদের মোট সম্পদমূল্য ছিল প্রায় ১০৪১ বিলিয়ন ডলার। ইতিমধ্যে তা আরও বেড়েছে। অন্যদিকে ভারতের কৃষিখাতের বাজেট ১৭.৯১ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ তার প্রায় ৫৮ গুণ হবে বিলিয়নেয়ারদের সম্পদ। দেশের গোটা বাজেট ৫৬২ বিলিয়ন ডলারের। তারও বেশি, প্রায় ১.৮ গুণ বিলিনেয়ারদের সম্পদ। অর্থাৎ দেশের ২১৭ জন ব্যক্তির (জনসংখ্যার ০.০০০০১৫ শতাংশ) হাতে জমা হয়েছে জাতীয় মোট আয় বা জিডিপি’র প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সম্পদ।
মোদীর শাসনের দর্শন—  ‘বিলিয়নেয়ার ফার্স্ট’।
----------------------------------------------
২০১৪-তে নির্বাচনী ইশ্‌তেহারে বিজেপি’র ঘোষণা ছিল তাদের সরকারের একমাত্র প্রার্থনা হবে—  মানুষের কল্যাণ। কী হয়েছে?
আমাদের দেশে বর্তমানে স্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ জাতীয় গড় আয়ের ১ শতাংশের আশেপাশে, যা হওয়া উচিত ৫ শতাংশ। কেন্দ্রীয় সরকার নিযুক্ত শ্রীনাথ রেড্ডি কমিশনের সুপারিশ ছিল ২০২৫ সালের মধ্যে ওই বরাদ্দ ৩.৫ শতাংশে নিয়ে আসা ও স্বাস্থ্য বজেট বরাদ্দের ৭০ শতাংশ অর্থ প্রাথমিক স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় করা। তা হয়নি। ক্ষুধার সূচকে ১২৫টি দেশের মধ্যে আমাদের স্থান ১০৫। দারিদ্রসূচকে ১৩৪, লিঙ্গ সাম্যের নিরিখে ১৪৬ টি দেশের মধ্যে আমাদের স্থান ১৩৫তম।
মোদী সরকার ধনীদের কল্যাণ ছাড়া আর কোনও প্রার্থনা করেনি।
------------------------------------

২০১৪-তে নির্বাচনী ইশ্‌তেহারে বিজেপি’র ঘোষণা ছিল তাদের সরকারের একমাত্র শক্তি হবে—  মানুষের শক্তি। কী হয়েছে?
২০২২-এর মধ্যে সব গ্রামীণ পরিবারের পাকা ঘর হওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল। লক্ষ্যমাত্রা ৪ কোটি ৪ লক্ষ ৪৬ হাজার ৫৫৪টি বাড়ি। হয়েছে ৬৮%। 
২০২৪-২৫ সালে ঘরে ঘরে পানীয় জল পৌঁছে দেওয়ার জন্য ‘জল জীবন মিশন’ প্রকল্পে বরাদ্দ হয়েছিল ৬৭,০০০ কোটি টাকা। কিন্তু খরচ হয়েছে  ২২,৬৯৪ কোটি টাকা।
‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’ প্রকল্পে বরাদ্দ ১২,১৯২ কোটি টাকা, যা ২০২২ সালের বাজেটের পর অপরিবর্তিত। ফলে ১৬ শতাংশ বাড়িতে শৌচাগার নেই, ৪০ শতাংশ গ্রামের মানুষ পরিস্রুত পানীয় জলের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। ৬০ শতাংশ গ্রামের মানুষের বর্জ্য নিষ্কাশনের সুবিধা নেই। 
জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা-৫ অনুযায়ী ৬-৯ মাস বয়সি শিশুদের ক্ষেত্রে রক্তাল্পতার হার ৫৮.৬ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৭.১ শতাংশ আর ১৫-১৯ মাস বয়সিদের ক্ষেত্রে ৫৩.১ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৫৭.০ শতাংশ। ৫ বছরের কম বয়সি শিশুদের ৩২.১ শতাংশ অপুষ্টিতে ভুগছে, বয়সের তুলনায় কম উচ্চতা অর্থাৎ খর্বকায় শিশু ৩৫.৫ শতাংশ, গুরুতর অপুষ্টি আক্রান্ত ৭.৭ শতাংশ। 
-----------------------------------------------
রুগ্‌ণ হয়েছে রেগা
২০২৪-২৫ সালে রেগায় জব কার্ডের নথিভুক্ত পরিবারের সংখ্যার হার ৮.৫ শতাংশ হারে বেড়েছে।  অন্যদিকে এই একই সময়ে নতুন কর্মসংস্থানের হার কমেছে ৭.১ শতাংশ। গড়ে পরিবার পিছু কর্মসংস্থানের হার কমেছে ৪.৩ শতাংশ। নথিভুক্ত পরিবারের ৭ শতাংশের ১০০ দিন কাজ মেলে। বাকি কারো এখন ১০০ দিন কাজ মেলে না।
রেগার গত তিন বছরে ৫.৯ কোটি জব কার্ড বাতিল হয়েছে। নতুন জব কার্ড বিলি হয়েছ ১.১৬ কোটি। স্বাভাবিকভাবে ৪ কোটি জব কার্ড গ্রাহক রেগায় কাজের সুযোগ হারিয়েছে। রেগা জব কার্ড বাতিল হওয়ায় রেগায় কর্মদিবস কমে গিয়েছে। যেমন ২০২৩-২৪ সালে রেগায় ২৮৯ কর্মদিবস তৈরি হয়। ২০২৪-২৫ সালে তা কমে হয় ২৬৮ কোটি কর্মদিবস। পরিবারের গড় কাজ ৫৩ দিন থেকে কমে হয়েছে ৫০ দিন। রেগায় কেন্দ্রীয় বরাদ্দ পাঁচ বছরে কমেছে ১৫ হাজার কোটি টাকার উপর। যেমন  ২০২০-২১ সালে রেগায় বরাদ্দ ছিল ১ লক্ষ ৯ হাজার ৮১০ কোটি টাকা তা ২০২৪-২৫ সালে কমে হয়েছে ৮৫ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা। গত বছর থেকে রেগায় কাজের চাহিদা ৮.৯ শতাংশ হারে বাড়লেও দেখা গেল বরাদ্দ ১৫ শতাংশ হারে কমে গেছে।
---------------------------------------
বছরে ২কোটি চাকরি—  কোথায়?
এখন দেশে বেকারির হার ৭.৯শতাংশ। এই হিসাব ২০২৫-এর মার্চের। ২০১৪-তে কেন্দ্রের তখতে বসার আগে বিজেপি’র ঘোষণা ছিল বছরে দু’কোটি কাজের বন্দোবস্ত করবে তারা। ২০১৯-এ এমন কিছু তারা বলেনি। তাঁর আমলে দেশে বেকারি কমেছে বলে নরেন্দ্র মোদী বারবার দাবি করেছেন। কিন্তু ২০১৪ থেকে ২০২৫— এই ১১ বছরে দেশে বেকারত্বের হার সর্বাধিক বেড়েছিল ২০২৩ সালে। আর ২০২৩-এ দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মোদীই। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি (সিএমআইই)-র পর্যালোচনা এমনই জানাচ্ছে। গত ১১টি  বছরে বেকারত্বের হার ছিল যথাক্রমে  ৫.৪২%, ৫.৪৪%, ৫.৪২%, ৫.৩৬%, ৫.৫৩%, ৫.৩৭%, ৮.০০% (২০২০), ৫.৯৮%, ৭.৩৮%, ৮.৭%(২০২৩), ৪.৯%(২০২৪), ৭.৯(২০২৫)।
ইনস্টিটিউট ফর হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন যৌথভাবে প্রকাশিত ইন্ডিয়া এমপ্লয়মেন্ট রিপোর্ট ২০২৪ অনুসারে, কর্মক্ষম ভারতবাসী ২০১১-তে ছিলেন জনসংখ্যার ৬১ শতাংশ। যা বেড়ে ২০২-এই হয়েছে ৬৪ শতাংশ। ২০৩৬-এ তা ৬৫ শতাংশে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর অর্থ ১৮-৬০ বছর বয়সি যারা কাজ করতে সক্ষম তারাই মোট জনসংখ্যার ৬৪ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন মন্ত্রকের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গ্রামীণ এলাকায় শ্রমশক্তি অংশগ্রহণের হার ২০১৭-১৮ সালে ৫০.৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২৩-২৪ সালে ৬৩.৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যেখানে শহরাঞ্চলের ক্ষেত্রে এটি ৪৭.৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫২.০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
-------------------------------------------
যত মার রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে
রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় বিপুল স্থায়ী চাকরি কমানো হয়েছে। উদাহরণ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোর সম্মিলিত কর্মীসংখ্যা হ্রাস পেয়ে ২০২৪ অর্থবর্ষে ৭,৪৬,০০০-এ নেমে এসেছে। যা আগের বছরে ছিল ৭,৫৬,০০০ এবং ২০১৪-১৫ সালে ছিল ৮,৫৯,০০০। দৃষ্টান্ত বিএসএনএল-ও। সেখানে স্থায়ী কর্মীকে স্বেচ্ছা অবসর প্রকল্প ধরিয়ে প্রায় ১ লক্ষ ৮২ হাজার স্থায়ী চাকরি বিলোপ ঘটানো হয়েছে। সেইলে একইভাবে কমানো হয়েছে ৬২ হাজার চাকরি, এমটিএনএল’এ ২৮হাজার ১৪০ চাকরি, এফসিআই’তে ২৮ হাজার চাকরি এবং ওএনজিসি’তে ২১ হাজার চাকরি। প্রতিবছর ঢালাও স্থায়ী চাকরি কমিয়ে মোদীর বছরে ২কোটি নতুন চাকরি প্রতিশ্রুতি কোথায় গেল বলে প্রশ্ন উঠেছে।
সরকারি হিসাবে বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে শূন্যপদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯.৬৪ লক্ষ। কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদিত পদের সংখ্যা ৩৯.৭৭ লক্ষ। তাতে কর্মরত কর্মীর সংখ্যা হলো ৩০.১২ লক্ষ। ভোটের মুখে মোদীর রোজগার মেলায় নিয়োগপত্র বিলির ধুম উঠলেও তাতে শূন্যপদের সংখ্যা কমার কোনও লক্ষণ দেখা যায়নি।
-------------------------------------------------------

কৃষকদের আয় দ্বিগুণ হলো? 
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করেছিলেন, ২০২২-এর মধ্যে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ হবে। ২০১৮-১৯-এর পরে দেশের কৃষকদের আয়ের তথ্য সরকারিভাবে প্রকাশই করেনি কেন্দ্রীয় সরকার।
২০২৩-এর পরিসংখ্যান এখনও নরেন্দ্র মোদীর সরকার প্রকাশ করেনি। শুধু ২০২২ সালে আত্মহত্যা করেছেন কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত মোট ১১,২৯০ জন। জাতীয় অপরাধ নথিবদ্ধকরণ ব্যুরো কিংবা এনসিআরবি’র তথ্য তেমনই। এর মানে প্রতিদিন প্রায় ৩০ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন, প্রতি ঘণ্টায় একের কিছু বেশি। ২০২২ সালের সংখ্যাটি আগের বছরগুলির তুলনায় অনেকটাই বেশি ছিল। ২০২১-এ আত্মহত্যার সংখ্যা ছিল ১০,৮৮১, ২০২০-সালে ১০,৬৭৭ এবং ২০১৯ সালে ১০,২৮১।
লাভ হলে কৃষকরা আত্মহত্যা করবেন কেন? পশ্চিমবঙ্গ সহ দেশজুড়ে কৃষকরা সঙ্কটে। মোদী-শাসনে কৃষিক্ষেত্রের দখল নিচ্ছে কর্পোরেটরা। যে পদ্ধতিতে এই কর্পোরেটকরণ ঘটছে তার বর্ণনা অধ্যাপক কে নাগরাজ দিয়েছেন পাঁচটি শব্দে—  ‘ভারতের গ্রামাঞ্চলের সর্বগ্রাসী বাণিজ্যিকীকরণ প্রক্রিয়া’।
--------------------------------------------------

এসেছে শ্রম কোড:
শ্রমকোডের প্রভাবগুলি কেমন?  
শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ও বোনাস প্রদানের বাধ্যবাধকতা ছিল এতদিন। একে নতুন কোডে মালিকদের ইচ্ছাধীন করা হয়েছে, ফলে ন্যায্য মজুরি পাওয়া কঠিন হবে।
আগের আইনে শ্রমিকদের ধর্মঘট করার অধিকার ছিল। এখন ধর্মঘটের আগে ৬০ দিনের নোটিস বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যা কার্যত ধর্মঘটের অধিকার খর্ব করবে।
১০০ জনের বেশি কর্মী থাকলে ছাঁটাইয়ের আগে সরকারের অনুমতি লাগত। নতুন ব্যবস্থায় এই সংখ্যা বাড়িয়ে ৩০০ জন করা হয়েছে। অর্থাৎ দেশের বেশিরভাগ কারখানাতেই কর্মী ছাঁটাইয়ে আর কোনও সরকারি অনুমতি লাগবে না, যার ফলে বিশাল সংখ্যক শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঝুঁকিতে পড়বেন।
পেনশন, ইএসআই ও গ্র্যাচুইটি বাধ্যতামূলক ছিল এতদিন। মালিকদের হাতে এখন এটা নির্ধারণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, ফলে শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা ঝুঁকির মুখে পড়বে।
৮ঘণ্টা কাজের সময় ও কাজের নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল পুরানো আইনে। এখন ১২ঘণ্টা কাজের পথ খোলা হয়েছে, যা শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও জীবনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
পুরানো শ্রম আইনে শ্রমিক বলতে কারখানা, খনি, পরিবহণ, নির্মাণ, পরিষেবা, কৃষি সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করা সকল কর্মীকেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। নতুন শ্রমকোডে শ্রমিকের সংজ্ঞাকে সীমিত করা হয়েছে। যদি কোনও কর্মচারীর মাসিক মজুরি ১৮,০০০ টাকার বেশি হয়, তবে তাকে ‘শ্রমিক’ হিসাবে গণ্য না করে, তাকে ‘সুপারভাইজার’ হিসাবে চিহ্নিত করা হতে পারে। এর ফলে তারা শ্রম আইনের সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হবেন। 
নতুন শ্রমকোড অনুযায়ী দৈনিক কাজের সময় ১২ঘণ্টা পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে, ফলে বাধ্যতামূলক ওভারটাইমের নামে শোষণ বাড়বে। 
 

 

 

 

 

Comments :0

Login to leave a comment