জহর সরকার
ময়মনসিংহের এক ভদ্রলোক তীব্র রাগে বলে উঠলেন, 'শ্যাম শ্যাম শেমবাবু।'
কথাটার মানে কিছু বুঝলেন? তারাপদ রায় বলেছেন, 'আসলে উনি বলতে চাইছেন, শেম শেম শ্যামবাবু। ময়মনসিংহের লোক তো। য-ফলাকে বলেন এ-কার। আর এ-কারকে বলেন য-ফলা।'
ঘটনা হলো, এই শ্যাম আর শেম মিলেই আমাদের বাংলাভাষা। শেম যদিও বিলিতি শব্দ। কিন্তু ময়মনসিংহের কথা গুণে কী মিষ্টি একটা উচ্চারণ হয়েছে। এক শ্রেণি উগ্র সংস্কৃত-বাদীরা এসব মানেন না ও জানেন না। জানার ইচ্ছেও নেই। কিন্তু আমরা জানি, 'এ যে সুরেরই ভাষা, ছন্দেরই ভাষা।'
আমার মা ময়মনসিংহের। বাবা চট্টগ্রামের— যার আঞ্চলিক ভাষা খুবই দুর্বোধ্য। দু’জনে এ পারের বাংলাতেই কথা বলতেন। তবে উচ্চারণের ফারাক তো ছিলই। কিন্তু যাই থাক, ভাষাটা বাংলা। বাগানের পাঁচ রকম ফুলের মতো ফুটে আছে পাঁচ রকমের উচ্চারণ। গত এক দশকে রাজনৈতিক ফায়দার জন্যে গজিয়ে উঠেছে এক শ্রেণি বাঙালিকে হেয় করার হিন্দি-প্রেমী বাঙালি। একবার বলছেন, 'বাংলাদেশি ভাষা।' একবার বলছেন, 'বাংলা বলে কোনও ভাষা নেই।' কী যে বলতে চায়, নিজেরাই ঠিক মতো জানে না। এবং কী আশ্চর্য, বাংলার দু’-চারজন লেখক, ভাষাবিদ এঁদেরই পক্ষ নিয়ে ফেলছেন। সম্প্রতি একটি টিভি অনুষ্ঠানে শুনে অবাক হলাম যে বাংলা মানে শুধু সংস্কৃত শব্দ যে ভাষায় আছে। ফারসি বা আরবি শব্দ থাকলেই ওটা বাংলা নয় — বাংলাদেশি। এই অর্ধশিক্ষিত লোকেরা জানে না যে বাংলা ভাষায় আজ ৭০০ বছর ধরে কয়েক হাজার ফারসি-আরবি শব্দ রয়েছে।
আমি মাত্র কয়েকটি এই প্রকার বাংলা শব্দ যে গুলি ফারসি থেকে এসেছে উদ্ধৃত করছি: আয়না, আহাম্মক, আবাদি, আন্দাজ, আরাম, আস্তে, উকিল, কাগজ, কারখানা, কানুন, কোমর, কুস্তি, খারাপ, খালি, খুব, গু, গরম, চশমা, চালাক, চাকর/চাকুরি, চাকু, চেহারা, চাদর, ছায়া, জোর, জায়গা, জরুরি, জরিমানা, জবরদস্তি, জবাব, জান, ঝাড়ু, ডেগচি, তারিখ, তাপ, তার, তাজ্জব, তোপ, তোষক, দম, দরবেশ, দূর, দেরি, দলিল, দরখাস্ত, দূরবিন, দরজা, দোকান, নরম, নমুনা, পেঁয়াজ, পর্দা, পছন্দ, পোলাও, বখশিশ, বদ, বাগান, বাচ্চা, বগল, বিশ, বরফ, বরাবর, বাজি, বালিশ, বন্দর, বিমা, মজা, মোরগ, মশকরা, রাস্তা, রোজ, রঙ, শক্ত, শহর, সবজি, সরকার, হাওয়া, হামলা ও হাজার।
এদের কী করে বোঝাই? বাংলা থেকে এই রকম কয়েক হাজার অন্য দেশীয় শব্দ বর্জন করে শুধু সংস্কৃত কথা খুঁজে বেড়াব? বেশির ভাগের কথার কোনও শব্দই নেই সংস্কৃত ভাষায়। তবে চলুন আমরা সকলে হিন্দিতেই কথা বলি। কিন্ত সে হিন্দি যে খুব সুখকর হবেনা সেটা হলফ করে বলতে পারি। যেমন একদিকে টাই (tie) হয়ে যাবে 'কণ্ঠ লঙ্গোট' অন্যদিকে কুর্সি বা আরামের মতোই অগুনতি ফার্সি কথা রোজ হিন্দিতে ব্যবহার হয় সেগুলোর কী হবে?
আবার পশ্চিমবঙ্গে যাঁরা বলেন যে পূর্বের শব্দগুলো— যেমন চাচা, ফুফা বা ফুফু, নানা, পানি—কেমন কেমন লাগে, তাঁরা ভুলে যান এই সব কথাই কিন্তু সংস্কৃত থেকে এসেছে।
Bengali Language
বাংলা ভাষার বৈচিত্র

×
Comments :0