প্রতীম দে
দুর্বল বিদেশ নীতিই কি আজ বিশ্ব মঞ্চে ভারতের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিল? পহেলগামে সন্ত্রাসবাদী হামলার পর সাংসদের প্রতিনিধি দল বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন। সন্ত্রাসবাদের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের যেই মদত সেই কথা তুলে ধরার দায়িত্ব ছিল এই প্রতিনিধি দল গুলোর। কিন্তু দেখা গেলো ভারতের এই প্রতিনিধি দলের সাথে দেখা করলেন না কোন প্রথমসারির রাষ্ট্র প্রধান। তারা বাঠক করলে শুধুমাত্র সেই দেশ গুলোর প্রতিনিধিদের সাথে। সন্ত্রাসবাদ যে শুধু ভারতের কাছে বিপদ তা নয়, সন্ত্রাসবাদ গোটা বিশ্বের কাছেই বিপদ। তাহলে কেন ভারতের এই অভিযানে সামিল হলেন না কেন? আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা মনে করেছেন এর পিছনে রয়েছে ভারতের বিদেশ নীতি।
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহর লাল নেহেরু গোটা বিশ্বের কাছে এক উদাহরণ তৈরি করেছিলেন। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া একটা দেশ ভারতবর্ষ যা বিভিন্ন দিক থেকে পিছিয়ে আছে, সেই দেশ সিদ্ধান্ত নিল যে দ্বিমেরু বিশ্ব-রাজনীতিতে কোন পক্ষের হবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তৎকালিন সোভিয়েত ইউনিয়নের থেকে সমদুরত্ব বজায় রাকবে ভারত। ভারতের দেখানো এই পথে তখন পা বাড়িয়ে ছিল অনেক অনুন্নত দেশ। কিন্তু নেহেরু সময় সোভিয়েতের সাথে ভারতের সম্পর্ক ছিল ভালো। কাশ্মীর নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে যখন ভোটাভুটি হয় তাতে ভারতের সমর্থনে ভেটো দিয়েছিল সোভিয়েত। এশিয়া এবং আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশ গুলোকে নিয়ে
ভারতের বিদেশ নীতির যেই মূল বৈশিষ্ট তা তৈরি হয়েছিল নেহেরু সরকারের সময়েই। মূলত আটটা বিষয়ের ওপর ভীত করে তৈরি হয়েছে ভারতের বিদেশ নীতি। প্রথম যেই বিষয়ের ওপর উল্লেখ করা হয়েছে তা হলো জোট নিরপেক্ষতা, পঞ্চশীল, উপনিবেশবাদ এবং আধিপত্যবাদের বিরোধীতা করা, বর্ণ বিদ্বেশের বিরোধীতা, যে কোন আন্তর্জাতিক সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান, নিরস্ত্রীকরণ, পিছিয়ে পড়া দেশ গুলোর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, প্রতিবেশী রাষ্ট্র গুলোর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক।
অধ্যাপক উৎপল রায় তাঁর লেখা একটি বইতে উল্লেখ করেছেন যে ১৯৪৯ সালের একটি বক্তব্যে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু বলেন, ‘প্রতিবেশী রাষ্ট্র গুলোর কথা সব সময় আমাদের মাথায় থাকবে।’
রাজীব গান্ধীর সময় থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারতের সম্পর্ক ভালো হতে শুরু করে। পরবর্তী সময় ১৯৯১ সালে নয়া উদারতাবাদের হাত ধরে ভারতের মাটিতে শুরু হয় বিদেশী পূঁজি এবং বিদেশী সংস্থার আনাগোনা।
তবে এই ৭৫ বছরে আন্তর্জাতিক রাজনীতির ভারসাম্যের বদল হয়েছে। বদলেছে ভারতের বিদেশ নীতিও কিন্তু যেই ভীতের ওপর ভিত্তি করে এই বিদেশ নীতি তৈরি হয়েছে তার কোন বদল হয়নি। বর্তমান সময় দাঁড়িয়ে দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদী সরকার ভারতের বিদেশ নীতি এই সব বিষয় গুলোকে অমান্য করতে শুরু করেছে।
প্যালেস্তাইন মুক্তি সংগ্রামের প্রধান নেতা ইয়াসের আরাফাতকে সম্বর্ধনা দিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। তখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জ্যাোতি বসু। গোটা কলকাতা সেদিন আরাফাতকে স্বাগত জানিয়েছিল। মার্কিন সম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লাগাতার লড়াই চালিয়ে যাওয়া কিউবা মুক্তি আন্দোলনের নেতা তথা কিউবার শীর্ষ নেতা ফিদেলকে এই ভারতে এসেছিলেন তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আমন্ত্রণে। কিউবার ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেই অর্থনৈতিক অবরোধ এবং নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রসঙ্ঘে বার বার মার্কিন এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে এসেছে। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সব সময় বিশ্বমঞ্চে বার্তা দিয়ে এসেছে ভারত।
এখন দেখা যাচ্ছে ইজরায়েল যখন গাজায় লাগাতার হামলা চালাচ্ছে একের পর এক হাসপাতাল বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে তখন সেই হামলার নিন্দা না করে বন্ধু নেতানিয়াহুর পাশে দাঁড়িয়েছে মোদী সরকার। প্যালেস্তাইনের সমর্থনে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ সভায় যখন ভোট দেওয়ার সময় আসছে তখন সেখানে অনুপস্থিত থাকছে ভারত। যেই ভারত যে কোন আন্তর্জাতিক সমস্যা সমাধানের জন্য শান্তিপূর্ণ আলোচনার কথা বলে এসেছে সেই ভারত আন্তর্জাতিক মঞ্চে সেই কথা বলার দম রাখতে পারছে না পাছে আমেরিকা রাগ করে।
পাকিস্তানের সাথে যখন সামরিক সংঘাত চলছে সেই যুদ্ধ বিরতি দুই দেশের পক্ষ থেকে ঘোষনা করার আগে তা জানাচ্ছে মার্কিন রাষ্ট্রপতি! তিনি দাবি করছেন তার মধ্যস্থতায় দুই দেশ যুদ্ধ বিরতির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যেই দেশ জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রবক্তা সেই দেশ বাধ্য হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কাছে মাথা নত করতে। প্যালেস্তাইন মুক্তি সংগ্রামে প্যালেস্তাইনের প্রতি সংঘতি জানিয়ে ছিল ভারত। বর্তমান সময় দাঁড়িয়ে ইরানের ওপর যেই হামলা চালানো হচ্ছে তার কোন নিন্দা এখনও করতে পারেনি ভারত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিঞ্জানের এক অধ্যাপক বলেন, ‘এককথায় বলা যেতে পারে এই সরকারের সময় ভারতের বিদেশ নীতির কোন ভিত্তি নেই। আমেরিকার কাছে কার্যত মাথা নত করেছে। এই পরিস্থিতি তৈরি হতো না, অপারেশন সিঁদুরের পর ভারত বিদেশের বিভিন্ন দেশের সমর্থন পেতো যদি সে তার অতীত মাথায় রেখে বিদেশ নীতি রূপায়িত করতো।’
Comments :0