Travelling

ভরা বর্ষায় মানজিঙ

বিশেষ বিভাগ ফিচার পাতা

মানব লাহিড়ী

কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস শিলিগুড়ি স্টেশন ছাড়াতেই মনটা কেমন হালকা হয়ে গেলো। সেই গুলমাখোলা, সেই পিছনের দিকের কামরা। এতবার এই পথে এসেছি কিন্তু ভালোলাগা কমেনি। গুলমাখোলার ঘন সবুজ জঙ্গল দিয়ে যখন বাঁক নেয় ট্রেনটা কি যে ভালো লাগে! তারপর সেবক। যদিও সেবকের সেই দৃশ্য আর নেই। সিকিমের রঙপো রেল লাইনের দৌলতে এখন কংক্রিটের রাজত্ব। আরও এগিয়ে তিস্তা রেল ব্রিজ। মংপং পেরিয়ে ট্রেন এগতেই শুরু চা বাগান। সবুজ চা বাগানের মধ্যেদিয়ে এঁকেবেঁকে চলে চলেছে রেল লাইন। পাশেই রাস্তা। ৩১নম্বর জাতীয় সড়ক আর ট্রেন লাইন যেন লুকোচুরি খেলছে। ওদলাবাড়ি, ডামডিং পেরিয়ে দারুণ সুন্দর নিউ মাল জংশন। এতবার দেখি কিন্তু কখনই পুরানো হয় না। 
মালবাজারের ট্রেনপথের শেষ। এবার গাড়ি। চেইল নদী পেরিয়ে পিছনের দিকে ফিরে আসা। ওদলাবড়ি চৌপথি। সোজা রাস্তা চলে গিয়েছে করোনেশন ব্রিজ হয়ে শিলিগুড়ি। বাঁদিকে ক্রান্তির পথ। আমারা ধরলাম ডানদিকের রাস্তা। রেল লাইনের নিচে দিয়ে সোজা উত্তরের দিকে। প্রথমেই মানাবাড়ি চা বাগান। দু’দিন আগেই শুরু হয়েছে জোরদার বৃষ্টি। এবার বর্ষার শুরুতে ডুয়ার্সে তেমন বৃষ্টি হয়নি। গরমে অতিষ্ট হয়ে গিয়েছিল মানুষ। জুলাইয়ের শেষে আকাশ সাদা কালো মেঘে ঢাকা। দু’দিন আগে থেকেই বেশ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টি ভেজা চা বাগান, সবুজ শেড ট্রি আর ঘন মেঘে ঢাকা আকাশ এক দারুণ কোলাজ। দু’পাশে সবুজ চা বাগান মধ্যেদিয়ে চলে গেছে সরু ফিতের মতো কালো রাস্তা। মানাবাড়ি চা বাগান বেশ বড়। চা পাতা তোলার ফাঁকেই রাস্তার পাশে বসে দুপুরের আহার সেরে নিচ্ছেন  মহিলা চা শ্রমিকরা।
মানাবাড়ির পর আর এক চা বাগান পাথরঝোরা। দূরে নদীর দিকে তাকিয়ে সারথি রাজু জানালো এ পথে হাতির বেশ আনাগোনা। এতক্ষণ রাস্তা ছিল সমতল। পাথরঝোরা চা বাগান ছাড়াতেই শুরু চড়াই। বাড়িঘর তেমন নেই শুরু সবুজ জঙ্গল। কয়েক কিলোমিটার এগিয়ে আরও এক চৌরাস্তা পড়ল। একেবারে ইউটার্ন করে উঠে চললাম উপরে। বেশ কিছুটা এগিয়ে গাড়ি থামাতেই হলো। নিচে দেখা যাচ্ছে ডুয়ার্সের বিস্তীর্ণ প্রান্তর, দূরের শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ি। এর আগে পাংবু থেকে তিস্তার বেড, ভূগোলের ভাষায় অববাহিকা দেখেছি। কিন্তু এখান থেকে দেখা যাচ্ছে ডুয়ার্সের সব নদীর বেড। মাল, চেইল, লিস, ঘিস সবার। সবুজ প্রান্তরের মধ্যেদিয়ে এঁকেবেঁকে সব নদী মিশেছে তিস্তায়। এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। একচোখে পুরো ডুয়ার্স আর তরাই। নদী, চা বাগান, সবুজ জঙ্গল সব এক সাথে। আজ নয় কাল নয় পরশু- এখানে একটা ভিউ পয়েন্ট হবেই। 
আরও কিছুটা এগিয়ে পৌঁছে গেলাম আমাদের গন্তব্য মানজিঙ। একটা খেলার মাঠ, তার পাশে দুটো পাকা বাড়ি। মাঠের উল্টো দিকে পাইনের জঙ্গল। দুটো বাড়ির একটাতে গড়ে উঠেছে হোম স্টে। আমরা তার প্রথম বোর্ডার। মাঠের দু’পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কয়েকটি বাড়ি। জনবসতি বেশ কম। চারিদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। মানজিঙের দূরত্ব ওদলাবাড়ি থেকে ৩১ কিমি। মাত্র একঘণ্টার পথ। মানজিঙের উচ্চতা তেমন কিছু বেশি নয় আনুমানিক চার হাজার ফুট। তবে এত গাছ থাকায় ভর দুপুরেও তেমন গরম লাগছে না।  
সকালে বৃষ্টি হয়ে গেছে। রেশ রয়ে গেছে গাছের পাতায়। এখন আকাশে মেঘ থাকলেও বৃষ্টি নেই। শুনলাম এখান থেকে তিন কিলোমিটার দূরেই নাকি রয়েছে একটা নদী। নাম সাঙ্কি গীতখোলা। দেরি না করে রওনা দিলাম সেই দিকে। কিলোমিটার দুয়েক পরে লুঙসেল গ্রাম। এখানে মরশুমে ফলে কিউই ফল। এখানেও দেখলাম একটা হোম স্টে। একটা বার্ড ওয়াচারদের দল এসেছে। এই সময় পাখি তেমন দেখা যায় না শুনলাম। তবে পাওয়া যায় নানা রঙের, নানা আকারের প্রজাপতি। প্রথমে কিছুটা চড়াই তারপর টানা উৎড়াই ভেঙে পৌঁছে গেলাম গীতখোলায়। একটা ব্রিজের সামনে গাড়ির পথ শেষ। বর্ষার জলে পুষ্ট গীতখোলা প্রবল বেগে নেমে আসছে। আশপাশে দুটো ঝরনাও রয়েছে। ব্রিজ পেরিয়ে দূরে উপরে একটা গ্রাম। তবে সেখানে এখন হেঁটেই যেতে হবে। চারিদিক নিঃস্তব্ধ। না ভুল বললাম। নদীর স্রোত আর পোকার ডাক খানখান করে দিচ্ছে নিঃস্তব্ধতা। কেমন যেন ছমছমে ভাব। এখানে তাঁবু ফেলে রাত কাটালে কেমন হয়!
এই অঞ্চল জীব বৈচিত্রে ভরপুর। এর টানেই ১৯৩৮সালে ব্রিটিশরা করোনেশন ব্রিজের আদলে বানিয়েছিল ছোট একটা সেতু ঘোড়া যাতায়াতের জন্য। তার চিহ্ন এখনও রয়ে গেছে। 
বেশ কিছুক্ষণ ওখানে কাটিয়ে ফিরে এলাম মানজিঙে। পঞ্চায়েত অফিস হয়েছে তবে কাজ শুরু হয়নি। প্রধান জানালেন তিনি থাকেন মানাবাড়ি চা বাগানেই। কোনও দোকানপট নেই। নেই হইহুল্লোড়। একেবারে নিরিবিলি জায়গা। এখনও পর্যটকদের পা পড়েনি এখানে। চোখ পড়েনি ইউটিউব’র ব্লগারদেরও। একেবারে অনাস্বাদিত একটা গ্রাম। এমনকি প্রথমে মানজিঙের নাম শুনে গুগল সার্চ করেও এর সন্ধান পাইনি। সমতলের এত কাছে এত ভার্জিন একটা জায়গা যে আছে এতবার ওদলাবাড়ি এসে জানতেও পারিনি। 
দেখার এখনও বাকি। সন্ধায় সামান্য শীতের পরশ। একটা কিছু গায়ে দিলে যেন আরাম লাগবে। রাতে পঞ্চায়েত অফিসের নিচে পাহাড়ের ঢালে দাঁড়িয়ে সত্যই হতবাক হয়ে গেলাম। নিচে মালবাজার, ওদলাবাড়িতে আলো জ্বলে গেছে। আর দূরে দেখা যাচ্ছে শহর শিলিগুড়ি আর জলপাইগুড়ি শহর। না এ দৃশ্য ভাষায় প্রকাশ করার নয়, শুধুই দেখার, অনুভব করার।
রাতে ঘুরতে ঘুরতে পাশের বাড়ির বাড়িওয়ালা মাঠে দাঁড়িয়ে বলছিলেন গ্রামের কথা। আঙুল তুলে দেখালেন উত্তরের ওই সবুজ পাহাড়ের উপর দিয়ে নাকি দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্গা। মনটা কেমন নেচে উঠলো। দেখা হবে কি কাঞ্চনজঙ্ঘার সাথে।
শেষ রাতে প্রবল বৃষ্টি। ভোরে সেই অর্থে বৃষ্টির শব্দেই একবার ঘুম ভেঙে গেলো। সকালে গোরা ডাকছে। বারান্দায় আয়, দেখা যাচ্ছে পাহাড়। বারান্দা থেকে দেখা যাচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘার ছোট্ট একটা চূড়া। বিছানার চাদর গায়ে জড়িয়েই ছুট্টে চলে গেলাম মাঠের সেই কোণে। চোখ সার্থক, মন সার্থক। এই ভরা বর্ষায় যে সাদা পাহাড়ের দেখা পাব সেটা কল্পনাতেও ছিল না।
এবার ফেরার পালা। ওদলাবাড়ির কাছে পর্যটকদের এখন আরও একটা দেখার জিনিস হয়েছে। বাগরাকোট ল্যুপ। সিকিম যাওয়ার বিকল্প রাস্তায় এই ল্যুপ স্যতিই দেখার মতো। যদিও বেশ কয়েকটা দুর্ঘটনার পর পুলিশ ল্যুপে দাঁড়িয়ে আর ছবি তুলতে দেয় না, দাঁড়াতেও দেয় না। ছবি যা তোলার সব গাড়ি চলতে চলতে। এখান থেকে যাওয়া যায় লাভা, লোলোগাঁও কিংবা চারখোল, কালিম্পঙ।

অতিরিক্ত: মানজিঙে একটাই হোম-স্টে। উৎসাহীরা যোগাযোগ করতে পারেন 96478 02891/ 94341 16325 বা 97331 69116 নম্বরে।
ছবি: লেখক ও দেবব্রত ব্যানার্জি
 

Comments :0

Login to leave a comment