বইকথা
রাজা রামমোহন রায় : বাংলা ভাষা চর্চার উন্মেষপর্বের অনন্য গ্রন্থ:‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’
সৌরভ দত্ত
নতুনপাতা
সময় সারণি বেয়ে পেরিয়ে গিয়েছে তাঁর জন্মের আড়াইশো বছর। ব্রিটিশ ভারতে যুক্তিবাদি মনন ও কুসংস্কার বিরোধীতার প্রাণ পুরুষ ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। বহুভাষাবিদ, তার্কিক এই রেনেসাঁ পুরুষ বাংলার সমকালীন মাতৃভাষার চালচিত্রকে পাঠক সমাজের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন খুব সুচতুর সহজবোধ্যতায়।যুক্তি ও মননশীলতার দ্বারা তৎকালীন সময়ের অচলায়তনকে ছিন্ন করে মানুষের মনের গভীরে এক চিলতে আলো ফেলে দেওয়ার কাজটি করেছিলেন এই কিংবদন্তি পুরুষ। রামমোহন রায়ের অনুবাদ কর্ম ছিল খুব সুনিপুণ।তিনি কথাকে পাপড়ির মতো পরতে পরতে খুলে বিস্তার করতে পারতেন। রমেশচন্দ্র দত্ত তাঁর ‘লিটারেচার অব বেঙ্গল’ গ্রন্থে রামমোহনকে বলেছেন–“ফর্মড দ্য প্রোজ লিটারেচার অব বেঙ্গল”। অর্থাৎ রামমোহনকে বাংলা গদ্যের স্থপতি বলাই যায়।বেন্থাম,মিল প্রমুখের চিন্তাদর্শের সাথে রামমোহনের শাণিত মুক্তির মিলবিন্যাস খুঁজে পেয়েছেন সমালোচকরা।কলেট বহুপূর্বে লিখেছিলেন–“... জার্মানিতে যেমন লুথার, বাংলাদেশে তেমন রামমোহন”। ব্যাকরণের দুটি বই লিখেছিলেন–‘বেঙ্গলী গ্রামার ইন দি ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ’(1826) ও ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’(1833)।1778 সালে হুগলি থেকে ন্যাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেড সাহেব প্রকাশ করেছিলেন তাঁর ব্যাকরণ বই-‘এ গ্রামার অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ’।এই বইটির জন্য ছেনিকাটা বাঙলা হরফ তৈরি করেছিলেন চার্লস উইলকিনস। বাংলায় ব্যাকরণ চর্চা শুরু করার পূর্বে মনোরেল দ্য আস্সুম্পসাও,হ্যালহেড,কেরি প্রমুখ কয়েকজন ইউরোপীয় লেখক বাংলায় ব্যাকরণ লিখেছিলেন।তার মধ্যে কেরির রচনাটি ছিল সর্বোৎকৃষ্ট।যেটির বাংলা তর্জমাও হয়েছিল। কিন্তু রামমোহনের ব্যাকরণ ছিল কেরির ব্যাকরণের চেয়ে বহু ভালো।বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর সতত সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি ছিল।গৌড়ীয় ব্যাকরণ রচিত হয় তৎকালীন সময়ে স্কুল-বুক সোসাইটির অভিপ্রায়ে এবং ছাত্রদের পাঠোপযোগী করে। সর্বমোট বারোটি অধ্যায়ে এটি বিন্যস্ত হয়েছিল।বইটির প্রথম পৃষ্ঠায় ছিল–গৌড়ীয় ব্যাকরণ তদ্ভাষা বিরচিত শ্রীযুত রাজা রামমোহন রায় দ্বারা পাণ্ডুলিপি।প্রথম অধ্যায়ে রয়েছে ধ্বনি,বর্ণ, উচ্চারণ,শব্দ,অক্ষর সম্পর্কিত সম্যক আলোচনা।পরবর্তী অধ্যায় সমূহে বিশ্লেষি হয়েছে বাংলাভাষার লিঙগ,প্রত্যয়,পদান্বয়,বাক্যপ্রণালী,ছন্দ প্রভৃতি।গ্রন্থে রামমোহনের স্বকীয় ভাবনাচিন্তা ও পদ্ধতিগত উল্লেখযোগ্যতা স্থান পেয়েছে। গৌড়ীয় ব্যাকরণ গ্রন্থে ভাষার ধ্বনিগত ও রূপগত বৈশিষ্ট্য রামমোহনের হাতে আলাদা মাত্রা পেয়েছে। এ গ্রন্থে খাঁঁটি তদ্ভব শব্দ ও বাংলা ক্রিয়াপদক ব্যবহার করেছেন রামমোহন।‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’-এর প্রথম অধ্যায়ে তিনি বলেছেন–“বৈয়াকরণেরা শব্দকে বর্ণের দ্বারা বিভক্ত করেন,সেই প্রত্যেক বর্ণ শব্দের আমুল হয়।এক বর্ণ কিম্বা বহু বর্ণ একত্র হইয়া যখন কোন অর্থকে কহে।তখন তাহাকে পদ কহা যায়।”গৌড়ীয় ব্যাকরণে স্পষ্টত তিনি বলতে চেয়েছেন বাংলা ব্যাকরণ পদ্ধতি সংস্কৃত ব্যাকরণ পদ্ধতির অনুসরণ করে না। কেরির হিসেবে সমাস চার হলেও রামমোহন তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ করেছেন বাংলায় সমাস চারটির বেশি নেই। রামমোহন বলেছেন-“বাংলায় কারকের সংখ্যা চারটিতে নামিয়ে আনা যায়;বাঙলায় কারক সাতটি নয় চারটিতে নামিয়ে আনা যায়;ক্রেতা,কর্ম,অধিকরণ ও সম্বন্ধ।’নিজস্ব এই ভাষাবোধ ও অনুসন্ধিৎসা ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’-এর রচয়িতা হিসেবে রামমোহনকে অনন্যতা দিয়েছে।
গ্রন্থনাম: ‘গৌড়ীয় বাংলা ব্যাকরণ’
রচয়িতা: রাজা রামমোহন রায়
প্রকাশক: কলিকাতা স্কুল বুক সোসাইটি
প্রকাশকাল: ১৮৪৫
Comments :0