Post Editorial

নাগপুরের ট্রেনে ঘাসফুল

উত্তর সম্পাদকীয়​

পার্থপ্রতিম বিশ্বাস 

রাজ্যজুড়ে তাপ প্রবাহের প্রথম ইনিংস শেষ হলেও লোকসভা ভোটের উত্তাপে উত্তপ্ত হয়েই চলেছে রাজ্যের রাজনীতি। রাজ্যে  নতুন নতুন ঘটনা, নতুন নতুন ভাষ্য তৈরি হচ্ছে প্রতিদিন গণমাধ্যম জুড়ে। রাজ্যে গত কয়েক বছরের ‘ তুই বেড়াল না মুই বেড়ালের’ তরজা এবার ভোটে অনেকটাই প্রশমিত। শাসক আশ্রিত সংবাদমাধ্যমের  যাবতীয় ভবিষ্যৎ বাণী ভুল প্রমাণ করে এবারের লোকসভা ভোটে রাজ্যে ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস টের পাওয়া যাচ্ছে। ফলে পৌরসভা কিংবা পঞ্চায়েতে হরির লুটের মতো ভোট লুটের প্রবণতা ক্রমশ কমছে এই ভোটের বিভিন্ন দফা জুড়ে। নির্বাচন কমিশন কিংবা কেন্দ্রীয় বাহিনীর তৎপরতায় নয় কার্যত জেলায় জেলায় মানুষের সক্রিয় প্রতিরোধে নির্বাচনের বিভিন্ন পর্যায়ে নিজের হারানো অধিকার প্রয়োগ করছে মানুষ। ফলে এবার ভোটে কমছে জল মেশানো জাল ভোটের অঙ্ক। এমন প্রেক্ষিতে রাজ্যে দ্বিমেরু রাজনীতির নটে গাছটি মুড়াতে শুরু করায় বিমর্ষ দুই ফুলের দল মরিয়া হয়ে ছলে বলে কৌশলে ভোটের মেরুকরণের নতুন নতুন উপায় বার করছে ভোটের মাঝ পর্ব থেকেই। 
 
এবারের নির্বাচন কার্যত গত দশ বছরের মোদী সরকারের নীতির বিরুদ্ধে হতে চলেছে এক গণভোট । ফলে দেশ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন অবিজেপি  রাজনৈতিক দলগুলি গেরুয়া শাসকের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হয়েছে ‘ ইন্ডিয়া ‘ মঞ্চে। সাম্প্রতিক অতীতে জাতীয় স্তরে এমন বিরোধী মঞ্চ গড়ার উদ্যোগে নেওয়া শুরু হলেই  ছলে বলে কৌশলে  যারা সেই উদ্যোগে জল ঢালতে উদ্যত হতো প্রবল উৎসাহে তাদের মধ্যে এরাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস অন্যতম। কার্যত রাজ্যের বাইরে একটা পঞ্চায়েত দখলের ক্ষমতা নেই যাঁদের তাঁরা কখনও ত্রিপুরায় গিয়ে, কখনও গোয়ায়, কখনও মেঘালয়ে গিয়ে নিজের নাক কেটে বিজেপি’র যাত্রাপথ সুগমের ব্যবস্থা করেছে। এবার তাঁরাই আগ বাড়িয়ে হাজির হয়েছিল সেই বিরোধী জোটের ‘ ইন্ডিয়া’ মঞ্চে। বলাই বাহুল্য তাঁদের অতীত ঐতিহ্য মেনে বিরোধী মঞ্চকে ভেতর থেকে দুর্বল করার যাবতীয় অপচেষ্টার আরেক নমুনা পেশ করেছেন দলনেত্রী। ভোটের চার পর্ব মিটতে না মিটতেই তিনি কৌশলে বিরোধী জোটের বাইরে নিজেকে নিয়ে গেছেন। লক্ষ্য কিংবা উদ্দেশ্য পরিষ্কার যে এবার কেন্দ্রে বিজেপি’র সরকার গড়ার সম্ভাবনা ক্রমশ ফিকে হচ্ছে। ফলে গত দশটা বছর  রাজ্যে আকণ্ঠ দুর্নীতিতে ডোবা দল এবং সরকারকে বাঁচিয়ে মোদী সরকারের সাথে যেমন রসে বসে চলেছেন, তেমন স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে  প্রয়োজন হলে ঘাসফুলের দল  বাইরে থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবেন পদ্মফুলের দিকে। তার প্রথম পদক্ষেপ বিরোধী জোটের থেকে তৃণমূলের দূরত্ব তৈরি করা। ফলে তিনি ঘুরিয়ে  মুখে বলছেন ‘ বাইরে থেকে বিরোধী জোটের সরকার ‘ গড়ায় সাহায্যের কথা  আর মনে রয়েছে  ‘বাইরে থেকে শাসক জোটের সরকার’ গড়ার কথা। উপরন্তু  গত দশ বছরে যুগপৎ চলা রাজ্যের তৃণমূল এবং কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের মত-পথ-দর্শন কার্যত এক এবং অভিন্ন। কারণ এই দুই শাসকের গুণগত কোনও ফারাক নেই ফারাক  কেবল মাত্রায়। রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার কিংবা স্বৈরাচারের  মাপকাঠিতে দুই পক্ষ  অভিন্ন । নিয়ন্ত্রণের রাজনীতিতে সিদ্ধহস্ত উভয়েই । দুর্নীতিতে একই বৃন্তে ফোটা  দুই ফুলের মতো। কিন্তু এখন এটা স্পষ্ট হচ্ছে যে বিরোধীদের সাথে দিল্লিগামী ট্রেনে চড়লেও  মাঝপথে  নেমে যাচ্ছে তৃণমূল  নাগপুরের ট্রেন ধরবে বলে।

ইতিমধ্যে এরাজ্যে জন মানসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে সন্দেশখালি কেবল একটা দ্বীপের নাম নয় বরং সন্দেশখালি হয়ে উঠেছে রাজ্যের শাসকের বিরোধীশূন্য রাজনীতির নির্লজ্জ অত্যাচারের  এক নতুন অধ্যায়। পাশাপাশি সেই প্রত্যন্ত দ্বীপভুমি গড়ে তুলেছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সমাজের প্রান্তিক মেয়েদের অপ্রতিরোধ্য লড়াইয়ের নজির। ডায়মন্ডহারবার মডেলে ভোট লুট  আর সন্দেশখালি মডেলের সংগঠন গড়ে যে ভোটে এতকাল অভ্যস্ত ছিল রাজ্যের শাসক তাতে ইতি টানতে চলেছে সন্দেশখালির লড়াই। এই ভয়ে ভীত শাসক এবার মরিয়া হয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা চালাচ্ছে যে সন্দেশখালির ঘটনা আসলে এক সাজানো চক্রান্ত। সন্দেশখালির নিষ্পাপ যুবক ‘উত্তম-শিবু-শাহজাহান’দের বিরুদ্ধে  টাকা খেয়ে গ্রামের মেয়েরা নাকি ধর্ষণের  মিথ্যা অভিযোগ করেছে পুলিশের খাতায়! ফলে যেমন ভাবনা তেমনি কাজ সেরে ফেলতে  সেই পুরানো ভয়ের  ভাষ্য হাজির। ‘ মাস্টার মশাই আপনি কিন্তু  কিচ্ছু দেখেননি’  মডেলে   সন্দেশখালি জুড়ে তেমন কিছুই হয়নি প্রমাণে পথে নেমেছে রাজ্যের শাসকদল  কয়েক টুকরো ভিডিও ক্লিপিংয়ের ভাষ্যকে হাতিয়ার করে। ভোট মেরুকরণের লক্ষ্যে সেই ভিডিও সংলাপে এসেছে মহিলাদের টাকার বিনিময়ে ধর্ষণের অভিযোগ করানোর মতো কুৎসিত অপরাধের  এক স্থানীয় বিজেপি নেতার স্বীকারোক্তি। কিন্তু আশ্চর্যের কথা ভোটের বিভিন্ন দফায় প্রধানমন্ত্রী থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী  মণিপুর ,উন্নাও কিংবা হাথরাসের নারী নির্যাতনের ঘটনায় নীরব থাকলেও সন্দেশখালিতে মেয়েদের অত্যাচার  নিয়ে মুখ খুলছেন নিয়ম করে কিন্তু সেই অত্যাচারের তদন্তে থাকা সিবিআই’র মুখে কুলুপ। এমনকি দেশের ভোট চলাকালীন এমন ভিত্তিহীন ভিডিও নিয়ে রাজ্যে ভোট প্রচার চলছে অথচ দেশের নির্বাচন কমিশন এই স্পর্শকাতর বিষয়ে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না।

বাংলায় প্রবাদ আছে চোরের মায়ের বড় গলা সেটা প্রতিনিয়ত টের পাচ্ছে মানুষ এই রাজ্যে দুই শাসকের উচ্চ গ্রামের তরজটায়। সন্দেশখালিতে যেমন সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢাকার চেষ্টা চলেছে তেমনই চলেছিল নন্দীগ্রাম কিংবা সিঙ্গুরের শিল্পায়নের বামফ্রন্ট সরকারের প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করতে। কৃষির সমান্তরাল পথে শিল্পায়নের পথ ভেস্তে দিতে যাবতীয় ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সিঙ্গুর থেকে ‘ টাটা কোম্পানিকে’ ঘাড় ধাক্কা দিয়ে  বের করে দিয়েছিল রাজ্যের তৃণমূল–বিজেপি’র সাথে জোট গড়ে। যার পরিণতিতে আজ অবধি ঘাড় সোজা রেখে কোনও শিল্পপতি এরাজ্যে একটা নতুন শিল্প গড়ার সাহস দেখায়নি। ফলে রাজ্যজুড়ে শিল্পের অভাবে নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা ভিন রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছে পরিযায়ী হয়ে। আর গোটা রাজ্য ক্রমে ক্রমে নিচ্ছে একটা বৃদ্ধাবাসের চেহারা।  
এই প্রেক্ষিতে  ভোট প্রচারে প্রধানমন্ত্রীর মুখে এসেছে দুই তাবড় শিল্পপতি আদানি আম্বানিদের কথা । তিনি অভিযোগ করেছেন বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধী সম্পর্কে, ঐ দুই শিল্পপতির বিরুদ্ধে ভোট প্রচারে নীরব থাকার অভিযোগে। গত  দশ বছরে রকেট গতিতে আয় বেড়েছে যে দুটি শাসক ঘনিষ্ঠ কর্পোরেট সংস্থার কার্যত তাঁদের  কালো টাকা বিরোধীদের মুখ বন্ধ করার কাজে খরচ  হচ্ছে এমন বিচিত্র অভিযোগ এনেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। অথচ তাঁর আদেশেই বিগত লোকসভার অধিবেশনে আদানিকুলের বিরুদ্ধে সরব হতে গিয়েই অধিবেশন থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন একদিনে শতাধিক সাংসদ। কার্যত আদানি আম্বানিদের মতো প্রভুভক্ত কর্পোরেট সংস্থার বিপুল সম্পদ বৃদ্ধির কারণেই কেন্দ্রীভূত হচ্ছে দেশের সম্পদ মুষ্টিমেয়র হাতে । সেই কারণেই দেশের ১% মানুষের মুঠোয় চলে এসেছে  দেশের ৪০% সম্পদের মালিকানা। আদানি আম্বানিরা দেশের জল-জমি-জঙ্গল-খনি–বন্দর লুটের ঢালাও সরকারি অনুমোদন পেলেও দেশের শিল্প কিংবা পরিষেবা ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান বাড়ছে না। বরং এই সম্পদ লুটের সময়  জুড়ে  দেশের বেকারির হার স্বাধীনতার পর সর্বকালীন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। প্রধানমন্ত্রীর সাধের ‘ মেক ইন ইন্ডিয়া ‘ ডাহা ফেল।  
একদা  মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজেকে চৌকিদার আখ্যা দিয়ে বলেছিলেন ‘ না খাউঙ্গা না খানে দুঙ্গা ‘ । কিন্তু দশ বছর গড়াতেই দেখা যাচ্ছে ঠিক তার উলটোটা।  কার্যত গত দশ বছর ক্ষমতায় থাকার সুবাদে সংখ্যার জোরে তাঁরা সংসদে আইন বানিয়ে কর্পোরেট শিল্পপতিদের থেকে আইন সিদ্ধ পথে তোলা আদায়ের ব্যবস্থা করেছেন ‘ নির্বাচনী বন্ডের ‘ মাধ্যমে। হাজার হাজার কোটি টাকা ‘ ইলেকশন বন্ডের ‘ মাধ্যমে যেমন বিজেপি ঘরে তুলেছে তেমনটাই তুলেছে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল। এমন বন্ডের টাকার প্রতিদানে দুই সরকারের কেউ ওষুধ কোম্পানিকে, কেউ বিদ্যুতের কোম্পানিকে দাম বাড়ানোর ঢালাও অনুমতি দিয়েছে । ফলে দুই শাসকের ঘরে জমা পড়া টাকা উসুল হচ্ছে সাধারণের পকেট কেটে আর দুই সরকার এনিয়ে নির্বিকার। এরাজ্যের শাসক কেবল মোদী সাহেবের সৃষ্টি করা বন্ডে উপকৃত হয়নি বরং তাঁরা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে চিট ফান্ড কিংবা শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির  টাকা হজম করে। নামে সিবিআই তদন্ত চললেও তদন্তের গতি রুদ্ধ হয়েছে বার বার এমনকি কোর্টের তীব্র সমালোচনার পরেও। ভোট যত শেষের মুখে এগচ্ছে  নিয়োগ কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত তৃণমূলের  বিধায়ক,  নেতা কর্মীরা জামিনে মুক্ত হচ্ছেন । কার্যত মোদী সাহেবের ‘আচ্ছে  দিন ‘গুলিতে সাধারণের নাভিশ্বাস উঠলেও সবচেয়ে বেশি আর্থিক এবং রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে এরাজ্যের শাসক তৃণমূল কংগ্রেস।  ফলে আজ এটা প্রমাণিত যে  দুর্নীতির প্রশ্নে দেশের শাসক নিজেও খাচ্ছেন আর অনুগত ভক্তদের  জন্য খাওয়ার নিরাপদ ব্যবস্থা  করে দিয়েছেন এই সময়  জুড়ে।  
কিন্তু এ সত্ত্বেও দেশের বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী দেশের মহল্লায় মহল্লায় গ্যারান্টি দিয়ে যাচ্ছেন ভোটের প্রতি দফায়। প্রতিশ্রুতির নিশ্চয়তা প্রদান হলো গ্যারান্টি শব্দের আভিধানিক অর্থ যেটা এই ভোটে পালটে ফেলেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। কারণ গত দশ বছরে তাঁর সময়কালে তিনি যতগুলি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন দেশের মানুষকে তার সবকটি ভঙ্গ হয়েছে তাঁর নেতৃত্বে দেশের সরকার। দেশে কালো টাকা ফেরানোর গ্যারান্টি, কৃষকের  ফসলের ন্যায্য দামের গ্যারান্টি, বছরে দু’কোটি বেকারের কাজের গ্যারান্টি, সর্বজনীন শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের গ্যারান্টি, শিল্প বিকাশের গ্যারান্টি ইতিমধ্যে ভুয়ো প্রমাণিত। কারণ ‘ ভারত মাতা কি জয়’  বলে যারা দিন শুরু করেন তাঁরাই আজ এদেশের সরকার  পোষিত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রেল, ব্যাঙ্ক, বিমার মতো সংস্থাগুলিকে  বেচে দেওয়ার গ্যারান্টি দিচ্ছে কর্পোরেটদের কাছে।  এবার তিনি সমালোচকদের মুখ বন্ধ করার গ্যারান্টি দিচ্ছেন দেশদ্রোহীদের বাগে আনতে । 
ফলে এবার মেয়াদ ফুরানো গ্যারান্টি এবং ভুয়ো গ্যারান্টির স্বরূপ মানুষের কাছে উন্মোচিত হয়ে পড়ছে  বলেই স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এখন অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের গ্যারান্টি ছেড়ে ধর্মীয় বিভাজন এবং সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের গ্যারান্টি দিয়ে চলেছেন প্রকাশ্যে। ভোট পর্ব জুড়ে মেজাজ হারাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী থেকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী উভয়েই। কারণ মানুষ তার নিজস্ব মেজাজে জেগে উঠেছে এবার।

 

Comments :0

Login to leave a comment