আগামী ২০ জুন থেকে শুরু হতে চলেছে ভারত ইংল্যান্ড টেস্ট সিরিজ। পাতৌদি ট্রফি নামে পরিচিত এই সিরিজের নতুন নামকরণ করা হয়েছে তেন্ডুলকার-অ্যান্ডারসন ট্রফি।
২০০৭ সালে ভারতীয় দলের টেস্ট ক্রিকেটে ৭৫তম বর্ষপূর্তির আবহে বিশেষ এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে মনে রেখেই ‘পতৌদি ট্রফি’ নামকরণ হয়েছিল। ১৯৩২ সালের ২৫ জুন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক লর্ডেসে প্রথমবারের জন্য লাল বলের ক্রিকেট খেলতে নেমেছিল ভারত, সেই স্মৃতিকে সম্মান জানাতে দুই দেশের ক্রিকেটীয় সংস্কৃতির মেলবন্ধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় যে পাতৌদি পরিবার, সেই কারণেই ট্রফির নাম রাখা হয়। তবে, সেটা শুধুই ইংল্যান্ডের মাঠে ভারত খেলতে গেলে। অন্যদিকে ইংল্যান্ড ভারত সফরে এলে প্রতিযোগিতার নাম হয় ‘অ্যান্থনি এস ডি’ মেলো ট্রফি’। বিসিসিআইয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও একদা কর্ণধার অ্যান্থনি। ক্রিকেটের ময়দানে দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে মজবুত করতেই এই নামকরণ সেই সময় প্রশংসিত হয়। যদিও, ‘অ্যান্থনি এস ডি’ মেলো ট্রফি’ নামের কোন রকম পরিবর্তন করা হয় নি। হল পাতৌদির নামের। এটা কি ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা?
ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে পতৌদি পরিবারের অবদান প্রশ্নাতীত। প্রথমে শুরু করেন ইফতিকার আলি খান পতৌদি। যিনি ভারত, ইংল্যান্ড দু’দেশের হয়ে খেলেছেন। ১৪ বছরের কেরিয়ার। ইংল্যান্ডের হয়ে খেলার সময় ১৯৩২ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ‘বর্ডিলাইন টেস্ট সিরিজে’ লেগ সাইডে ফিল্ডিংয়ের নির্দেশ এলে অধিনায়ক সেই দেশের তৎকালীন ডগলাস জার্ডিনের মুখের উপর ‘না’ বলে দেন পতৌদি। যার জেরে ম্যানেজমেন্টের রোষে পড়ে দল থেকে বাদ। দেশে ফিরে ভারতের জার্সিতে টেস্ট খেলেন।
ইফতিকার অবসর নিলে ব্যাটন হাতে তুলে নেন তাঁর পুত্র মনসুর আলি খান পতৌদি। লেখাপড়ার সময়ই ইংল্যান্ডেই কাউন্টি ক্রিকেটে পুরোদস্তুর ঢুকে পড়েন। বাবার মত ছেলেও সাসেক্সে খেলা শুরু করেন। মাত্র ২১ বছর বয়সে ভারতী দলের অধিনায়কত্ব লাভ। নান্দনিক ব্যাটিং এবং দুর্দান্ত ফিল্ডিংয়ের তাক লাগানোর সঙ্গে এক সুদর্শন ক্রিকেটার। এই সবের বাইরেও আরও একটি জায়গায় ছাপ ফেলেছিলেন তরুণ অধিনায়ক। সেই সময় জাতীয় দল এখনকার মতোই প্রচুর প্রাদেশিক ক্রিকেটারদের নিয়ে গড়ে উঠত। ভিন্ন সাংস্কৃতিক বলয়, আলাদা ভাষিক ও রুচিগত পরিচিতি নিয়ে বিদেশ সফরে পা বাড়াতেন তাঁরা। কিন্তু কেউই সংকীর্ণ প্রাদেশিকতার গণ্ডী ছাড়িয়ে উঠতে পারতেন না। তাঁদের প্রথম এক সূত্রে বেঁধেছিলেন পতৌদি। ভৌগলিকতার স্বাতন্ত্র্য ও সৌন্দর্যকে স্বীকৃতি দিয়েও ঐক্যবদ্ধ দল কাকে বলে— তার এক অসাধাসরণ নমুনা পেশ করেন সুদক্ষ অধিনায়ক। নিজে অভিজাত নবাব পরিবারের হলেও, সেই তকমার বেড়াজাল ডিঙিয়ে মাঠের সীমা ভেঙে, সাংস্কৃতিক বৃত্তে প্রভাব রেখেছিলেন যিনি, তাঁকে স্বীকৃতি দিতেই দ্বিপাক্ষিক সিরিজের নামকরণে কেউ কোনও আপত্তি তো করেনইনি, উলটে সাধুবাদ জানান।
এখন সেই পাতৌদির নামের পরিবর্তন করা হচ্ছে কেন? ইংল্যান্ডের ক্রিকেট বোর্ড (ইসিবি) জানিয়েছে, যেহেতু নয়া প্রজন্মের নায়কের মুখ পাল্টে গিয়েছে, তাই আপাতভাবে, কালের বিচারে তুলনামূলক নবীন দুই আইকনকে বেছেই প্রতিযোগিতার স্মারকের নামকরণ। একদিকে ভারতের সচিন তেন্ডুলকর। অন্যদিকে ইংরেজ শিবিরের জেমস অ্যান্ডারসন। দ্বিপাক্ষিক সিরিজের নামকরণ কি শুধুই একতরফা হওয়া সম্ভব? বিসিসিআই তাদের কোন বক্তব্য নেই?
এখানে দু’টো বিষয় লক্ষণীয়। প্রথমত, আইসিসি (আন্তর্জাতিক ক্রিকেট নিয়ামক সংস্থা) তাদের অর্থনীতির সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ করে বিসিসিআই। যার বাৎসরিক মুনাফার পরিমাণ ৩৮.৫০%। সেখানে দ্বিতীয় স্থানে থাকা ইসিবির বাৎসরিক মুনাফা ৬.৮৯%। দুই বোর্ডের পার্থক্য পরিমাণ প্রায় ৩২%। ফলে টাকার জোড়ে বিসিসিআই অনেক কিছুরই নিয়ন্ত্রণ করে আইসিসিতে তা স্পষ্ট। এছাড়াও আইসিসির প্রধাণ জয় শাহ। এরপরও কি বিশ্বাস করতে হয় বিসিসিআইয়ের কোন রকম অঙ্গুলি হেলন ছাড়াই ইসিবি একক ভাবেই এই নাম পরিবর্তন করেছে। এবার আসা যাক দ্বিতীয় বিষয়। ২০১১ সালে জুনিয়ার পাতৌদির মৃত্যুর পর বিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে ২০১৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা করা হয় মনসুর আলি খান পতৌদি স্মারক বক্তৃতার। সেই বছর ২০ ফেব্রুয়ারি চেন্নাইয়ে যা অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম বছর বক্তা ছিলেন সুনীল গাভাসকার। এরপর একে একে অনিল কুম্বলে, সৌরভ গাঙ্গুলি, রাহুল দ্রাবিড়, মাইক ব্রিয়ারলি, ফারুক ইঞ্জিনিয়ার, কেভিন পিটারসেন ও শেষ বছর ২০১৯ সালে বিরেন্দ্র সেওয়াগ বক্তা ছিলেন। ২০২০ সালে কোভিডের সময় এই স্মারক বক্তৃতা বন্ধ থাকার পর আর চালু করা হয়নি বিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে। সেই সময় বোর্ড সচিব ছিলেন বর্তমান আইসিসি প্রধান। তবে কি ক্রিকেটের মাঠও অন্য রাজনৈতিক ছকের কারণ বাদ পড়ছেন পাতৌদি? যা একরকম ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা।
Pataudi
ইতিহাস মোছার যুগে ব্রাত্য পাতৌদিও

×
Comments :0