অর্ধেন্দু সেন
২০১৬ সালে রাজ্যের প্রাইমারি স্কুলে সহায়ক টিচার এবং গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি কর্মচারী নিয়োগের জন্য পনেরো হাজারের বেশি সফল প্রার্থীর একটা প্যানেল তৈরি হয়। প্যানেলটি প্রকাশ করা হয় না। সফল প্রার্থীদের আলাদা করে জানিয়ে দেওয়া হয় যে তাদের নাম প্যানেলে উঠেছে। সত্যিই তো। ও পাড়ার বিষ্ণু পাশ করেছে কিনা তা আমার জানার কোন দরকার? কিন্তু বাঙালি তো! জানাজানি হয়েই যায়। চাকরি পাওয়া শুরু হলে অনেকেই বুঝতে পারে কারচুপি হচ্ছে। যারা ডাক পাচ্ছে তাদের নাম হয় প্যানেলে নেই নাহয় রয়েছে অনেক নিচে। একজন দু’জন করে তখন নালিশ জানাতে শুরু করে। কেউ কেউ আদালতেও যায়।
বেশ কয়েক বছর বিষয়টি গুরুত্ব পায়নি। ২০২২ সালে শিক্ষা মন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জির ঘনিষ্ট সহকারী অর্পিতা মুখার্জির বাড়িতে হানা দিয়ে ইডি নগদ কয়েক কোটি টাকা উদ্ধার করে। দু’জনকেই জেলে পাঠানো হয়। টাকার পাহাড়ের সেই ছবি দেখে মানুষ বোঝে যে সারদা-নারদের কাছে কিছুই নয়। এ এক বিরাট কেলেঙ্কারি! মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন এতগুলো টাকা! আমি কিছু জানতে পারলাম না! প্রশ্ন হলো জানলেই বা কি করতেন? নারদের সময় বলেছিলেন আগে জানলে টিকিট দিতাম না। কিন্তু জানার পরে ওনার মনে হয়েছিল ছবিগুলো ভেজাল।
পার্থকে উনি অতটা প্রোটেকশন দিতে পারেননি যতোটা মদন মুকুল পেয়েছিল। অ্যারেস্ট হওয়া মাত্রই তাঁর মন্ত্রিত্ব আর পার্টিসদস্য পদ দুইই খোয়াতে হয়। টাকার পাহাড়ের ছবি প্রকাশ্যে আসার পরে বিচক্ষণ মুখ্যমন্ত্রী বুঝতে পারেন ওদিকের রাস্তা বন্ধ। এদিকে প্যানেল নিয়ে দুর্নীতির নতুন নতুন দৃষ্টান্ত জনসমক্ষে আসতে থাকে। ২০২৪ সালে বহু শুনানির পরে উচ্চ আদালত পনেরো হাজার চাকরি প্রার্থীর গোটা প্যানেলটাই বাতিল করে দেয়। রাজ্য সরকার আপিলে যায়। ২০২৫ সালের মে মাসের অর্ডারে সুপ্রিম কোর্ট উচ্চ আদালতের রায় বহাল রাখে।
সারদা-নারদের সময় মমতা ছিলেন সততার প্রতীক। এখন সেকথা কেউ বলছে না। মাঝের দশ বছরে দুর্নীতি যেভাবে গ্রাস করেছে রাজ্যটাকে তাতে সততার বাজার দর কমে হয়েছে শূন্য। তাই সততা জলাঞ্জলি দিয়ে উনি এখন মানবিকতার প্রতীক হতে চাইছেন। ঘুষ দিয়ে চাকরি পেয়েছে তো কি হয়েছে। দিল্লি হাই কোর্টের জজের বাড়িতেও তো ক্যাশ পাওয়া গেছে। তাঁর মতো আমার ভাই বোনদেরও ট্রান্সফার করে দেওয়া যেত না? তাদের চাকরি যাবে কেন? হয়তো করা যেত। জজসাহেবরা ঝুঁকি নিতে চাননি। পনেরো হাজার ট্র্যান্সফার মানে তো আরও ৭৫ কোটি!
'আমি জানতাম না' বলে কি কোনও প্রশাসক পার পেতে পারেন? মাইনে তো শুধু করার জন্য নয় জানার জন্যও! জেলায় জেলায় যে প্রশাসনিক বৈঠক হয় সেখানে কোনও আধিকারিক যদি বলেন এক বর্ষাতেই রাস্তা ভেসে গেল! আমাকে তো কেউ বলেনি। সেকথা কি গ্রহণযোগ্য হবে? এ প্রশ্ন আদালতে তুলতে হবে। দ্বিতীয় প্রশ্ন। সহায়ক টিচারের চাকরির জন্য প্রার্থীরা লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছে কেন? এতো বড় বাজারের ট্র্যাফিকের পোস্ট নয়! প্রাইভেট টিউশনিতে কত টাকা উঠবে? এর উত্তর খুঁজতে আমাদের সেই সময়টা বুঝতে হবে। প্রতি বছর ঘটা করে শিল্প সম্মেলন হচ্ছে আর দু’লাখ আড়াই লাখ কাজের ঘোষণা হচ্ছে। একবার তো শোনা গেল সত্তর লক্ষ কাজের কথা। যারা হন্যে হয়ে কাজ খোঁজে তারা একটা কাজেরও সন্ধান পায় না। তখনও তারা আশাহত হয়নি। ভরসা রেখেছে নির্বাচনের উপর। মমতা যখন ২০১৬-তে জিতলেন আবার ২০২১এও তখন তারা বিপদটা বুঝতে পারে। তখন টাকার লোভ না করে ভাবে যা পাচ্ছি নিয়ে নিই! দেরি করলে রেট বেড়ে যাবে। এই পরিস্থিতি তৈরি করে রাজ্যের যুব সমাজকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিয়ে এসএসসি কেলেঙ্কারি সম্ভব করেছিলেন মমতা নিজেই। এ দায়িত্ব অন্য কেউ নিতে পারে না।
দিদির অজান্তে এসএসসি’র ভাইবোন কি কি দুর্নীতি করেছেন যার কারণে শীর্ষ আদালত বাধ্য হয় পনেরো হাজার প্রার্থীর প্যানেল বাতিল করতে? জেনে রাখা ভালো। উনি যদি কখনও জানতে চান। পরীক্ষা নেওয়া হলো ওএমআরশিটে। এই শিট রেজাল্ট বের হবার এক বছর পরে নষ্ট করে ফেলা যায়। কিন্তু এক বছরে যদি চাকরি দেওয়ার কাজ পুরো না হয়? যদি আদালতে মামলা চলতে থাকে? তখন শিট নষ্ট করে ফেলা একেবারেই উচিত নয়। এক্ষেত্রে দেখা গেল তাই করা হয়েছে। দুর্নীতি যাতে ধরা না পড়ে তার জন্য যা যা করণীয় সবই করা হয়েছে। শিটস্ক্যান করে তার কপি রাখা হয়েছে? রাখা তো হয়েছিল স্যার কিন্তু খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
কেউ কি পরীক্ষায় না বসেই চাকরি পেয়েছে? হ্যাঁ। কেউ খালি শিট জমা দিয়ে চাকরি পেয়েছে? হ্যাঁ। কারও শিটে নম্বর বাড়ানো হয়েছে? হ্যাঁ। কেউ এমন আছে যে চাকরি পেয়েছে কিন্তু তাকে জয়েন করতে দেওয়া হয়নি? হ্যাঁ। কোনও প্যানেলের মেয়াদ শেষ হবার পরেও চাকরি হয়েছে? হ্যাঁ। প্রত্যেকটি কেসে দৃষ্টান্ত খুঁজে বার করেছে সিবিআই। একটা দুটো নয় কয়েক হাজার। কিছু ক্ষেত্রে কমিশন স্বীকার করেছে অভিযোগ সত্যি। দুর্নীতি এত ব্যাপক হলে সিদ্ধান্ত নিতে হয় বাছাই করে যারা দুর্নীতিতে যুক্ত তাদের বাদ দিয়ে অন্যদের চাকরি দেওয়া হবে কি না। কিন্তু যখন ব্যাপারটা এতোই ঘেঁটে যায় যে কারা যুক্ত কারা যুক্ত নয় তা বোঝার উপায় থাকেনা তখন প্যানেলটাই বাতিল করতে হয়। দিল্লি, ইউপি, এমপি-তে এভাবে প্যানেল বাতিল করা হয়েছে। আইন-অজ্ঞ মুখ্যমন্ত্রী তা জানতেন না? ।
সারদা থেকে শুরু করে দুর্নীতির এত অভিযোগ উঠেছে মমতার নামে কোনোটাই তাঁকে বিপর্যস্ত করতে পারেনি। এখন ওনাকে মনে হচ্ছে একটু কোণঠাসা। অভিযোগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছিল সরকারি কর্মচারীদের ডি এ মামলা। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কর্মচারীরা কেন্দ্রীয় হারে ডি এ পান না। কেন্দ্রীয় সরকার এখন দেয় ৫৫ % সে জায়গায় রাজ্য সরকার দেয় ২৮ % রাজ্যের কর্মচারীরা বহুদিন আন্দোলন করেছেন কেন্দ্রীয় হারে ডিএ’র জন্য। মামলাও চলছে কয়েক বছর। ২০২২ সালে উচ্চ আদালত রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দেন কেন্দ্রীয় হারে ডিএ দিতে। রাজ্য সরকার সে নির্দেশ মানেনি। এক্ষেত্রে মমতার বক্তব্য আমরা জানি। খুশি হয়ে বেশি দিতে পারি কিন্তু চাইলে এক পয়সাও দেব না। সেকথা তো আদালতে বলা যায় না। সেখানে তিনি বললেন ডিএ পাওয়া কর্মচারীদের মৌলিক অধিকার নয়। সেই মামলায় সুপ্রিম কোর্ট এখন বলেছে অধিকারের ব্যাপারটা তাঁরা দেখবেন কিন্তু ওই কথা বলে বছরের পর বছর কর্মচারীদের বঞ্চিত করা যাবে না। কোর্ট বলেছে ছয় সপ্তাহের মধ্যে বকেয়া ডিএ’র এক-চতুর্থ অংশ ছেড়ে দিতে হবে। তার ধাক্কা দশ হাজার কোটি টাকার। তাহলে নতুন মন্দির হবে কি করে? স্কাই-ওয়াক হবে কি করে ? পুজো কমিটির টাকা আসবে কোত্থেকে?
Comments :0