অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি (ওবিসি) সংরক্ষণ মামলায় ফের বড় ধাক্কা খেল রাজ্য সরকার। মঙ্গলবার রাজ্যের তৈরি করা নতুন বিজ্ঞপ্তির ওপর অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ জারি করল কলকাতা হাইকোর্ট। আপাতত আগামী ৩১ জুলাই পর্যন্ত এই স্থগিতাদেশ বলবৎ থাকবে বলে নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। মঙ্গলবার আদালতের এই নির্দেশের ফলে নতুন সংরক্ষণে ওবিসি শংসাপত্র প্রাপকরা যেমন নতুন করে সমস্যায় পড়লেন, তেমনভাবে সুপ্রিম কোর্টে এনিয়ে যে মামলা বিচারাধীন রয়েছে সেখানেও বড় রকমের জটিলতার মধ্যে পড়ল রাজ্য।
রাজ্য সরকার ১৪০টি সম্প্রদায়কে নিয়ে রাজ্যের নতুন ওবিসি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল। সেই বিজ্ঞপ্তিতেই অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ দিয়েছে আদালত। বিচারপতি রাজাশেখর মান্থা এবং তপোব্রত চক্রবর্তীর ডিভিসন বেঞ্চ এই স্থগিতাদেশের নির্দেশ দিয়েছে। এই মামলার শুনানিতে বিচারপতি মান্থা রাজ্য সরকারের উদ্দেশে বলেন, কেন ২০১২ সালের আইনে সংশোধনী আনলেন না? আপনারা ২০১২ সালের ওবিসি আইন অনুযায়ী অর্ধেক কাজ করেছেন। তারপর আবার ১৯৯৩ সালের আইনে ফেরত গিয়েছেন। এটা কেন? বিভিন্ন বিষয়ে রাজ্যের ৪-৫টি বিজ্ঞপ্তিতে আদালতের নির্দেশ অমান্য করা হয়েছে।
এদিন আদালতে রাজ্যের পক্ষে অ্যাডভোকেট জেনারেল দাবি করেন, রাজ্য সরকার সমস্ত দিক বিবেচনা করে এই বিজ্ঞপ্তি বিধানসভায় উত্থাপন করেছে। বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী নিজে এই সংরক্ষণের ওপর বক্তব্য রেখেছেন। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। এনিয়ে মামলাকারীর আইনজীবী বিক্রম ব্যানার্জি এবং সুদীপ্ত দাশগুপ্ত আদালতকে জানিয়েছে, রাজ্য সরকার এই নতুন সংরক্ষণ নিয়ে বিধানসভায় আইনানুগ ভাবে কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি। কোনও বিল আসেনি। যেভাবে নতুন তালিকা তৈরি করা হয়েছে তা বেআইনি। জনসমীক্ষার কাজও ঠিকভাবে হয়নি। যে সংরক্ষণ তালিকা কলকাতা হাইকোর্ট আগেই বাতিলের নির্দেশ দিয়েছিল। সেই তালিকাতেই বেআইনিভাবে সম্প্রদায়গত কিছু এদিক ওদিক করা হয়েছে। যা সম্পূর্ণভাবে বেআইনি কাজ। কিছু সম্প্রদায়ের ক্যাটাগরিভাবে বদল আনা হয়েছে। এই নতুন তালিকা কোনও সমীক্ষার ভিত্তিতে হয়নি। ২০২৪ সালে ২২মে কলকাতা হাইকোর্ট সংরক্ষণ বাতিলের যে নির্দেশ দিয়েছিল সেই তালিকা থেকেই কিছু সম্প্রদায়কে বাদ দিয়ে দেখানো হয়েছে ১৪০টি সম্প্রদায়কে নথিভুক্ত করা হয়েছে। এরজন্য ২০১২ সালের আইনের কোনও সংশোধন হয়নি। এবং ১৯৯৩ সালের আইনের কোনও সংশোধন বা সংযোজন হয়নি। রাজ্য সরকার আদালতকে ভুলপথে চালিত করার চেষ্টা করছে। আইনজীবী সুদীপ্ত দাশগুপ্ত আদালতে বলেছেন, ওবিসি সংরক্ষণ নিয়ে হাইকোর্টের নির্দেশ ছিল, সামাজিক, আর্থিক এবং পেশাগতভাবে ভিন্নতা রয়েছে এমন রাজ্যের সব জনগোষ্ঠীর মধ্যে সমীক্ষার কাজ করতে হবে। কিন্তু রাজ্য সরকার জেলা ভিত্তিক কয়েকটি পরিবারের মধ্যে সমীক্ষার কাজ সীমাবদ্ধ রেখেই নতুন সংরক্ষণ বিজ্ঞপ্তি তৈরি করেছে। পুরানো ওবিসি সংরক্ষণ তালিকার সঙ্গে বর্তমান তালিকার সামান্য কিছু ফারাক তৈরি করা হয়েছে।
এদিন বিচারপতি রাজশেখর মান্থা রাজ্যকে বলেছেন, আপনারা সমীক্ষার জন্য শীর্ষ আদালতকে কিছু কথা বলেছেন। কিন্তু বিজ্ঞপ্তি সংক্রান্ত বিষয়ে শীর্ষ আদালতকে কিছু জানিয়েছেন। বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী রাজ্যকে বলেন, আপনারা এখন ওবিসি সংরক্ষণ নিয়ে পদক্ষেপ করছেন কেন? কেন সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করছেন না। আপনারা কিছু না করলে আদালতও কিছু করবে না। আপনারা এমন কিছু কাজ করছেন তার জন্য মামলা হচ্ছে। সেই মামলা শুনতে হচ্ছে। বিধানসভায় পেশ করার আগেই আপনারা বিজ্ঞপ্তি জারি করে দিলেন। আপনাদের উচিত ছিল শীর্ষ আদালতের নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করা। মামলার শুনানির সময় বিচারপতি মান্থা রাজ্যের উদ্দেশ্যে মন্তব্য করেছেন, সংরক্ষণ নিয়ে প্রায় ১৫ বছর সুবিধা দিয়ে এসেছেন, কিন্তু সংরক্ষণের আইন অনুযায়ী ১০ বছর পর সমীক্ষার করার কথা। সেই সমীক্ষা কোথায় হয়েছে?
গত বছর ২২মে কলকাতা হাইকোর্ট রাজ্যে প্রায় ১২ লক্ষ ওবিসি শংসাপত্র বাতিল করার নির্দেশ দিয়েছিল। হাইকোর্টের নির্দেশের ফলে নতুন করে কোনও সুযোগ সুবিধা পেতে রাজ্য সরকারের দেওয়া শংসাপত্র ব্যবহার বন্ধ করা হয়েছিল। হাইকোর্ট বলেছিল ২০১০ সালের পর দেওয়া সমস্ত ওবিসি শংসাপত্র বাতিল হবে। সেদিনও কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি রাজশেখর মান্থা এবং বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তীর ডিভিসন বেঞ্চ বলেছিল এই সময়ের মধ্যে ওবিসি শংসাপত্র নিয়ে যাঁরা চাকরি পেয়েছেন বা অন্যান্য সুযোগ পেয়েছেন তা বজায় থাকবে। ২০১০ সালের পর রাজ্যে সরকার গঠন করে (২০১১) তৃণমূল। আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেছে, ২০১২ সালে কোনও পদ্ধতি না মেনেই সংরক্ষণের আইন প্রণয়ন করেছে রাজ্যের আইনসভা। আদালত বলেছে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে তা ১৯৯৩ সালের ওয়েস্ট বেঙ্গল ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস ওয়েলফেয়ার কমিশনের আইনের পরীপন্থী। ২০১০ সালে ওয়েস্ট বেঙ্গল ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস ওয়েলফেয়ার কমিশনের একটি অন্তর্বর্তী রিপোর্টের ভিত্তিতে পশ্চিমবঙ্গে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির তালিকা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ২০১২ সালে যে আইন তৈরি হয় সেখানে কমিশনের কোনও চূড়ান্ত রিপোর্ট গৃহীত হয়নি। তৃণমূল সরকার ওয়েস্ট বেঙ্গল ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস ওয়েলফেয়ার কমিশনকে বাদ দিয়ে সরকারের হাতে সমস্ত ক্ষমতা নিয়ে নেয় এবং আইন প্রণয়ন করে। ওবিসি শংসাপত্র দেবার সমস্ত ক্ষমতা সবটাই রাজ্য সরকারের হাতে চলে যায়। বাদ দিয়ে দেওয়া হয় কমিশনকে। কলকাতা হাইকোর্ট ২০১২ সালের তৈরি ওই আইনের বেশ কিছু অংশ বাতিল করার ফলেই প্রায় ১২লক্ষ ওবিসি শংসাপত্র বাতিল হয়ে যায়। ২০১২ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত যে ওবিসি শংসাপত্র দেওয়া হয়েছে তা ওয়েস্ট বেঙ্গল ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস ওয়েলফেয়ার কমিশনের সুপারিশ ছাড়াই। ফলে হাইকোর্ট এই সময়ের মধ্যে প্রদেয় ওবিসি শংসাপত্র বাতিল করার নির্দেশ দিয়েছিল। কলকাতা হাইকোর্টের এই নির্দেশের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করেছে। সেই মামলা শীর্ষ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
OBC Reservation
হাইকোর্টে ফের ধাক্কা খেল রাজ্য, ওবিসি সংরক্ষণ মামলায় স্থগিতাদেশ

×
Comments :0