নতুনপাতা | ইচ্ছে
বিমূর্ত ঘেঁটু — মূর্ত ঘেঁটু গান
মনীষ দেব
তখন হোগলা পাতার মাদুরে, লণ্ঠনের আলোয় চারদিক খোলা বারান্দায় বসে পড়ি 'আবদুল মাঝির গপ্পো', সেটা ফাল্গুন না চৈত্র তার হিসেব ছিল না। বাইরে ঘন অন্ধকারে ঝিঁঝিঁর ডাক আর জোনাকির আলো, সেই অন্ধকার আর নিস্তব্ধতাকে ভেঙে এল — 'ঘেঁটু গান'। প্রায় হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। চৌদোল মাথায় একদল ছেলে আর পিঠোপিঠি দিদিরা সারি দিয়ে গাইছে —
ঘেঁটু ফুল ফুটে আছে ওই যে বন আলো করে,
ফুলগুলি সব দেখতে ভালো সাদা আর নীল কালো...।
লণ্ঠনের নিভু নিভু আলোয় পথ চলে ওরা পৌঁছে গেল রাঙাদিদুদের বাড়ি-মা, মা, দেখ না মা —
ঘেঁটু এসেছে তোমারি দুয়ারে, ঘেঁটু ছিল মাগো, ভাট ফুলেরি বনে অতি যতনে।
বসন্তেরই হাওয়া পেয়ে এলো যে এখানে, আমরা বাচ্চা-কাচ্চারা আনন্দেতে পুজছি যতনে।
ওমা, ঘেটুকে যে নিন্দা করে, সে খোসের জ্বালায় জ্বলে মরে গো।
আশৈশব আমি খুঁজে ফিরেছি নীল বা কালো ঘেঁটুফুল যার দেখা আমি আজও পাইনি।
ঘেঁটু গানের আবেগ-উচ্ছ্বাস আজও দোলা দিয়ে যায়। একটু বড় হতে হতে বুঝেছিলাম, উত্তরা, উজ্জ্বলা, তিলকা, বিশখা, যারা লোকের বাড়িতে কাজ করে তারাই ফাগুনের শেষে ও চৈত্রের প্রথম তিনদিন আসতো 'ঘেঁটু গান' শোনাতে। চাল-ডাল- তেল-নুন-আলু-পটল এবং পয়সাকড়ি 'সিধা' হিসাবে 'আদায়' করে, পর্বান্তে করতো বনভোজন, মূলত ঘুঘু, বর, গায়েন, মণ্ডল, হাজরা, সামন্তদের পাড়া থেকে আসতো 'ঘেটু গান। এরাই হাওড়া জেলার আদিবাসিন্দা। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মধ্যে বসবাস, অশিক্ষা, অপরিচ্ছন্নতা, খাল-বিলের দূষিত জল ব্যবহার থেকে সৃষ্ট খোস-পাঁচড়া থেকে মুক্তির জন্যই ওরা করতো 'ঘেঁটু পুজন'। আমাদের শৈশবে পশ্চিম গাঁয়ের ঘুঘুপাড়া থেকে বক-শিয়ালের মাঠ পেরিয়ে আসত চৌদোলায় চেপে ঘণ্টাকর্ণ / ঘাঁটু বা ঘেঁটুমহারাজ আপ্যায়নের কোমল সুরে —
এসেছে ঘেঁটুরাজ বাবুদের সদর বাড়িতে-বাড়ির সকলে মিলেমিশে করলে দান,
ঘেঁটুরাজের নামেতে, ছেলেপুলে নাতিপুতি বছরভর থাকবে কুশলেতে।
কোরো না ভাবনা, হবে না চুলকণা, ঘেটুর নাম করলে স্মরণ মিটবে সকল যাতনা।
পাশাপাশি ঘেঁটু, বিদায়ের গানও শুনেছি বলরাম, হরেকৃষ্ণ, লব, কুশ, তরেনদের গলায় —
ঘেঁটু তুমি নিজে চাষা বুদ্ধিনাশা,
ঘোল খেতে চাও মাখন ছেড়ে, তোমার মাথাটি দেবো মুড়িয়ে,
ঘোল ঢালবো গাধার পিঠে চড়িয়ে, তখন তুমি মুখ দেখাবে কেমন করে?
ঘেঁটু এবার তুমি মানে মানে নিজস্থানে গমন করো ধীরে ধীরে।
ঘেঁটু পূজা ভক্তিতে নয় ভয়ে, খোস-পাঁচড়া শীত শেষের চর্মরোগ হওয়ার ভয়ে। শুধু পূজা পার্বণে যে মুক্তি মেলে না সেই উপলব্ধি থেকে আছে আশাভঙ্গের গান —
এ বছরের পূজার কথা আমায় বোলো না,
খোঁসের জ্বালাতে দিদি প্রাণ তো বাঁচে না।'
'ঘেঁটু গান' হাওড়ার চারশো বছরের নিজস্ব লোকসংস্কৃতি হলেও, এক সময় রাঢ় — বাংলায় একপ্রকার গণ-উৎসবের রূপ নেয় 'ঘেঁটু পূজা' ছাড়িয়ে 'ঘেঁটু গান' সমকালীন সমাজের দর্পণ হয়ে উঠে। লোকমানসের জীবন যন্ত্রণার দলিল ঘেঁটু গানের অসামান্য ব্যবহার দেখি তারাশঙ্কর-এর 'গণদেবতা' উপন্যাসে বাংলায় ব্রিটিশ আমলের জরিপ ইতিহাসের প্রতিবাদ ধ্বনিত হয় সমসাময়িক ঘেঁটু গানে। স্বাধীনতার পর বদলে যায় ঘেঁটু গানের প্রেক্ষিত —
ও ঘেটু দায় হলো আজ, বাঙালীদের বসতি করা উপায় বিধান করো ঘেঁটু,
নইলে আজ যাই যে মারা। আসাম আজ বাঙালী খেদায়,
উড়িয়ারাও ছেড়ে না দেয়, ঘরে বাইরে খেয়ে তাড়া, হচ্ছি যে মোরা আধমরা।
কিন্তু এক অখ্যাত 'ঘেঁটু' কীভাবে জোগায় প্রতিবাদের ভাষা সে জিজ্ঞাসা আমার রয়েই গেছে।
যে ছেলেমেয়ের দল পাঠশালা পেরিয়ে স্কুল মুখো হয়নি খাল বিলে মাছ ধরেছে, লোকের বাড়ি কাজ করেছে সেই লব, কুশ, বিশখা, তিলকা, যতনদের গলায় প্রতিবাদের সুর হিসাবে ঘেঁটু গান শুনে ওই 'বয়সে অবাক হতাম, ওরা অনায়াসে গেয়ে দিত মা কাকীরা অনুরোধ করলে —
ও ঘেঁটু, দেশের একি হাল হলো আজ, দেখে যে বাঁচি না!
যখন তখন হচ্ছে যে ভোট, আমরা ভুগি যন্ত্রণা।।
ভোটের আগে হায়, মোদের সবাই ভালো চায়,
ভোট ফুরালে মোদের কথায়, কেহ আমল নাহি দেয়।।
সংসার জ্বলন্ত, প্রাণ রাখতে প্রাণান্ত, এখন নুন আনতে পান্তা ফুরায়, স্বই যে বাড়ন্ত।।
চায়ের চিনি নাই, ডিজেল কোথায় পাই, কেরোসিনও নাই,
না-ই, না-ই রে নাই, নাই-নাইয়ের গুঁতোয় পড়ে, আমরা কোথায় যাই।
পাশের বাড়ির পিসিরা ওদের সাথে গলা মিলিয়ে গাইতো —
হিল্লী দিল্লী আছে সুখে, আমরা মরছি ধুকে ধুকে ভগবানও মারছে মোদের, হয় বন্যা নয়তো খরা।।
সবাই চলে খোলামেলা, আমরা বাসে বাদুড়ঝোলা, এবার ঘুচবে বুঝি ভবলীলা, ঘেঁটু, তা ভেবে হই আমরা সারা।
স্কুলে পড়ার সময়ই ঘেঁটু গানের সমাজভাবনা আমাকে আলোড়িত করেছিল। জানার চেষ্টা করতাম ঘেঁটুকে? তার আদি-অন্ত। প্রথম জেনেছিলাম ঘেঁটু চর্মরোগের দেবতা, স্বর্গের দেবকুমার অভিশপ্ত হয়ে পিশাচকুলে জন্ম। অবাক হয়ে ভাবতাম পিশাচকুলে জন্ম ঘেঁটুকে নিয়ে এত উন্মাদনা, এত গান, এত বিচিত্র ভাবনা, তাঁর আকার প্রকৃতি জানার কৌতূহল? পরে জানলাম ঘেঁটুর জন্য কোনো দেবাসন নেই জলার ধারে, তেমাথায় মুড়ি ভাজার খোলা বা ভাঙা হাঁড়িতে ঘেঁটু পূজা হয়। গোবর দিয়ে তৈরী হয় ঘেঁটু মূর্তি কপালে সিঁদুর কড়ি দিয়ে চোখ অদ্ভুত বিমূর্ত, শুধু মূর্ত তার গান 'ঘেঁটু গান'। ভূত, প্রেত, পিশাচ, অপদেবতা বিদায়ের মতো ঘেঁটুর বিদায় করুণাদায়ক হলেও, তাকে নিয়ে রঙ্গ-ব্যঙ্গও যথেষ্ট অর্থবহ-দেখবে যদি নগরবাসী এসো সত্বরে, ঘেঁটু রাজা বিয়ে করে, বৌ নিয়ে যে আসছে ঘরে। পণপ্রথার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা সমাজভাবনার দলিল। ঘেঁটুর কনের দেখলে দশা, আমাদের হয় ভয়, পাওনার লোভে করলে বিয়ে এমন দশাই তো হয় —
বাবু সোনা নিয়েছে তিরিশ ভরি, নিয়েছে এক অ্যাম্বাস্যাডার গাড়ি, ফ্রিজ, আলমারি, কালার টিভি,
ঘেঁটু ছাড়বার পাত্র নয়। ওদিকে, মেয়েটির বয়স নয় অধিক,
চল্লিশ কিংবা হয়েছে চুয়াল্লিশ, চুলগুলিতে পাক ধরেছে, দাঁত হয়েছে ক্ষয়।
গায়ের রঙে তার চৌদিক আলো, আলকাতরা বলে আছি ভালো....
'ঘেঁটু গান' বা 'ঘেঁটু' একটা প্রতীক, সামগ্রিক সমাজের প্রতিনিধিত্ব করছে এই গান, যা সমাজের চলমান যাত্রাপথ, যা কখনও থেমে থাকেনি। যেভাবে সমাজ বদলেছে সেই পথেই বদলে গেছে 'ঘেঁটু গান'। গ্রামীণ সমাজ থেকে নাগরিক সমাজে পৌঁছে গেছে 'ঘেঁটু গান' তার নিজস্বতা নিয়ে। আধুনিক সমাজ ও বৈদ্যুতিন যুগের সঙ্গে হয়তো পাল্লা দিতে পারছে না এই গান কিন্তু চারশো বছরের অধিক সময় নিয়ে এগিয়ে যাওয়া, এই সমাজদর্পণ কখনো অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে না। দশ, বারো বছরে শোনা যে গানটা আজও সাম্যের প্রতীক হয়ে স্মৃতিপটে জেগে ওঠে বারবার, 'ঘেঁটু গান' বলে সেই গানটা চির আশ্রয় হয়ে থাকবে আমার কাছে —
পঁচাখালে জল এসে ভাই মশা বেড়েছে,
কী মশা এলোরে ভাই স্বাধীন ভারতে।
বড়লোক ছিল যারা মশারী টাঙালো তারা,
গরিবলোক ছিল যারা মশার কামড়ে মরলো তারা... *
Comments :0