Editorial

ন্যায় বিচারের আকাশে কালোছায়া

সম্পাদকীয় বিভাগ

হামেশাই নেতা-মন্ত্রী প্রভাবশালীরা বলে থাকেন আইন আইনের পথে চলবে। কিন্তু বাস্তবে সত্যিই কি আইন আইনের পথে চলে? নাকি চলতে দেওয়া হয়? বিচারও কি বিচারের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চলে? তাকে নানাভাবে মন্থর বা স্থবির করার অথবা বিপথগামী করার চেষ্টা হয় নাকি? প্রশ্নগুলি সাধারণ মানুষের মনে প্রতিনিয়ত ঘোরা ফেরা করছে। কিন্তু তার উত্তর দেবার দায়িত্ব যাদের বাস্তবে তারাই যেহেতু প্রশ্নের কারণ তাই সদুত্তর পাবার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে দেশ যদি সত্যি সত্যি গণতান্ত্রিকভাবে শক্তিশালী হয় এবং নাগরিকরা গণতন্ত্র সচেতন হন তাহলে উত্তর খুঁজে বার করতে হবে নাগরিকদেরই। শাসকদের বাধ্য করতে হবে সদুত্তর দিতে এবং এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে এমন প্রশ্নের অবকাশ না থাকে।
আসলে আইন আইনের পথে চলতে পারে এবং বিচার প্রক্রিয়া তার নির্দিষ্ট পথে এগতে পারে তখন যখন কি রাজ্য কি কেন্দ্রীয় যে কোনও তদন্ত সংস্থা স্বাধীনভাবে ১০০ ভাগ আইন মোতাবেক তদন্ত করতে পারে। সরকার বা শাসক দলের প্রভাব বা চাপ তাদের ওপর খাঁড়ার মতো না ঝোলে ‘শাসক দল তথা নেতা-মন্ত্রী-প্রভাবশালীদের চাপের কাছে মাথা নত করে তাদের হুকুম মতো তদন্ত করতে বাধ্য হতে না হয়। তেমনি বিচার ব্যবস্থা ১০০ ভাগ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত না হলে ন্যায় বিচার অসম্ভব। তাতে নিরপরাধের সাজা হতে পারে রাজনৈতিক রোষানলের কারণে তাদের আসল অপরাধী শাসক সৌজন্যে থেকে যেতে পারে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
তদন্ত বিভাগ ও বিচার বিভাগের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব প্রবলভাবে বাড়ছে। তদন্ত বিভাগ সরাসরি তথা শাসকদলের নির্দেশে চলছে। বিচার বিভাগ রাজ‍‌নৈতিক প্রভাবমুক্ত বলে ধরে নেওয়া হলেও ইদানিং সেখানে রাজনৈতিক প্রভাব প্রবল। নজর এড়াচ্ছে না দলীয় আসক্তির ইঙ্গিত। শাসকদলের মনোভাব ও প্রত্যাশার সঙ্গে বিচার ব্যবস্থার সাযুজ্য দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে। ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারতের সর্বোচ্চ আদালত এখন যুক্তি-তর্ক, তথ্য-প্রমাণ সরিয়ে রেখে ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে রায় দেয়। অবসরের পর সেই বিচারপতিরা রাজনৈতিক ক্ষমতার পুরস্কার পায়। আদালতের মধ্যেই কোনও কোনও গুরুতর অভিযুক্ত রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের স্বস্তি দেবার প্রয়াস বিস্ময় জাগায়। আবার কোথাও শাসকদলের সম্ভাবনাময় ভাবী নেতাকে ডিস্টার্ব না করার পরামর্শও শোনা যায়। ক্রমাগত আইনি জটিলতা বাড়িয়ে বিচারকে বিলম্বিত বা দীর্ঘায়িত করা বা বিশ বাঁও জলে ডোবানোর প্রয়াসও জনসাধারণের দৃষ্টি এড়াচ্ছে না। সাধারণ মানুষের লক্ষ লক্ষ মামলা বছরের পর বছর ঝুলে থাকলেও শাসকদলের চুরি-দুর্নীতির মামলাগুলিকে হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্টে মাকুর মতো ঘোরানো হচ্ছে চোর নেতাদের আড়াল করার জন্য। একক বেঞ্চের রায় বের হতে না হতেই ডাবল বেঞ্চে তা স্থগিত হয়ে যাচ্ছে। চোর বাঁচাতে সরকার সকাল বিকাল দৌড়াচ্ছে সুপ্রিম কোর্টে। চোর ও চুরির স্বার্থ রক্ষা করতে সরকার খরচ করছে শত শত কোটি টাকা।
সদ্য কলকাতা হাইকোর্টে ঘটে যাওয়া নজিরবিহীন ঘটনায় তদন্ত সংস্থা ও বিচার ব্যবস্থায় রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে দুঃ‍‌শ্চিন্তা ও উদ্বেগ কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। ২০১৬ ও ২০২০ সালে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির মামলায় স্বচ্ছতার জন্য সিঙ্গল বেঞ্চ সম্পূর্ণ প্যানেল প্রকাশের নির্দেশ দিলে ডাবল বেঞ্চ সেই রায়ের কপি না দেখে এমনকি লিখিত আবেদন ছাড়াই কেবলমাত্র সরকারি উকিলের মুখের কথায় তৎক্ষণাৎ স্থগিতাদেশ দিয়ে দিলেন। পরে সিঙ্গল  বেঞ্চের বিচারপতি সেই স্থগিতাদেশকে অবৈধ বলে বাতিল করে নিজের আদেশ বহার রাখলেন। পাশাপা‍‌শি প্রকাশ্যে এসে যায় এক ভয়ঙ্কর ঘটনা। ভাইপোর বিরুদ্ধে মামলা খারিজ করার, সম্ভাবনাময় ভাবীকালের নেতা ভাইপোকে ডিস্টার্ব না করার, ভাইপোর মামলার লাইভ স্ক্রিনিং না করার নির্দেশ সিঙ্গল বেঞ্চের এক বিচারপতিকে দিয়েছিলেন এ‍‌ই ডাবল বেঞ্চের বিচারক। এই বিচারকেরই কয়েক বছর আগে ওডিশায় বদলে হলেও আজও তা কার্যকর হয়নি অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে। বোঝাই যাচ্ছে আদালতে কোনও এক অদৃশ্য শক্তি শাসকদলের হিতাকাক্ষী হয়ে চোরেদের রক্ষা করার কাজ করছে।
তদন্ত ও বিচার এক অপরের পরিপূরক। তদন্ত তদন্তের পথে না এগলে বা আইন আ‍‌ইনের পথে না হাঁটলে বিচারও বিচারের পথে হাঁটতে পারে না। ন্যায় বিচার প্রসবের আগেই তার গর্ভপাত অনিবার্য।

Comments :0

Login to leave a comment