Editorial

দিল্লিতে মানুষ উচ্ছেদের উৎকট অভিযান

সম্পাদকীয় বিভাগ


জি-২০’র বৈঠক চলছে রাজধানী নয়াদিল্লিতে। বিশ্বের শীর্ষ নেতারা এসেছেন, কূটনীতিকরা এসেছেন, সাংবাদিকরাও এসেছেন। নিরাপত্তার প্রয়োজন আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু সেই অজুহাতে দিল্লিকেৃ বানিয়ে ফেলা হয়েছে এক অবরুদ্ধ নগরী। চলছে অঘোষিত লকডাউন। জনমানবহীন শূন্য রাস্তা স্বাগত জানাচ্ছে অতিথিদের। সাজানো হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে। অভিযোগ উঠেছে, সাজাতে গিয়ে দিল্লির ঐতিহ্যবাহী স্মারকগুলিকেও বিশ্রী ভাবে ঢেকে দেওয়া হয়েছে বা সাজ পরিবর্তন করা হয়েছে। 
ভারত জি-২০’র এবারের সভাপতিত্ব পেয়েছে। কারোর কৃতিত্ব না, এই পদ আবর্তিত হয় সদস্যদের মধ্যে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মোদী একেই দেখাচ্ছেন তাঁর কৃতিত্ব বলে। যা করার তিনি একাই করছেন। দিল্লিকে ‘মোদীময়’ করা হয়েছে। তারই সঙ্গে দিল্লির প্রকৃত বাস্তবতা যাতে বিদেশিদের চোখে না পড়ে তার জন্য উৎকট অভিযান চালানো হয়েছে। এই বাস্তবতার মধ্যে রয়েছে দরিদ্র মানুষের আবাস, বস্তি, কলোনি। রাজধানী দিল্লিতে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা অন্তত দেড় লক্ষ। জি ২০’র বৈঠককে সামনে রেখে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে দিল্লিতে শুরু হয়েছে বুলডোজার শাসন। ‘বেআইনি দখলদারি’ হটানোর অজুহাতে দিল্লি থেকে ধাপে ধাপে মুছে ফেলা হয়েছে গরিব মানুষের আবাস স্থলগুলিই। পথের দোকানপাট গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, ভেঙে দেওয়া হয়েছে বাড়িঘর। জীবিকা থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে কয়েক হাজার মানুষকে। ধারণা করা হচ্ছে, স্থায়ীভাবেই তা করা হয়েছে। এরা আর কোনোদিনই ফেরত পাবে না থাকার জায়গা, সামান্য রুজির সুযোগ। 
যা ভেঙে ফেলা হয়নি তা ঢেকে রাখা হয়েছে কাপড় মুড়িয়ে। রাস্তা দিয়ে গেলে দেখা যাবে চাদরে ঢাকা, রঙিন মোড়কে ঢাকা বিস্তীর্ণ অঞ্চল। আসলে তার পিছনেই বস্তি বা নিম্নবিত্তের পাড়া। যেন এইসব কিছুই দিল্লিতে নেই। মুশকিল হলো দেশের অধিকাংশ বাণিজ্যিক সংবাদমাধ্যম এই চিত্র তুলে না ধরলেও বিদেশি সংবাদমাধ্যমে আরও প্রকট হয়ে গেছে মোদীর ‘নয়া ভারত’। ফরাসি এক দৈনিকে লেখা হয়েছে, ‘লিখেছে, ‘মোদী ভারতকে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম শক্তি বানানো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আর তার সেই ল্যান্ডস্কেপকে নষ্ট করতে পারে এমন কিছু নির্মূল করতে কোনোরকম খরচ করতেই ছাড়েননি তিনি: ছোটখাট দোকান, হোক বা রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো কুকুর, কিংবা বাঁদরের দল- সকলকে তাড়ানো হয়েছে। ট্রাফিক সিগনালে যে বাচ্চাগুলি ভিক্ষে করে, তাদেরও চলে যেতে বলা হয়েছে। অন্তত ২৫টি বস্তি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষকে উৎখাত করা হয়েছে, কোনও বিকল্প মাথা গোঁজার জায়গা ছাড়াই। এই মানুষগুলি তাঁদের জীবিকা হারিয়েছেন।’ এই ধরনের কাজ দক্ষিণপন্থীরাই করে থাকে। দারিদ্রকে অস্বীকার করে তারা দরিদ্র মানুষকেই মুছে দিতে চায়। ঠিক এই কথাই প্রতিফলিত হয়েছে ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকার প্রতিবেদনে। তারা লিখেছে: ‘প্রধানমন্ত্রী মোদী আসলে ডোনাল্ড ট্রাম্প, ফ্রান্সের লি পেন কিংবা হাঙ্গেরি ভিক্টর আরবানের মতাদর্শকেই বেছে নিয়েছেন।’ এই তিনজনই কুখ্যাত অতি দক্ষিণপন্থী। 
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, দিল্লি থেকে সামান্য দূরে নুহতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরে গুরগাঁওয়ে সংখ্যালঘুদের উচ্ছেদ করা হয়েছে বুলডোজার চালিয়ে। সেখানের বস্তির মানুষ দলে দলে পালিয়ে এসেছেন। এমন এক পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে যে গুরগাঁওয়ে সংখ্যালঘুরা হয় থাকতে চাইছেন না, বা তাঁদের প্রতিবেশীরাও তাঁদের চলে যেতে বলছেন। দিল্লিকে সাজানোর নামে আর সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের নামে উচ্ছেদের এই সমান্তরাল ঘটনাই একই মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ।

Comments :0

Login to leave a comment