Kalighat uncle

কাকুর ‘সাহেব’-কে আড়ালের চেষ্টা শুরু হয়ে গেল

কলকাতা

 

‘কালীঘাটের কাকু’ ওরফে সুজয় কৃষ্ণ ভদ্রের ‘সাহেব’ রাজ্যের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তি। নিয়োগ দুর্নীতিতে তাঁর নাম প্রকাশ্যে চলে আসার পরে সুজয় ভদ্র সংবাদমাধ্যমের কাছে দাবি করেছিলেন, ‘কুন্তল ঘোষ কি আমার নামে বলেছে, এটা দেখাতে পারবেন কেউ?’
ইঙ্গিত ছিল স্পষ্ট। ‘সাহেবের’ ক্ষমতার হাত কতদূর বেশ জানে যুব তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক নিয়োগ কাণ্ডে ধৃত কুন্তল ঘোষও। 
তাই কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার জেরায় স্বীকার করলেও সংবাদমাধ্যমের কাছে এদিন এই ধৃত যুব তৃণমূল নেতা পরিকল্পিতভাবে বিভ্রান্তি তৈরির চেষ্টায় দাবি করেন সুজয় ভদ্র নাকি সেই ‘কালীঘাটের কাকু’ নন। সাংবাদিকরা কুন্তলকে প্রশ্ন করেন, কালীঘাটের কাকু কি সুজয় ভদ্র? কুন্তলের জবাব,  ‘না। কাকু হল আমার বাবার ভাই’। যদিও পালটা তাপস মণ্ডল এদিন বলেন , ‘ও সব জানে, ওকেই জিজ্ঞাসা করুন।’
কালীঘাটের কাকু সামনে আসায় বিব্রত তাঁর ‘সাহেব’ অভিষেক ব্যানার্জি। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই নিয়োগ দুর্নীতি কাণ্ডের তদন্তে এবার তৃণমূলের শীর্ষ প্রভাবশালীকে আড়াল করার যাবতীয় চেষ্টা শুরু হয়েছে শাসক দল ও প্রশাসনের তরফে। ইতিমধ্যেই সুজয় ভদ্র দাবি করেছেন তাঁর সাহেবকে পৃথিবীর কারো ছোঁয়ার ক্ষমতা নেই।
সুজয় ভদ্র রীতিমত রহস্যজনক চরিত্র হয়ে উঠেছে এখন নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে। নিজেকে ‘সামান্য’ ব্যক্তি বলে দাবি করা সুজয় ভদ্র অভিষেক ব্যানার্জির পারিবারিক সংস্থা  ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস’র ডিরেক্টর বনে গিয়েছিলেন। দুবছরের বেশি সময় ধরে ডিরেক্টর ছিলেন। আবার সেই ব্যক্তি এখন অভিষেক ব্যানার্জির সংস্থার কর্মী বলে দাবি করছেন। ডিরেক্টর থেকে কর্মী হয়ে যাওয়া এই ব্যক্তি আবার ২০১১’র বিধানসভা ভোটে ভবানীপুর থেকেই প্রার্থী হয়েছিলেন নির্দল হিসাবে। আসলে তৃণমূলের ডামি ক্যান্ডিডেট। আবার নারদ নিউজের স্টিং অপারেশনে সময় ম্যাথু স্যামুয়েলকে ক্যামাক স্ট্রিটের অফিসে এই সুজয় ভদ্রের সঙ্গেই দেখা করতে হয়েছিল অভিষেক ব্যানার্জির অ্যাপয়েনমেন্ট পেতে! সুজয় ভদ্র এখনও সলিটয়ার প্লেসমেন্ট সার্ভিসেস প্রাইভেট লিমিটেড নামক এক সংস্থার ডিরেক্টর। 
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার একটি সূত্রের দাবি, নিয়োগ দুর্নীতিতে বিপুল অঙ্কের টাকা লেনদেনের সঙ্গে সুজয় ভদ্রের যোগ রয়েছে এমন বেশ কিছু তথ্য সামনে এসেছে। আদৌ তাঁকে এবার তলব করা হবে কিনা তাই এখন প্রশ্ন। 
জেলায় জেলায় এজেন্টরা ছিল চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে টাকা তোলায়, অযোগ্যদের নামের তালিকা পাঠানোয়। আবার খোদ শীর্ষ প্রভাবশালী ব্যক্তির কাছ থেকেও আসত সরাসরি সুপারিশ। ভায়া ‘কালীঘাটের কাকু’র মাধ্যমে তা যেত পার্থ চ্যাটার্জি, মানিক ভট্টাচার্যের কাছে। আবার কুন্তলের মত জেলার দাপুটে এজেন্টরা নামের তালিকা পাঠাতেন কাকুর কাছে। কাকু তা পাঠাতেন একেবারে সঠিক ঠিকানায়। সুপারিশ পাঠানোর বিনিময়ে কুন্তল ঘোষদের মত যুব তৃণমূল নেতারা চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে টাকা তুলে তা পাঠাতেন কাকু সুজয় ভদ্রের কাছেই।
ইতিমধ্যে সিবিআই’র হাতে রয়েছে চাকরির নবম-দশম, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি, গ্রুপ-সি পদে চাকরির সুপারিশ সম্বলিত নথি। জানা গেছে, সুপারিশ সহ এমন অসংখ্য বান্ডিল মিলেছে, যেখানে পার্থ চ্যাটার্জির সইও রয়েছে! তা জমাও দেওয়া হয়েছে আদালতে। একেকটি বাণ্ডিলে কমপক্ষে দেড়শো থেকে দুশোটি এমন সুপারিশ সহ নিয়োগের নথি। বাণ্ডিলের ওপরে আলাদা কাগজে ‘রেকমেন্ডড’ বা ‘অ্যাপ্রুভড’ লিখে সেখানে সই রয়েছে। কালীঘাটের কাকুর সাহেবের অফিস থেকও এসেছিল একাধিক সুপারিশ।
এদিকে নিয়োগ দুর্নীতিতে ধৃত তাপস মণ্ডল, কুন্তল ঘোষ এবং নীলাদ্রি ঘোষকে বৃহস্পতিবার আলিপুর আদালতে পেশ করা হয়।
ইতিমধ্যেই সিবিআই হেপাজতে ধৃত কুন্তল ঘোষ ও তাপস মণ্ডলকে মুখোমুখি জেরায় বসানো হয়। দুজনের বক্তব্যেই অসঙ্গতি মিলেছে। তবে কুন্তল ঘোষ তাপস মণ্ডলের অধিকাংশ অভিযোগ এড়িয়ে গেছে। সিবিআইয়ের দাবি এর আগে জেরায় একাধিক তথ্য সামনে আনলেও প্রভাবশালী যোগ সম্পর্কে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন দুজনে। অথচ নিয়োগ দুর্নীতি নেটওয়ার্কের মাথায় যে প্রভাবশালী আছে তা তদন্তের গতিতেই স্পষ্ট। তবে লাগাতার জেরায় কিছু নতুন নামও সামনে এসেছে। ধৃত তিনজনের তরফেই আইনজীবীরা জামিনের আবেদন জানান। কুন্তল ঘোষের বিরুদ্ধে ওএমআর শিট বিকৃতির যে অভিযোগ উঠেছে তার সপক্ষে কোনো তথ্য প্রমাণ দেখাতে পারেনি বলে দাবি তাঁর আইনজীবীর। সিবিআইয়ের আইনজীবী এ-ও জানান যে কুন্তলকে মুখোমুখি বসিয়ে জেরা করে বেশ কিছু প্রভাবশালীর নাম পাওয়া গেছে। যদিও দীর্ঘ সওয়ালের পরে তিনজনেই জামিনের আবেদন খারিজ করে দেন আলিপুরে সিবিআই-এর বিশেষ আদালতের বিচারক। আগামী ৯ তারিখ পর্যন্ত তাঁদের জেলেই থাকতে হবে।
যুব তৃণমূল নেতা কুন্তল ঘোষকে গ্রেপ্তার করছিল ইডি, পরে হেপাজতে নেয় সিবিআই। এর আগে ইডি’ও আদালতে সাবমিশন করে জানিয়েছিল, পার্থ চ্যাটার্জির থেকেও বেশি প্রভাবশালী, ক্ষমতাবান ব্যক্তি রয়েছে এই নিয়োগ দুর্নীতির পিরামিডের মাথায়। ২০১৪’র টেট থেকে ২০২১ পর্যন্ত শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগ কেলেঙ্কারিতে যে বিপুল টাকার লেনদেন হয়েছে তা গেছে সেই ‘অত্যন্ত প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি’র কাছেই।
শিক্ষা ব্যবসায়ী তাপস মণ্ডল প্রথমে এবং পরে গোপাল দলপতি সংবাদমাধ্যমের সামনে জানিয়েছিলেন যে কুন্তলই তাঁদের বলত যে কালীঘাটের কাকুর কাছে যেতে, কালীঘাটের কাকুকে টাকা দিন। সুজয় ভদ্রই সেই কালীঘাটের কাকু।
এদিন যদিও নাটকীয়ভাবে আদালতে নিয়ে যাওয়ার পথে সাংবাদিকদের কাছে কুন্তল ঘোষ বলেন, গোপাল দলপতির স্ত্রী হৈমন্তী গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছেই সব টাকা রয়েছে, সে সব জানে। 
একটি চিটফাণ্ড মামলায় ২০২১ সাল থেকে দিল্লির তিহার জেলে বন্দি ছিলেন গোপাল দলপতি। সম্প্রতি জামিন পেয়েছেন। তাঁর আসল নাম আরমান গাঙ্গুলি। তাপস মণ্ডলের সঙ্গে যোগ ছিল তাঁর। জানা গেছে, তদন্তকারী সংস্থার জেরায় কুন্তল দাবি করেছে উত্তরবঙ্গের এক প্রভাবশালী নেতার পিএ’র এর অ্যাকাউন্ট থেকে গোপাল দলপতির স্ত্রীর কোম্পানির অ্যাকাউন্টে টাকা গেছে। এই হৈমন্তী গঙ্গোপাধ্যায় আবার শাসক দলের একাধিক বিধায়ক, নেতার ঘনিষ্ঠ বলেও জানা গেছে।

 

 

Comments :0

Login to leave a comment