Post Editorial

ক্রয়ক্ষমতা নেই, তাই বৃদ্ধির হার তলানিতে

সম্পাদকীয় বিভাগ

Post Editorial


ঈশিতা মুখার্জি 

২০২৩ সালে ভারতে জাতীয় উৎপাদনের আর্থিক বৃদ্ধির হার কমে আসছে। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার যদিও ভবিষ্যতে বুক ফুলিয়ে আর্থিক বৃদ্ধির হার কত বেশি হবে তাই নিয়ে ঢাক পিটিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু যেটুকু পরিসংখ্যান জানা যাচ্ছে তা ভবিষ্যতের সর্বনাশেরই ইঙ্গিত দিচ্ছে। সাধারণত দেশের জাতীয় উৎপাদনের আর্থিক বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের রোজকারের জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয় নয়। কিন্তু ২০২৩ সালে যে কারণে আর্থিক বৃদ্ধির হার তলানিতে নামছে, তা দেশের প্রান্তিক অংশের মানুষ, শ্রমজীবী এবং কৃষিজীবী মানুষের জীবনে বিপর্যয় নামিয়ে আনবে। অতীতে যখন আর্থিক বৃদ্ধির হার কমেছে বেড়েছে, তার চেয়ে এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। দেশের অর্থমন্ত্রী বাজেট পেশ করার সময়ে গর্ব করে ঘোষণা করেছিলেন যে কোভিড পরবর্তী সময়ে অর্থনীতিকে পুরোপুরি আগের জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে। সর্বত্র শোনা গেল যে আমাদের দেশ নাকি আর্থিক বৃদ্ধির হারে চীনকেও পিছনে ফেলে দিয়েছে। আমাদের নাকি কোনও দুশ্চিন্তা নেই— এমনই আশ্বাস দিচ্ছেন অর্থমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু ঘনিয়ে আসা মন্দার ছায়া এভাবে আটকানো যায় না।

কয়েকদিন আগে প্রাক্তন রিজার্ভ ব্যাঙ্ক গভর্নর রঘুরাম রাজন বলেন যে দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার ক্রমেই বিপজ্জনক ভাবে “হিন্দু আর্থিক বৃদ্ধির হার” ছুঁতে চলেছে। “হিন্দু আর্থিক বৃদ্ধির হার” এই শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেন ১৯৭৮ সালে অর্থনীতিবিদ রাজ কৃষ্ণ। ১৯৪৭ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার ৩.৫% থেকে ৪% -এর মধ্যে থাকত। নয়া উদারীকরণের প্রবক্তারা নয়া উদারীকরণের সপক্ষে যুক্তি দিয়ে এমনটাই বলত যে আর্থিক বৃদ্ধির হারকে এই তলানি থেকে উদ্ধার করার জন্যই বিশ্বায়ন প্রয়োজন। ২০২৩ সালে পরিপ্রেক্ষিত সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখন “হিন্দু আর্থিক বৃদ্ধির হার” প্রাক নয়া উদারীকরণের দুনিয়ার অর্থনীতির কথা বলছে না, বলছে শুধু তলানিতে ঠেকে যাওয়া আর্থিক বৃদ্ধির হারের কথা। কোভিডকে অজুহাত করে বহুদিন বিজেপি সরকার দেশের এই আর্থিক অধোগতিকে আড়াল করেছিল। আড়াল করেছিল এই তথ্য যে কোভিডের আগেই অর্থনীতির অবস্থা  যথেষ্ট খারাপ ছিল। এখন যদি সেই অবস্থায় অর্থনীতিকে ফিরেও যায়, তাও দেশের মানুষের পক্ষে তা সুখবর নয়। দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার ২০২০ সালের আর্থিক বছরে ছিল ৩.৭৪%। ২০১৮ সালে থেকে ৬% আর্থিক বৃদ্ধির হার থেকে তা ক্রমাগতই নিচের দিকে নেমে এসেছিল। দেশের মধ্যে আর্থিক বৈষম্য বাড়ছিল; ক্ষুধা, অনাহার বাড়ছিল, দারিদ্র, বেকারি বাড়ছিল। কিন্তু অন্যদিকে কোটিপতিদের সংখ্যাও বাড়ছিল যারা কোভিডের সুযোগ নিয়ে তাঁদের সম্পদ বাড়িয়ে নিয়েছিল। আদানি-আম্বানিদের একাধিপত্য কায়েম হয়ে গেল এই সময়ে।

এই পরিস্থিতিতে আর্থিক বৃদ্ধির হার তলানিতে ঠেকে গেলে তার ফল তো ভুগতেই হবে সাধারণ মানুষকে বিশেষ করে শ্রমজীবী, কৃষিজীবীদের। যেহেতু অতিমারীর আগে বৃদ্ধির হার কম ছিল, তাই সামান্য উৎপাদন বাড়লেই সেই বৃদ্ধির হারের তুলনায় তা বেশি হয়; এটাই গাণিতিক নিয়ম। কিন্তু শ্লথ উৎপাদন শ্লথই থেকে গেছে। দেশের মানুষ কাজ হারিয়েছে; তাঁদের আয় কমেছে; তাঁদের মাথা পিছু ব্যয়ও কমে গেছে। দেশের ভিতরে চাহিদা কমে গেছে। অন্যদিকে অতিমারীর প্রভাবে জোগানও পিছনের দিকে। এই সাঁড়াশি টান উৎপাদনকে নিচের দিকে টানছে। বিজেপি সরকার তো অর্থনীতির বাস্তবকে মানুষের কাছ থেকে আড়াল করে রেখেছে এবং বাস্তব পরিস্থিতিকে অস্বীকার করেছে- এর প্রমাণ বহু আগে থেকেই পাওয়া গেছে। এখনো সেই কাজই তারা করছে।

তলানিতে নামা আর্থিক বৃদ্ধির পিছনের পরিসংখ্যান খতিয়ে দেখলে বোঝা যায় বিপদ কোথায়। ২০২২-২৩ আর্থিক বছরে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন যে আর্থিক বৃদ্ধির হার দাঁড়াবে ৭%। কিন্তু জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তরের ২০২২-২৩ আর্থিক বছরের পরপর বছরের তিন মাসের চতুর্থাংশের অর্থাৎ কোয়ার্টারের আর্থিক বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ১৩.২%, ৬.৩% এবং ৪.৪%। সঙ্কট এখানেই যে আর্থিক বৃদ্ধি হলেও তার হার ক্রমেই নেমে আসছে দ্রুত হারে। মুডি বিনিয়োগ, যারা বিনিয়োগের স্বার্থে বিভিন্ন দেশের আর্থিক বৃদ্ধির অনুমান করে, তারা জানিয়েছিল ২০২৩ সালে আর্থিক বৃদ্ধির হার হবে ৪.৮%। তারা কিছুদিন আগে এই অনুমানকে সামান্য বাড়িয়ে ৫.৫% -এ নিয়ে গেছে। কিন্তু কোনও অবস্থাতেই তা সরকারি অনুমানের ৭% নয়। এই ধরনের সমস্ত অনুমান যে কথা জানাচ্ছে যে এই আর্থিক বৃদ্ধির শ্লথ গতির কারণ দেশের রপ্তানি কমে যাওয়া এবং দেশের অভ্যন্তরে ভোগ্যপণ্যের চাহিদা কমে যাওয়া। এর সঙ্গে রয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সুদের হার বাড়ানো এবং অনিয়ন্ত্রিত হারে মুদ্রাস্ফীতি। দেশের অধিকাংশ মানুষের হাতে টাকা নেই এবং এই কারণেই দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার মূলত তলানিতে ঠেকছে এই বাস্তবকে অস্বীকার করে দেশের মানুষকে বাঁচানো যাবে না।            

কীভাবে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা সাম্প্রতিক কয়েকটি পরিসংখ্যান স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছে। ২০২২-২৩ আর্থিক বছরের প্রথম তিনটি চতুর্থাংশে অর্থাৎ ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে জুন , ২০২২ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর এবং ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাসে কারখানাজাত শিল্পপণ্যের মোট মুল্যযুক্ত উৎপাদন বা মোট উৎপাদন কিন্তু দাঁড়িয়েছে ৬,৩৯,২৪৩ কোটি, ৬,২৯,৭৯৮ কোটি, এবং ৬,১৪,৯৮২ কোটি। এই পরিসংখ্যান চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে উৎপাদন কমছে। উৎপাদন হ্রাসের হার প্রথম তিন মাসে ১% হলেও পরের তিন মাসে হয় ২%। দ্রুত হারে কারখানাজাত শিল্পপণ্য উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। শ্রমিকের সংখ্যা, মজুরি এই দুইই কমছে এর ফলে। মারাত্মকভাবে কমে আসছে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জলের মোট মূল্যযুক্ত অর্থাৎ মোট উৎপাদন। প্রথম তিন মাসে তা ছিল ৯০,১৩৪ কোটি টাকা। পরের তিন মাসে তা হলো ৮৭,৪৮৯ কোটি টাকা, এবং তার পর হলো ৮১,৫৩৭ কোটি টাকা। এখানেও উৎপাদন হ্রাস করে প্রথমে ২.৯% হারে, পরে ৬% হারে। দ্রুত হারে শক্তি উৎপাদন নেমে এসেছে। বিপদের আভাস এখানেই। উৎপাদন দ্রুত নেমে আসছে, বেকারি দ্রুত বাড়ছে, মজুরি দ্রুত কমছে এবং ভবিষ্যতে যে উৎপাদন বাড়বে, নতুন কর্মসংস্থান হবে এবং মজুরি বাড়বে এরকম কোনও ইঙ্গিত নেই এই পরিসংখ্যানে। এবার দেখা যাক দেশের ভিতরে ব্যক্তিগত ভোগ্যপণ্যের উপর ব্যয় অর্থাৎ মানুষের চাহিদার পরিসংখ্যান। তা মোটামুটি বছর ধরে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। আর্থিক বছর প্রায় শেষের দিকে। কি জাদু হয়েছে ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসে যে এই পরিসংখ্যান পুরো উলটে যাবে এবং ৭% আর্থিক বৃদ্ধিতে দেশ পৌঁছে যাবে? যেভাবে সত্যকে অস্বীকার করে এসেছে বর্তমান বিজেপি সরকার এবং যেভাবে আর্থিক পরিসংখ্যান নিয়ে কারচুপি করে এসেছে সবকটি কেন্দ্রীয় সংস্থা, তাই সেভাবে দেশবাসীর সামনে এই চলতি মাসের শেষে এবং এপ্রিল মাসের শুরুতে বা আগামী আর্থিক বছরের শুরুতে কিছু নতুন তথ্য সামনে নিয়ে আসতেই পারে যা থেকে দেশবাসী আশা দেখবে। কিন্তু তার আগের বাস্তব তো সামনে এসেই গেছে।


বিশ্বজুড়ে মন্দা ঘনিয়ে এসেছে। বিশ্বব্যাঙ্ক এবং আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার উভয়েই এই মন্দার কথা জানিয়েছে। দুটি মার্কিন ব্যাঙ্ক সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্ক এবং সিগনেচার ব্যাঙ্ক মুখ থুবড়ে পড়েছে। ফেডেরাল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কোনোমতে সুদের হার বাড়িয়ে আর্থিক অবনতিকে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। ইউরোপের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কও সুদের হার বাড়িয়ে দিয়েছে। মুদ্রাস্ফীতির হার অস্বাভাবিকভাবে ১০.৪% হয়ে গেছে। অর্থনীতির সমস্ত অনুমান জানাচ্ছে বিশ্ব আর্থিক বৃদ্ধির হার চলতি বছরে দাঁড়াবে ০.৪% এবং ২০২৩-২৪ এ হবে ১.২%। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মাত্র কয়েকদিন আগে জানিয়েছে যে ভারত এর ফলে প্রভাবিত হবে না । এখানে ঘটবে এমন ঘটনা (যা অর্থনীতিবিদেরা জানেন না) যার ফলে ৭% হারে এ দেশের মানুষ আর্থিক বৃদ্ধির হার প্রত্যক্ষ করবে! কীভাবে সম্ভব হবে ? উত্তর ছিল গাণিতিক নিয়মে। দেশের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এই তথ্য জানাচ্ছে। ওদিকে সিএমআইই জানাচ্ছে যে বৃদ্ধির হার কমবে । কিন্তু সরকারের মরিয়া চেষ্টা থাকবে দেখাতে যে দেশের অর্থনীতি আশাজনক। যে নিয়মেই বৃদ্ধি দেখাবে সরকার আগামী মাসের গোড়ায়, দেশের মানুষের বেঁচে থাকার প্রকৃত তথ্য কীভাবে আড়াল করবে সরকার?

আদানির কর্মকাণ্ড প্রকাশিত। দেশের বিজেপি সরকার কেন গদিতে বসে থাকার চেষ্টা করবে তা দেশের মানুষের কাছে স্পষ্ট। আদানির হাতে প্রায় দেশের সমস্ত পরিকাঠামো। নির্বাচনী বৈতরণী পার করবার গ্যরান্টি দিয়েছে নির্বাচনী বন্ড, যার বেশ অনেকটাই সূত্র আদানি। তাই তথ্যের কারচুপি, দেশের অর্থনীতি থেকে অন্য দিকে দৃষ্টি ঘোরানো এই সব আগামী দিনগুলিতে শুরু হতে চলেছে। বিশ্ব পুঁজিবাদ সঙ্কটে জর্জরিত। বিভিন্ন দেশ তাদের নিজস্ব অর্থনীতি বাঁচানোর চেষ্টা করছে এই বিপদের হাত থেকে। আমাদের দেশ ব্যতিক্রম। এমনিতেই জর্জরিত আর্থিক সঙ্কটে আমাদের অর্থনীতি  সরকার স্বীকার করুক আর না করুক। দেশের বেশিরভাগ জীবন-জীবিকা কীভাবে বাঁচবে, সে দিকে সরকারের হুঁশ নেই। বরং যারা দেশের সম্পদ লুট করছে, সরকার তাদের সুরক্ষা কবচে মুড়ে রাখছে। এটাই সম্ভব এক ফ্যাসিস্তপন্থী  দলের সরকারের পক্ষে; যতদিন যাচ্ছে বিজেপি সরকারের লুকানো অ্যাজেন্ডা প্রকাশিত হচ্ছে বিশেষ করে তার আর্থিক নীতিতে।                 
 

Comments :0

Login to leave a comment