Editorial

ঐতিহাসিক রায়, ঐতিহাসিক জয়

সম্পাদকীয় বিভাগ


বিলম্বে হলেও শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ মোদী সরকারের চালু করা নির্বাচনী বন্ডকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে খারিজ করে দিয়েছে। একই সঙ্গে বিগত ছয় বছর ধরে কে বা কারা, কোন তারিখে কত টাকার বন্ড কিনে কোন রাজনৈতিক দলকে দান করেছে তার পূর্ণাঙ্গ তথ্য ৬ মার্চের মধ্যে নির্বাচন কমিশনকে জানাতে নির্দেশ দিয়েছে স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়াকে। নির্বাচন কমিশন সেই তথ্য আগামী ১৩ মার্চের মধ্যে তাদের ওয়েব সাইটে প্রকাশ করবে। অর্থাৎ গোপনীয়তার আব্রু রচনা করে বৃহৎ কর্পোরেটের কাছ থেকে ঢালাও দান সংগ্রহের ছবিটি জনসমক্ষে এসে যাবে। জানা যাবে ছ’বছর ধরে কোন কর্পোরেট বা ধনকুবের মোদীর দলকে অঢেল টাকা সরবরাহ করেছে। এটাও স্পষ্ট হয়ে যাবে মোটা টাকার বিনিময়ে কোন কর্পোরেট মোদী সরকারের কাছ থেকে কী কী সুবিধা আদায় করেছে অথবা সরকারি সিদ্ধান্তে কীভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে।
২০১৭ সালের বাজেটে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি নির্বাচনী বন্ড চালুর কথা ঘোষণা করেন এবং রাজ্যসভায় বাধা পাবার আশঙ্কায় ফিনান্স বিল হিসাবে লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে পাশ করিয়ে নেন। নির্বাচন কমিশন এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তরফে আপত্তি উঠলেও সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি। দাতার নাম-পরিচয় গোপন রেখে যথেচ্ছ পরিমাণে কর্পোরেট দান সংগ্রহের লক্ষ্যে সংশোধন করতে হয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক আইন, জনপ্রতিনিধিত্ব আইন, আয়কর আইন এবং কোম্পানি আইন। এই সংশোধন সংবিধানকে লঙ্ঘন করেছে বলে মনে করে সবেরাচ্চ আদালত। নির্বাচনী বন্ড একদিকে যেমন তথ্য জানার অধিকার হরণ করেছে তেমনি নাগরিকদের বাক্‌ স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের সুযোগও সঙ্কুচিত করেছে। তাই ভারতের সংবিধানের পরিসরে নরেন্দ্র মোদীর স্বাদের নির্বাচনী বন্ডের কোনও ঠাঁই হতে পারে না।
আগে যে কোনও রাজনৈতিক দলকে ২০ হাজার টাকার বে‍‌শি কেউ দান করলে তা নির্বাচন কমিশনকে জানানো বাধ্যতামূলক ছিল। তেমনি কর্পোরেট সংস্থা তাদের মুনাফার একটা অংশ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলকে দান করতে পারত। সেখানে গোপনীয়তার কোনও সুযোগ ছিল না। মোদী বন্ড চালু করে যে কোনও কর্পোরেট (তা লোকসানে চললেও) যত খুশি টাকা তাদের পছন্দের দলকে (অবশ্যই শাসক দল) দেবার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে কে টাকা দিচ্ছে সেটা মানুষের জানার অধিকার নেই। বোঝাই যাচ্ছে মোটা টাকার বিনিময়ে সরকারের কাছ থেকে বিশেষ কোনও ব্যবসায়িক সুবিধা আদায়ের রাস্তা করে দেওয়া। কর্পোরেট রাজনৈতিক দলের মধ্যে গোপন আর্থিক লেনদেনের অশুভ আঁতাত তৈরি করা হয়েছে। ভোটার জানতেই পারছেন না তিনি যাকে ‍‌ভোট দেবেন বলে মনস্থির করবেন তারা কাদের কত টাকায় পুষ্ট। সেই টাকার বিনিময়ে সেই কর্পোরেট সেই দলের কাছ থেকে কী প্রত্যাশা করে। একজন ভোটারের একটি ভোট দেবার অধিকার থাকলেও এক কর্পোরেট বিপুল টাকা ঢেলে সরকারের উপর বিপুল প্রভাব বিস্তার করতে পারে। ফলে নির্বাচন অবাধ ও সু্ষ্ঠু থাকছে না। নির্বাচনে এবং সরকারের উপর অর্থশক্তির দাপট কায়েম হয়। তাই এই নির্বাচনী বন্ড শুধু অসাংবিধানিক নয়, ভারতের সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষেও বিপজ্জনক।
গত ছ’বছরে ৩০ দফায় যে সাড়ে ষোলো হাজার কোটি টাকার বন্ড বিক্রি হয়েছে তার ৫৫ শতাংশই গেছে নরেন্দ্র মোদীদের ঘরে। বাকি ৪৫ শতাংশ পেয়েছে বাকি দলগুলি। দেশে সিপিআই(এম)-ই একমাত্র রাজনৈকি দল যারা নীতিগতভাবে নির্বাচনী বন্ডের বিরোধিতা করছে প্রথম দিন থেকে এবং বন্ডের মাধ্যমে অস্বচ্ছ পথে একটি পয়সাও গ্রহণ করেনি। উলটে প্রথম বছরেই এই সংবিধানবিরোধী অস্বচ্ছ ব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছে। এমনকি মামলার শুনানি শুরু করার জন্য দু’বছর আগেও সর্বোচ্চ আদালতে আবেদন করেছে। সুপ্রিম কোর্টের এই ঐতিহাসিক রায় নিঃসন্দেহে সিপিআই(এম) সহ বামপন্থীদের এক বিরাট জয়। গণতান্ত্রিক পথে নির্বাচনে স্বচ্ছতা রক্ষায় সিপিআই(এম) অগ্রণী প্রহরীর ভূমিকা পালন করেছে।
 

Comments :0

Login to leave a comment