Editorial

আক্রান্ত চতুর্থ স্তম্ভ

সম্পাদকীয় বিভাগ


গণতন্ত্রের জননীর আজকের শাসক সন্তান গণতন্ত্রেরই টুঁটি টিপে ধরেছে। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে পরিচিত সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা আজ বিপন্ন স্বৈরাচারী আক্রমণে। মোদীতন্ত্রে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা ভিন্ন। এখানে শাসকের মন জুগিয়ে চলা, শাসকের নামে জ‌য়ধ্বনি দেওয়াই দস্তুর। ভিন্ন সুর, ভিন্ন মত, ভিন্ন ব্যাখ্যা চলবে না। সরকারের সমালোচনা বা বিরোধিতা মোদীতন্ত্রে গর্হিত অপরাধ। মোদী মনে করেন তিনি এবং তাঁর সরকার মানেই দেশ। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো তিনিই দে‍‌শের ঠিকাদারি নিয়েছেন। অতএব তাঁর মতই দেশের মত, তাঁর ভাবনাই দেশের ভাবনা। দেশবাসীকে মোদীর বিহনে লাইন দিতে হবে। আরএসএস, হিন্দুত্ববাদ, মনুবর্ণিত ব্রাহ্মণ্যবাদ, বিজেপি সরকার ইত্যাদি সব কিছুই দে‍‌শের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে এই বার্তা দিয়েছেন যে সরকারের বিরোধিতা বা সমালোচনা মানে আসলে দে‍‌শের বিরোধিতা। সেটা দেশদ্রোহিতার শামিল। অতএব মোদী যা বলবেন এবং সরকার যা করবে দু’হাত তুলে তা সমর্থন করতে হবে, প্রশংসায় ভরি‍য়ে দিতে হবে। অন্যথা মানেই দেশদ্রোহীতা।
নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর থেকে কর্পোরেট পৃষ্ঠপোষকতা যেভাবে বেড়েছে অতীতে কখনও তা হয়নি। অর্থনীতির সর্বক্ষেত্রে কর্পোরেট আধিপত্য বিস্তার করে পুঁজি ও সম্পদের প্রতি অতি কেন্দ্রীভবনের রাস্তা প্রশস্ত করা হয়েছে। বিপরীতে কর্পোরেট অর্থে শাসকদলের তহবিল ফুলে ফেঁপে উঠেছে। বস্তুত কর্পোরেট অর্থে বি‍‌জেপি ধনবান দল। এই ঘনিষ্ঠ কর্পোরেটই এই জমানায় ধাপে ভারতের সংবাদ মাধ্যমের সিংহভাগ কিনে নিয়ে মোদী সরকারের প্রচারের হাতিয়ারে পরিণত যা গোদী মিডিয়া নামে পরি‍‌চিত। এর বাইরে যেসব সংবাদপত্র বা অনলাইন মিডিয়া এবং সাংবাদিকরা আছেন তারা মোদী সরকারের চক্ষুশূল। পদে পদে সত্য ও বাস্তব উদ্‌ঘাটন করে মোদী সরকারের ভণ্ডামি ফাঁস করে দিচ্ছে। এদের জব্দ করতে না পারলে আগামীদিনে ক্ষমতার ছড়ি ঘোরানো সহজ হবে না। তাই রীতি মতো পরিকল্পনা করে আক্রমণ শুরু হয়েছে সাংবাদিক ও সংবাদ সংস্থার ওপর।
আসলে সত্য যে ভয়ঙ্কর শক্তিশালী, মিথ্যার ধোপদুরস্ত সাজানো সংশয়কে যে ছত্রাখান করে দিতে পারে তা যে কোনও স্বৈরাচারি জানেন। মোদীদের ভয়ও তাই সেখানেই। তারা চান যে কোনও মূল্যে সত্যকে আড়াল করতে। বাস্তবকে অগোচরে রাখতে। কিন্তু বেয়াড়া কিছু সাংবাদিক সত্যের পূজারী হয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সত্য ও বাস্তবকে বন্ধনমুক্ত করে জনসমক্ষে মেলে ধরে। এরাই স্বৈরাচারি ও আধিপত্যকর্মীদের পথের কাঁটা। এদের সরাতে সরকার সরকারি এ‍‌জেন্সিগুলিকে ব্যবহার করে।
ভীমা কোরেগাঁও-কে কেন্দ্র করে যেমন সরকারের সমালোচক সমাজকর্মী আইনজীবী, অধ্যাপক, লেখক, কর্মীদের সাজানো মামলায় নকশাল তথা দেশদ্রোহী সাজিয়ে দীর্ঘস্থায়ী কারাবরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে তেমনি এবার বেছে বেছে সমালোচক সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার ও হেনস্তা করা হচ্ছে। গত দু’বছর ধরে নিউজক্লিকের বিরুদ্ধে নানাভাবে তদন্ত করেও কোনও খুঁত না পেয়ে এবার সন্ত্রাসবাদীরা বিরুদ্ধে ব্যবহারের আইন ইউএপিএ ধারায় মামলা করে ৫০জন সাংবাদিকের বাড়িতে এক যোগে হানা দেওয়া হয়েছে। গ্রে‍প্তার হয়েছেন দু’জন, অধিক শ্রমিক। মোদীরা চান দেশের একজন সাংবাদিকের কলম থেকেও যেন সমালোচনা না আসে। তাই ভীতি ও ত্রাস সৃষ্টি করে সব সমালোচকের কলম স্তব্ধ করতে চায়। প্রয়োজনে দীর্ঘকালীন জেলবাস নিশ্চিত করতে চায়। সেটা সম্ভব দেশে মোদী স্তুতি ছাড়া আর কোনও সংবাদ প্রচার হবে না। আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে এই ব্যবস্থা না করতে পারলে সমূহবিপদ।
 

Comments :0

Login to leave a comment