Editorial

তিনি পারেন না

সম্পাদকীয় বিভাগ


ছোটখা‍‌টো কিছু ভাবতে পারেন না প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছোটখাটো মানুষের ছোট ছোট সমস্যা, যন্ত্রণাগুলি নিয়ে ভাবা, সেগুলির সমাধান করা প্রধানমন্ত্রীর ধাতে নেই। তাঁর সব ভাবনাই অতিকায় ধরনের। এমন কিছু ভাবতে চান, এমন কিছু করতে চান যা দেখেশুনে মানুষ চমকে যাবেন, হতবাক হবেন। তারপর মোদীর নামে জয়ধ্বনি দেবেন। তেমনি স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমেয়াদী কিছু তিনি ভাবেন না। তাঁর বেশিরভাগটাই দীর্ঘমেয়াদী। ১০ বছর, ২০ বছর, এমনকি তারও পরে কি হবে সেসব নিয়েই তাঁর স্বপ্নের ইমারত তৈরি হয়। ভোটে জিতে সরকার পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় আসে। তাই তাদের যাবতীয় কাজকর্ম মূলত এই পাঁচ বছরকে ঘিরেই। কিন্তু নরেন্দ্র সরকারের মেয়াদের মধ্যে করণীয় নিয়ে উচ্চবাচ্য করেন না। পাঁচ বছর পরের বিষয় নিয়েই তাঁর যত কথার ফুলঝুরি।
২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রধানমন্ত্রীর টার্গেট ছিল স্বাধীনতার ৭৫ বছর। তার উদ্‌যাপনে নামকরণ হয়েছে স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব। এই ৭৫ বছরকে সামনে রেখে তিনি ঘোষণা করেছিলেন সব ঘরে বিদ্যুৎ, পানীয় জল ও শৌচালয় পৌঁছে দেবেন। গঙ্গাকে দূষণ মুক্ত করার প্রকল্পও ঘোষণা করা হয়। অতঃপর মহাসমা‍রোহে ঘোষিত হয় ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকের আয় দ্বিগুণ করা হবে। নির্বাচন এলেই সকলকে চমকে দিয়ে নতুন নতুন প্রকল্প ও লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা হয়। কিন্তু পুরানো ঘোষণার পর্যালোচনা হয় না। বাস্তবে সেগুলি চাপা পড়ে যায় নতুন ঘোষণার উন্মাদনায়। অতএব আগে ঘোষিত প্রকল্প শেষ হবার প্রশ্ন নেই, লক্ষ্য পূরণেরও দায় নেই। সব ঘরে বিদ্যুৎ, পানীয় জল পৌঁছায়নি। সকলের জন্য ঘরও হয়নি। উলটে কৃষকের আয় দ্বিগুণ করার গোলপোস্টটা দু’দফায় সরিয়ে দেওয়া হলো। আয় কিন্তু দ্বিগুণ হলো না।
বারবার সোচ্চারে ঘোষণা হয়েছিল অর্থনীতির আয়তন ৫ ট্রিলিয়ন ডলার হবে ২০২২ সালের মধ্যে। সেক্ষেত্রেও গোলপোস্ট সরানো হয়েছে কয়েকবার। প্রথমে পিছিয়ে ২০২৪ সালে ভোটের বছর। এখন দেখা যাচ্ছে সেটাও অসম্ভব। তাই ফের গোলপোস্ট সরিয়ে ২০২৭ সাল করা হয়েছে। বিশ্বের চতুর্থ, তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হবার কথা তো সকাল বিকাল শোনা যাচ্ছে। হালে লক্ষ্যমাত্রাগুলি আরও দূরে সরানো হচ্ছে। একেবারে ২০৪৭ সাল অর্থাৎ স্বাধীনতার শতবর্ষকে টার্গেট করা হচ্ছে। মোদী বলে দিয়েছেন তখন ভারত নাকি আমেরিকা ইউরোপের মতো উন্নত দেশের সমকক্ষ হবে। কয়েকদিন আগে বলেছেন, ২০৩৫ সালের মধ্যে ভারত মহাকাশ স্টেশন তৈরি করবে। ২০৪০ সালে চাঁদে মানুষ পাঠাবে। সর্বশেষ ভারতে অলিম্পিক আয়োজনের কথা ঘোষণা হয়েছে। এইভাবে স্বপ্নের পর স্বপ্নের জাল বুনে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী।
কাশ্মীরে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ও বড় জাতীয় পতাকা উড়িয়েছেন। বিশ্বের সবচেয়ে বড় মূর্তি বানিয়েছেন। সর্বাধিক উচ্চতায় রেল ব্রিজ হয়েছে। চলছে বুলেট ট্রেন চালানোরও কাজ। তিনি বিশ্বের সবচেয়ে বিলাসবহুল সংসদ ভবন বানিয়েছেন। বিশ্বের সব‍‌চেয়ে দামি রাজকীয় বিমান কিনেছেন চড়ার জন্য। কিন্তু ভারতবাসীর দুর্ভাগ্য গত সাড়ে নয় বছরে একবারের জন্যও তিনি বলতে পারেননি এই মহান স্বদেশ ভারত থেকে চিরতরে দারিদ্র্য দূর করে দেবেন। বলেননি অমৃতকালে এমন একজন ভারতীয় থাকবেন না যিনি না খেয়ে বা আধপেটা খেয়ে ঘুমোতে যাবেন। দেশ অপুষ্টির অভিশাপ থেকে মুক্ত হবে। তিনি বলতে পারেননি তাঁর ‘প্রিয়’ দেশে একজন যুবকও থাকবে না যার হাতে কাজ নেই। ভারত থেকে বেকারত্ব নির্বাসন হবে। থাকবে না মূল্যবৃদ্ধির যন্ত্রণা, কাজ হারানোর যন্ত্রণা। শিক্ষার আঙিনার বাইরে থাকবে না একটি শিশুও। মানুষের জন্য মানুষের কথা বলার যোগ্যতা ও ক্ষমতা তাঁর নেই। তিনি চমক-নাটকে, জুমলাবাজিতে পারদর্শী। কিন্তু আসল কাজে অষ্টরম্ভা।
 

Comments :0

Login to leave a comment