বাংলার ক্রিকেটের ইতিহাসে কালো দিন হয়ে থাকল ৫ জুন। সুপার ডিভিসন ক্রিকেটের ফাইনালে ভবানীপুর ও ইস্টবেঙ্গল দু’দলের মধ্যে তুমুল ঝামেলা। বৃহস্পতিবার বিকেলে ইডেনের ড্রেসিংরুম চিত্র দেখা গেল, সাধারণত খেপের মাঠে দেখা যায়। বিতর্ক শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় দিন থেকে। তৃতীয় দিন অভিনব সব ঘটনা ঘটেছিল। শেষদিন সবকিছুকে ছাপিয়ে গেল।
খেলার শেষ দিন বিকেল সাড়ে পাঁচটার আশেপাশে বৃষ্টির কারণে খেলা বন্ধ হয়। মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ভবানীপুরের শাকির হাবিব গান্ধী ও ইস্টবেঙ্গলের ঋত্বিক চ্যাটার্জি একে অপরের সঙ্গে বাদানুবাদ শুরু করেন। এর রেশ পৌঁছায় ড্রেসিংরুমে। তারপরেই দু’দলের কর্তারা এসে হাজির হন ঘটনাস্থলে। প্রায় দশ মিনিট ইডেনের ড্রেসিংরুমে তুমুল চিৎকার চলে। হাতাহাতির পর্যায়ে পৌঁছায়। শেষ পর্যন্ত যা ঘটল তা পৃথিবীর কোনও ক্রিকেট মাঠে গ্রহণযোগ্য নয়। ইডেনের ড্রেসিংরুমে পুলিশ পাহারা বসাতে হলো। বৃষ্টি একটা সময় বন্ধ হয়। সাতটা দশ থেকে খেলা শুরু হওয়ার কথা ছিল। ফের বৃষ্টি নামায়, খেলা বন্ধ করে দু’দলকে যৌথ বিজয় ঘোষণা করা হয়।
দু’দলের কর্মকর্তারা একে অপরের দিকে অভিযোগ তির ছুঁড়লেন। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের মেন্টর সম্বরণ ব্যানার্জি বললেন, ‘ক্রিকেট ইজ এ জেন্টলম্যানস গেম। যে পক্ষই শুরু করুক, ঘটনাটা ঠিক। ক্রিকেট ঠিকভাবে খেলা উচিত। তাছাড়া কয়েকটা বাই ল’ (উপধারা)’য় সমস্যা হয়েছে। সিএবি’র প্লেয়িং কন্ডিশন অনুযায়ী তিনটে ব্যাপারে তৃতীয় আম্পায়ারের কাছে যাওয়া যায়। নো বল, রান আউট আর স্ট্যাম্প। এখানে পরের ব্যাটসম্যান স্টান্স নিয়ে নিয়েছে, বোলারের হাতে বল দিয়ে দিয়েছে, তখন ফেরানো হলো। এটা আমার কাছে খুব অদ্ভুত লাগল। ঋত্বিক যেভাবে চোট পেল সেটা খুবই খারাপ। হাত ফুলে আছে। বিমারে চোট পেয়েছে।’এরপর ইস্টবেঙ্গলের অর্থসচিব সদানন্দ মুখার্জি বললেন, ‘বিবেক সিং উইকেট ছুঁড়ে মেরেছে। সিএবি’র কাছে সিসিটিভি আছে। সিএবিকে আমি অনুরোধ করব এ ব্যাপারে। আজকে ইন্ট্যাভালে বিবেক সিং মাঠের মধ্যে ঋত্বিক চ্যাটার্জিকে গালাগালি করছে।’ তিনি যোগ করেন ‘আমরা যে কোনও রকম তদন্তের সামনে বসতে রাজি। আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। বলছে ইস্টবেঙ্গল খেলেনি। কেন খেলেনি সেটা বলবে তো?’ শেষে তিনি অভিযোগ করেন আম্পায়ার ম্যানিপুলেশন করা হয়েছে।
এরপর ভবানীপুরের পক্ষ সৃঞ্জয় বসু ও সম্রাট ভৌমিক ম্যাচ প্রসঙ্গে কথা বলেন সাংবাদিকদের প্রসঙ্গে।
সৃঞ্জয় বসু বলেন, ‘পাঁচ ঘণ্টা একটা দল বসে আছে বাইরে, তারপরেও তাকে খেলতে দেওয়া হচ্ছে। সিএবি’র তাহলে বলে দেওয়া উচিত ইস্টবেঙ্গল লিগ এটা। এটা কোনও দিন কেউ শুনেছে একটা দল পাঁচ ঘণ্টা ‘রিফিউজ টু প্লে’ করার পরে তাকে খেলতে দেওয়া হয়েছে। আওয়ার অফ প্লে বদলে যাচ্ছে। ভোটের জন্য একটা ক্লাবে এই রকম সুবিধা। এটা ন্যক্কারজনক ঘটনা। এটা যদি আজ ভবানীপুর আর উয়াড়ির ম্যাচ হতো, আর একটা দল পাঁচ ঘণ্টা পরে আসত, তাহলে কি সভাপতি আসতো অনুরোধ করতে? সৌরভ গাঙ্গুলি আসত? এটা একটা প্রহসনে দাঁড়ালো খেলাটা।’ তিনি যোগ করেন, ‘মাঠের বাইরে ইস্টবেঙ্গল অফিসিয়াল হুমকি দিচ্ছেন কিভাবে খেলোয়াড়রা ফেরে দেখে নেবো। এভাবেই চলবে বাংলার ক্রিকেট।’ তিনি আরও বলেন, ‘একটা ছেলে দুশো করে ফেরত আসছে, তাকে গালাগালি দেওয়া হচ্ছে। যারা এই সব বলছে, তারা আগে ভদ্রতা শালীনতা কোথায় ভেবে দেখুক।’
আরেক শীর্ষকর্তা সম্রাট ভৌমিক বলেন, ‘আম্পায়ারের একজন ব্যাটারকে ফিরিয়ে আনার অধিকার আছে। তার বিরোধিতা করে একটা দল খেলতে রাজি নয়। অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির অনুরোধেও নামছে না। খেলা চলাকালীন নিয়ম বদলে যাচ্ছে। উলটো দিকের দলটা খেলতে আসেনি। কোনও ভাবে ম্যাচটা ভন্ডুল করে যৌথ বিজয়ী হওয়াই লক্ষ্য।’ আম্পায়ার ম্যানিপুলেশন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ইস্টবেঙ্গল অভিযোগ করছে আম্পায়ার ম্যানিপুলেশন নিয়ে ? পাঁচ ঘণ্টা নোংরামি করে নিজেরা যুগ্ম বিজয়ী হলো আর তারা বলছে ভবানীপুর আম্পায়ার ম্যানিপুলেশন করেছে? এই ম্যাচ লাইভ টেলিকাস্ট হয়েছে। সবাই দেখেছে কে কি করেছে। তার উপর এক ঘণ্টায় ৩.৪ ওভার বল করেছে সুপার ডিভিসন ফাইনালে। সারা বিশ্ব দেখেছে।’
সিএবি সভাপতি স্নেহাশিস গাঙ্গুলি খেলার শেষে বলেন, ‘সভাপতি হিসাবে তো বটেই ক্রিকেটার হিসাবেও এই ঘটনা কোনও দিন দেখিনি। ভবিষ্যতেও আশা করি দেখতে হবে না। মাঠে আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। সেটাই মানতে হবে। আম্পায়ারের রিপোর্ট আসুক, তারপর সিদ্ধান্ত হবে। কোনও বিশেষ দল কি বলল, সেটা এখানে একেবারেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। দু’দলের বাংলার হয়ে প্রতিনিধিত্ব করা ক্রিকেটাররা ছিল। এটা ভাবাই যায় না।’ এরপরে তিনি আম্পায়ারদের জরুরি তলব করেন।
খেলার পর দু’দলের ক্রিকেটারদের মধ্যে কোনও ‘স্পোর্টসম্যান স্পিরিট’ দেখা যায় নি। কেউ একে অপরের সঙ্গে হাত মেলাননি। যুগ্ম বিজয়ী হলে একসঙ্গে ছবি তোলা হয়। সেটাও হয়নি।
সবমিলিয়ে বাংলার ক্রিকেটের পক্ষে একেবারেই দুঃস্বপ্নের দিন। এমনিতেই ৯১ বছরের রঞ্জি ট্রফির ইতিহাসে বাংলা জিতেছে দু’বার। শেষ বার ৩৫ বছর আগে। তার উপর ক্লাব ক্রিকেটে এই ঘটনা আগামীদিনে দলগত সংহতিকে বিপদে ফেলতে পারে। ঋত্বিক আর শাকির দু’জনেই বাংলার রঞ্জি ক্রিকেটার। বিবেক সিং একসময় খেলতেন বাংলার হয়ে। যে ইডেনের ড্রেসিংরুম আলো করে থাকতেন পৃথিবীর সেরা ক্রিকেটার (আগামী দিনেও থাকবেন) সেই ড্রেসিংরুমে পুলিশি প্রহরা বসল ক্রিকেটার ও কর্মকর্তাদের হাতাহাতিতে। এ লজ্জা লুকোবে কোথায়?
Super Division Cricket Final
প্রহসনের ফাইনালে যুগ্ম জয়ী দু’দল শেষ দিনে ইডেনে তুমুল ঝামেলা

×
Comments :0