Kakababu Birth Anniversary

কাকাবাবুর জন্মদিবসে আমাদের শপথ

উত্তর সম্পাদকীয়​


বিমান বসু

আজ কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের ১৩৭তম জন্মদিবস। তিনি অবশ্যই বঙ্গপ্রদেশ ও ভারতের বুকে কমিউনিস্ট আন্দোলন ও সংগঠন গড়ে তোলার অন্যতম পথিকৃৎ।
আমাদের সকলেরই জানা বিষয় যে, ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় সফল বলশেভিক বিপ্লব সম্পন্ন হওয়ার পর পৃথিবীর সমস্ত ঔপনিবেশিক দেশে বসবাসকারী একাংশের মানুষের মননে ও চিন্তনে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। জারের অত্যাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে কমিউনিস্টরা লড়াই সংগ্রাম গড়ে তুলতে এবং তাদের রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে উৎখাত করার বিস্ময়কর কাহিনি এশিয়া, আফ্রিকার সমস্ত পরাধীন দেশে মুক্তিকামী মানুষের মনে ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করেছিল। 
কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের মনেও গভীরভাবে সফল বলশেভিক বিপ্লব রেখাপাত করেছিল বলেই সম্ভবত তিনি বারবার চিন্তা করেছেন সর্বসময়ের রাজনীতি করবেন না লেখালেখি ও সাহিত্য চর্চায় রাজনৈতিকভাবে যুক্ত থাকবেন। এসব কথা ওঁর নিজের আত্মজীবনীতেই রয়েছে।
দোর্দণ্ডপ্রতাপ ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিশেষ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নবীন যোদ্ধা মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ দেশের অভ্যন্তরে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার লক্ষ্যে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। এটা মোটেই কোনও ছোট ঘটনা নয়। তখনকার দিনে অনেকেই গৃহশিক্ষকতা করে এবং ছোটখাট নানা কাজ করে একটু স্বাচ্ছন্দ্যের জীবনযাপন করার দিকে ঝুঁকতেন। তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে শোষণ যন্ত্রণার নাগপাশ থেকে মানুষকে মুক্ত করার জন্য তিনি কৃষকদের সংগঠিত করা, শ্রমিকদের সংগঠিত করা এবং সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষকে সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। এসবই করতে হয়েছে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের অধীনে বসবাস করে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত থেকে। 
বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে যৌবনের প্রথম পর্বে মুজফ্‌ফর সাহেবের সঙ্গে বীরভূম জেলার কীর্ণাহারের সরডিহা গ্রামের নব্য যুবক আবদুল হালিমের পরিচয় হয়। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই একই লক্ষ্যে পরিচালিত আবদুল হালিমের সঙ্গে মুজফ্‌ফর সাহেবের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের বন্ধন তৈরি হয়। এবং অভিন্নহৃদয় এই দুই পথিকৃৎ শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার কারিগরে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যেই পারিচালিত হতে থাকেন। মুসলিম সাহিত্য সমিতির একজন একনিষ্ঠ সেবক হিসাবেই মুজফ্‌ফর সাহেবের ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে সাহিত্য জগতে উদীয়মান তারকা কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে। এখন কোনও কোনও গবেষক মন্তব্য করেন, সম্ভবত মুজফ্‌ফর সাহেবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তাঁর সাহিত্য কর্মে প্রভাব সৃষ্টি করেছিল। 
নতুন প্রজন্মের কেউ কেউ প্রশ্ন করে জানতে চান কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদকে আমরা অনেকেই ‘কাকাবাবু’ বলি কেন? উত্তরে একথা উল্লেখ করা যায় যে কাকাবাবু পরাধীনতার নাগপাশে থেকেও স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার কাজে যুক্ত থাকার জন্য ব্রিটিশ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন, ছাড়া পেয়েছেন, আবার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে, কখনও কখনও আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে, অল্প সময়ের জন্য বা বেশি সময়ের জন্য। ফলে, যে সব জায়গায় আত্মগোপনে থাকতেন সেখানে তাঁকে পরিবারের সদস্য হিসাবে কাকাবাবু নামে সম্বোধন করা হতো। এভাবে তিনি ধীরে ধীরে সকলের ‘কাকাবাবু’ হয়ে যান। বিশদে ব্যাখ্যা না করে প্রাসঙ্গিক হবে কমরেড সরোজ মুখার্জির ‘ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ও আমরা’ বই থেকে তুলে ধরলে। ... জ্যোতি বসু যখন লন্ডন থেকে ঘরে ফেরেন সেই সময়ে দেশের নানা প্রান্তে পার্টির  গোপন কেন্দ্র তৈরি করার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল। মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের নির্দেশে কনক দাশগুপ্ত, শান্তি রায় (প্রধান), বেলা চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ গোপন কেন্দ্রে চলে গিয়েছেন।  পার্টির সেই গোপন যুগে ‘প্রাদেশিক ডেন তৈরি করার সময় মুজফ্‌ফর আহ্‌মদকে জমিদার সাজিয়ে আমরা সবাই হলাম ভাইপোর দল। টাকা-পয়সা আছে, বাড়িতেই থাকেন সবাই, সন্ধ্যার সময় সবাই একটু ফু্র্তি করতে বেরোন। এই গল্প বাড়িওয়ালাকে দেওয়া হয়। মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ হলেন কাকাবাবু। আর আমরা এক একজন ভাইপো। পাঁচুদা বড়দা, সোমনাথ লাহিড়ী মেজদা আর আমি সরোজ মুখার্জি ছোড়দা। ভূপেশ গুপ্তকে সেজদা করা হয়েছিল। বোম্বাইতে তিনি অবশ্য ছিলেন সকলের মেজদা।’  এই প্রেক্ষাপটেই জ্যোতি বসুর কলকাতা আগমন। জ্যোতি বসুর কাছেও মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ কাকাবাবুই ছিলেন। কাকাবাবুও জ্যোতি বসুদের খোঁজ খবর রাখতেন। জ্যোতি বসুর পার্টি সদস্যপদ পাওয়ার ক্ষেত্রে কাকাবাবুর বড় ভূমিকা ছিল। জ্যোতি বসু কাকাবাবুর সঙ্গে দেখা করেছিলেন ১৯৪০ সালের ১৪ জানুয়ারি। মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের সেই অভিজ্ঞতা জ্যোতি বসুর নিজের মুখেই আমরা শুনে নিতে পারি— ‘আমি যখন কাকাবাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম তখন লক্ষ্য করলাম উনি আমাদের অনেক খবরই জানেন। সিপিজিবি’র সাথে নানা বিষয় নিয়ে তাঁর পত্রালাপ হতো। তৃতীয় আন্তর্জাতিকের সাথেও যোগাযোগ ছিল তাঁর। কাকাবাবু সাক্ষাতের প্রথম দিনই আমাকে বললেন, আজ থেকেই আপনি পার্টি সদস্য। আমি তাঁকে বললাম, আমি যে বিলেতে ৩/৪ বছর কাজ করলাম তার কি হবে? শুনে উনি একটু হেসে বললেন, তখনতো আপনি অ্যাপ্রেন্টিস ছিলেন। যাই হোক, আমি ১৯৪০ সালে পার্টি সদস্যপদ পেলাম।’ 
অনেক বছর  আগে একবার বিশিষ্ট চিন্তাবিদ অধ্যাপক হীরেন মুখার্জির সঙ্গে কাকাবাবু প্রসঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। সেই সময় আমার সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি বলেছিলেন, দ্যাখো, মুজফ্‌ফর সাহেবের মতো মানুষের নামটাই অনেকে ভুলে যাচ্ছে। তারা সকলেই তাঁকে ‘কাকাবাবু’ বলে সম্বোধন করেন। তিনি বলেছিলেন কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ একজন আলাদা ধাঁচের বিশিষ্ট কমিউনিস্ট নেতা। 
আমাদের একথা মনে রাখতে হবে যে, গত শতাব্দীর বিশের দশকে কাকাবাবুদের  নেতৃত্বে দেশের বুকে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠার জন্মলগ্নে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ নানা ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক মামলাও করেছে। এই মামলার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লিখিত হয়েছে পেশোয়ার, কানপুর ও  মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা। কাকাবাবুকে যুক্ত করা হয়েছিল কানপুর (১৯২৩-২৪)  ও  মীরাট ষড়যন্ত্র (১৯২৯) মামলায়।  ওই সব মামলায় নিজের স্বপক্ষে দাঁড়িয়ে দেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ের স্বার্থে দেশের জনগণকে সংগঠিত করছেন—  এই কথা তিনি  সোচ্চারে বলেছিলেন।  মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় আদালতে দাঁড়িয়ে যে কথাগুলো তিনি বলেছিলেন তার কিছু কথা সংবাদপত্রে প্রকশিত হয়েছিল, যা তৎকালীন সময়ে যুবসমাজকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করেছিল। এ ব্যাপারেও কমরেড সরোজ মুখার্জির লেখা থেকে কাকাবাবুকে বুঝতে বিশেষভাবে সাহায্য করবে মনে করে কিছু কথা উদ্ধৃত করছি। ‘... মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলার বিবরণ ‘হিন্দু’তে (দৈনিক সংবাদপত্র) বেরিয়েছে। ‘হিন্দু’তে ভালো করে এই সংবাদ প্রকাশিত হতো। বিপ্লব, কমিউনিজম, সশস্ত্র গণঅভ্যুত্থানের  মাধ্যমে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদী সরকারের উচ্ছেদ— এই সব কথা ছাপার অক্ষরে দেখলে  আমাদের বেশ উৎসাহ হতো, ভালোও লাগতো। বন্দিদের বিবৃতি, কৌঁসুলীদের বক্তব্য সরকারের বক্তব্য এই সব পড়তে আমাদের সবারই ভালো লাগত। এই প্রথম আমরা কমিউনিস্ট ও ভারতের কমিউনিস্ট দলের নাম শুনি। শ্রমিক-কৃষকদের সশস্ত্র অভিযানের প্রস্তুতি, ষড়যন্ত্র— এইসব কথা, মামলার সংবাদ প্রকাশিত হতো। 
‘মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ, সামসুল হুদা, ধরণী গোস্বামী, গোপেন চক্রবর্তী, রাধারমণ মিত্র, শিবনাথ ব্যানার্জি, প্রমুখ বাঙালিদের নামগুলো বুঝতাম। কিন্তু ঝাবওলা, মিরাজকর, নিম্বকর, ডাঙ্গে, ঘাটে প্রমুখ নাম দেখে তারা মারাঠি না মাদ্রাজি বুঝতাম না। আলোচনা করতাম। ...’  কাকাবাবুকে বুঝতে প্রথম যুগের কমিউনিস্ট পার্টির শেষ পর্বের নেতা সরোজদার বয়ান উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক মনে করেই একথা তুলে ধরলাম। 
আমাদের এক মুহুর্তের জন্যেও ভুলে গেলে চলবে না কাকাবাবুদের হাতে গড়ে ওঠা কমিউনিস্ট পার্টির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে বর্তমান প্রজন্মের মার্কসবাদ-লেনিনবাদের আদর্শ অনুযায়ী পার্টিসদস্য ও ঘনিষ্ঠ সদস্যদের নিজেদের জীবন গড়ে তুলতে হবে ও পার্টির জন্য কাজ করতে হবে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)’র সদস্যরা যে একটু ভিন্ন ধাতুতে গড়া তা সমাজবদ্ধজীব হিসাবে এলাকার মানুষের কাছে তাদের নিজেদের পরিচিত করে তুলতে হবে। এই পরিচয় গড়ে উঠলে অবশ্যই আমরা এলাকাগত সাধরণ মানুষের যে সমস্যা বা দাবিসনদ, তাকে ঘিরে এলাকাগত লড়াই সংগ্রামে সাফল্য অর্জন করতে পারব। কাকাবাবুরা গ্রামে গ্রামে কৃষকের সমস্যা সমাধানের জন্য যে লড়াই করেছেন তার ফলশ্রুতিতেই ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলন সংগঠিত হতে পেরেছিল। তবে, অবশ্যই এসব কাজে সাফল্য অর্জন করতে এখনকার পার্টি সদস্যদের একটু ত্যাগ তিতিক্ষার মনোভাব নিয়ে নিজেদের গড়ে তুলতে হবে যা কাকাবাবুরা করেছিলেন। 
আমরা সকলেই লক্ষ্য করছি, বর্তমান সময়ে ভারতের বুকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের মতাদর্শ অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকারে নীতি ও আমাদের রাজ্য সরকারের ধর্ম, বর্ণ ও ভাষাকে ব্যবহার করে সমাজে এক কিম্ভূতকিমাকার পরিস্থিতি গড়ে তুলতে প্রয়াসী হয়েছে। এই পরিবেশ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ ঐক্য, সংহতি ও সম্প্রীতির পরিবেশ গড়ে তুলতে শ্রমিক শ্রেণি সহ দেশের জনগণের আন্দোলন সংগ্রামকে তীব্র করতে হবে। একাজ একমাত্র কমিউনিস্টরাই কাকাবাবুর আদর্শকে সামনে রেখে সফল করতে উদ্যোগী হতে পারে। অবশ্যই, একাজে সাফল্য অর্জন করতে হলে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের আদর্শকে  সামনে রেখে শুধু নিজের বা পরিবারের ভালোমন্দ ভাবলেই সম্পন্ন হবে না। পরিবারের কথা নিশ্চয়ই ভাবতে হবে কিন্তু সব ধরনের শ্রমজীবী মানুষের একান্ত সুহৃদ হয়ে নিজেদের গড়ে ওঠার শপথও নিতে হবে। একাজে সাফল্য অর্জন করতে কমিউনিস্ট ও প্রকৃত বামপন্থী রাজনীতির ভিত্তিকে জোরদার করতেও সংকল্পবদ্ধ হতে হবে। 
আজ কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ অর্থাৎ আমাদের কাকাবাবুর ১৩৭তম জন্মদিবসে শপথ হোক— আমরা শুধু আমাদের জন্য নয়, আমরা সমাজের শোষিত বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষ তার শোষণ মুক্তির লড়াই সংগ্রামের স্বার্থেই তাঁদের মুক্তির প্রকৃত যোদ্ধা হয়ে ওঠার সংকল্প গ্রহণ করছি।

Comments :0

Login to leave a comment