অলকেশ দাস
পাখির ডাক শুনে মেয়েটার সকাল দুপুর কেটে যেত। হবে নাই বা কেন। তার গ্রামের আদলটাও যে উড়ন্ত পাখির মতো। শ্রীহীন, অপরিষ্কার, ভাঙাচোরা গ্রামে এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি তার ছিল নিত্য যাতায়াত। বয়সটাও কম। ন'বছরের ছোট্ট মেয়ে। ফুলের মতো। বাবা মার বড় আদরের। পরিযায়ী শ্রমিক বাবার কাছে নিজের দেশ, নিজের বাড়ি প্রায় বিদেশ। বাবাকে বেশি না পেয়ে মায়ের বড় আঁচলধরা ছিল মেয়েটা। মা সাজাতো মেয়েকে। মেয়েও সাজতে ভালোবাসত। সে কি আর জানত রক্ত সাজে শেষ হবে তার জীবন।
মোলান্দি গ্রামের ইতিহাস ভূগোল মা'র জানা ছিল। ভোটের ফলের দিনটা ভালো যাবে না, সে অনুমান তার ছিল। মেয়েকে বলেছিল— আজ আর স্কুলে গিয়ে কাজ নেই। ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টি আর প্যাচপেচে গরমের মধ্যে স্নান করে ফিরছিল। রাস্তায় কোনও মিছিল দেখলে ছোট বাচ্চারা যেমন বাড়ি থেকে বাইরে এসে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে, সেই রকমই বাড়ির বাইরে এসে মায়ের হাত ধরেছিল। তার কোনও ধারণাই ছিল না, যার দোকানে গিয়ে চকলেট কেনে সেও তার দিকে বোমা ছুঁড়ে মারতে পারে! তাও আবার– ‘ওই হোসেনের মেয়ে, মার -ওর দিকেই মার’ একথা বলে!
কালু, আনোয়ার, মানোয়ার, আদর শেখদের শকেট বোমা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি। মার হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেছে ক্লাস ফোরের লাল জামা পরা তামান্না। মার চোখের সামনে মেয়ের গলা থেকে মাংসগুলো দলা দলা হয়ে বেরিয়ে এসেছিল। চঞ্চল মেয়ের রক্তমাখা শরীর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নিথর। জল্লাদেরা তখনও হাসছিল। বিজয়ের উল্লাসে মত্ত। উচ্চকণ্ঠে মমতা ব্যানার্জির জয়ধ্বনি। ওদিকে মার আকাশ ফাটানো চিৎকার। কোল হারানোর আর্তনাদ। যে আকাঙ্ক্ষার স্বপ্নে তামান্নার নামকরণ সে স্বপ্নের ইতি।
পরের দিনটা ছিল শরীর কাটাছেঁড়ার দিন। নিয়মের মধ্যেই পড়ে। কৃষ্ণনগর হাসপাতাল থেকে তামান্না ফিরলো পাশ বালিশের খোলের মতো সাদা কাপড়ে প্রায় পোঁটলাবন্দি হয়ে। মা যখন মৃত মেয়ের মুখ দেখছে তখনও সে তাকিয়ে আছে। ঘোলাটে আকাশের নিচের পৃথিবীতে তখন এক গাঢ় নিস্তব্ধতা। প্রত্যেকের হৃদয়ের ব্যথা বেদনা চোখের জলে হয়ে ঝরে পড়ছে। মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ, কিন্তু পাঁজরের নিচে গনগনে আগুন। কখনো জ্বলে উঠছে দাউ দাউ করে। গোসল আর জানাজার নামাজ আদায়ের পর দাফন। গোটা গ্রাম ভেঙে পড়েছে। অনেকের বাড়িতে উনুনের উপর শূন্য কুচকুচে কালো রঙের হাঁড়ি উপুর করে রাখা। শোকে আর রান্নার রুচি হয়নি। তিন মুঠ মাটি দেওয়ার কাজ সন্ধ্যা ছ'টায় শেষ। সূর্য তখন পশ্চিমের দিকচক্রবালে অস্তমিত। কবরস্থানের চারিদিকে উঁচু উঁচু গাছের ছায়া অন্ধকার হয়ে জমাট বেঁধেছে। উঁচু গাছ, যাতে শিয়াল আসতে না পারে। কিন্তু সমাজে মনুষ্যরুপী যে শিয়াল— তাকে আটকানো যাবে কিভাবে!
তামান্নার নিজের গ্রামের নাম মোলান্দি, গ্রাম পঞ্চায়েত বড় চাঁদ ঘর। পলাশী, আন্দুলবেড়িয়া, সাহেবনগর, পলসন্ডা, দেবগ্রামের মাঝে এক জনপদ। ১০ কিলোমিটার দূরেই বেলডাঙা শহর, অন্য জেলা মুর্শিদাবাদের। এখানে প্রায় অর্ধেক লোক নিরক্ষর। তার মধ্যে মহিলা বেশি। গ্রাম থেকে বাইরে কাজ করতে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। এইভাবেই এখানে দুঃখের ঝড়ঝাপটার মধ্যে মানুষ সুখের দিনের স্বপ্ন দেখে।
এ গ্রামের মানুষেরা হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে ভালোবাসে বামপন্থীদের। আগের দুটো পঞ্চায়েত নির্বাচনে বামেদেরই পঞ্চায়েত সদস্য ছিল। গত পঞ্চায়েত ও লোকসভার ভোটে গ্রামের মানুষদের ভোটই দিতে দেয়নি তৃণমূলী বাহুবলীরা। শেষ পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের হুমকি ছিল— ভোট দিলে ৭০ বছর বাড়িতে আসতে পারবে না। বাড়ির সামনে পাঁচ গাড়ি পুলিশ দাঁড় করিয়ে রাখা হবে। আক্রমণ হলে মানা করে দেওয়া থাকবে পুলিশকে, আসবে না। এই নির্বাচনের আগে তৃণমূলের ব্লক সভাপতি তৃণমূল প্রার্থীকে সঙ্গে নিয়ে দোকানে, দোকানে হুমকি দিয়েছে, ভোট অন্য জায়গায় পড়লে অবস্থা খারাপ হবে। মহিলা তৃণমূল প্রার্থী কোনও বাধা দেয়নি। সমাজ মাধ্যম উচ্চকিত হলেও নির্বাচন কমিশন বধির ছিল। এবারেও মোলান্দি গ্রামে ভোট দিতে না যাওয়ার হুঁশিয়ারি ছিল। মানুষ এবার মানেনি। ভোট দিয়েছে। তৃণমূলের তাই গাত্রদাহ। তখনও গণনা শেষ হয়নি। ঘড়িতে বেলা একটা। বিজয় মিছিলে বীভৎস বিজয় উল্লাস। মিছিলে তারাই ছিল যাদের লোভ, ক্রোধ, লালসা জিঘাংসার অন্ত নেই, যা মানুষকে পিছনে অন্ধকারে টেনে নিয়ে যায়। যে ক্ষমতার ক্ষমতার দম্ভ তাকে অন্ধ করে। তামান্নার বাবা সপরিবারে ভোট দিতে গিয়েছিল। হঠাৎ করে ৯ বছরের ছোট মেয়েটা যখন বাড়ি থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল— হোসেনের উপরের রাগ এসে পড়ে মেয়ের উপর। ভোটের দিনের থেকেই ওদের এই পরিকল্পনা ছিল। না হলে গ্রামের একবারে শেষ সীমানায় এত ভিতরে, পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত যেখানে কাদা মাখামাখি, সেখানে বিজয় মিছিল কেন যাবে? সেটা তো প্রায় আলপথ। হোসেনের মেয়েটাকেই ধর— বলে সকেট বোমা ছুঁড়ে দেয় মনুষ্যরূপী জন্তুরা। ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় মেয়েটার শরীর, তৃণমূলের অপরাধতন্ত্রের রাজনীতির প্রতিষ্ঠিত চালচিত্রে।
এবারের কালীগঞ্জের বিধানসভার উপনির্বাচনে তৃণমূল স্থির থাকতে পারেনি। নিজেদের দলের মধ্যেই অনেক কাটাকুটির খেলা। প্রয়াত বিধায়কের সঙ্গে তৃণমূলের বর্তমান সাংসদের সম্পর্ক সাপে-নেউলে। একদিনের জন্যও প্রচারে আসেননি। গ্রিসের মধুচন্দ্রিমা অবশ্য একটা অজুহাত তৈরি করেছে। স্থানীয় বিবাদ মেটানোর জন্য চাপড়ার বিধায়ককে দায়িত্ব দিতে হয়েছে কালীঘাটকে। যে দায়িত্বের সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর-সীমান্তে পাচারকারী বাহুবলীরা। বিজেপি’র বিধানসভার দলনেতা চড়া সুরে মুসলমানের ভোট দরকার নেই শুধু বলেনি, সব হিন্দু ভোটকে টানার জন্য উগ্র সাম্প্রদায়িক প্রচার করেছে। মুসলিম ভোটে কতখানি ভাগ বসাবে বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী সেই নিয়েও চাপা উত্তেজনা ছিল তৃণমূলের। যে সহানুভূতির ভোটের জন্য শেষ দিকে খানিকটা তৃণমূল থেকে দূরে থাকা বিধায়কের মেয়েকে প্রার্থী করা হয়, তবে তা কতখানি কার্যকরী হবে সে নিয়েও তৃণমূল চাপে ছিল। বোমা, বন্দুক, সমাজবিরোধী, পুলিশ, প্রশাসন যেভাবে কাজে লাগায় তৃণমূল নির্বাচনে, এবার কিছুটা হলেও সবটা পারেনি। ফলে আশঙ্কা ছিলই। যেভাবে বামেরা ঝাঁপিয়ে কংগ্রেস প্রার্থীর হয়ে সর্বাত্মকভাবে নেমেছিল, সেটাও তৃণমূলের কপালে ভাঁজ ফেলেছিল। জয় সম্পর্কে একেবারে নিঃশঙ্ক ছিল না তৃণমূল। অপ্রত্যাশিত ৫০,০৪৯ ভোটে জয় উত্তেজনার পারদ চড়িয়ে দেয়। বিজয় মিছিলে বেরিয়ে আসে বেআইনি মজুত অস্ত্রশস্ত্র। নির্বাচনের দিন সকাল থেকেই এই অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে ভয় দেখানো হয়েছিল মোলান্দি গ্রামের ভোটারদের। যাকে উদ্ধার করার দাবি জানিয়ে নির্বাচন কমিশনকে বারবার অভিযোগ জানানো হচ্ছিল সিপিআই(এম)'র পক্ষ থেকে, কংগ্রেস প্রার্থীর পক্ষ থেকে। অভিযোগ গিয়েছিল পুলিশ কর্তৃপক্ষের কাছেও। সেদিন যদি ওই মজুত বেআইনি অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার হতো তাহলে তামান্নাকে হারাতে হতো না। আসলে তামান্নার খুনি অনেকেই।
তামান্নার মার অভিযোগ পুলিশ নিতেই চায়নি। মার চোখের সামনে সন্তান লুটিয়ে পড়েছে। নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করেছে খুনিদের। ২৪ জনের নামে অভিযোগ। মীনাক্ষী মুখার্জির নেতৃত্বে ছাত্র যুব– পার্টির রাজ্য নেতৃত্ব সহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ যেভাবে থানায় গিয়ে চাপ সৃষ্টি করেছে, তাতেই বাধ্য হয়েছে এফআইআর নিতে। 'বাংলা তার নিজের মেয়েকে চায়' বলে নিজের বিজ্ঞাপন দলকে দিয়ে করিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। অথচ বাংলার গ্রামের ছোট্ট মেয়ে যখন হারিয়ে গেল, তখন তিনি দীঘায় জগন্নাথ মন্দিরে ব্যস্ত। এদিকে কোনোমতে ২৪ জন অভিযুক্তর ন’জনকে কেবল পুলিশ ধরেছে। বাকিরা দিব্যি স্বচ্ছ জলে মাছের মতো অবাধে বিচরণ করছে এলাকায়। পুলিশের কিছু করার নেই। কান ধরে টানা আছে। মুখ্যমন্ত্রীর চাপেই 'বোমা মারা'র কথা প্রত্যাহার করা হয়েছে। স্প্লিন্টার বলেই খালাস। জেলার এসপি ঘটনাকে 'দুর্ঘটনা জনিত' বলে মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, তবে পারেননি।
মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, দোষীদের কড়া সাজা দেওয়া হবে। উলটে অভিযুক্তদের তালাবন্ধ বাড়ির সামনে পুলিশ বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। যাতে ক্রোধে কেউ তাদের বাড়িতে হামলা না করতে পারে। মমতার পুলিশ এরাজ্যে অপরাধীদের রক্ষা করতে ব্যস্ত, এটাই এরাজ্যের সরকারের নীতি।
অদৃশ্য অক্ষরে শিরদাঁড়ার নতুন ইতিহাস রচিত হচ্ছে। আনিস খানের বাবার জন্য তৈরি করা পুরানো চিত্রনাট্য প্রয়োগ হয়েছে তামান্নার মা’র প্রতিও। প্রথমে আইপ্যাক, ঘোরানো পথে। তারপর ডেবরার এমএলএ, প্রাক্তন মন্ত্রী, প্রাক্তন ডিআইজি হুমায়ুন কবির। যিনি মন্ত্রী থাকাকালীন চাকরি দেওয়ার লোভ দেখিয়ে আদিবাসী মেয়ে সবিতা লায়েককে নিজের বাড়িতে কাজের লোক হিসাবে ব্যবহার করে নিজের পোষা কুকুরের মল পরিষ্কার করিয়েছিলেন। ইনিই এসেছিলেন টাকার খাম দিয়ে তামান্নার মা সাবিনার মুখ বন্ধ করতে। ক্রুদ্ধ মায়ের পালটা প্রশ্ন— আমার মেয়েকে ফেরত দিতে পারবে? আমার মেয়েকে যারা খুন করেছে তাদের গ্রেপ্তার করতে পারবে? আমার মেয়েকে মমতার দল খুন করেছে, তুমি সেই দলে কেন?
ঘটনার পর ছয়দিন অতিক্রান্ত। মুখ্যমন্ত্রী আসেননি। সদ্য নির্বাচিত তৃণমূলের মহিলা বিধায়িকা খলিফা আহমেদ ঘটনার দিন বলেছিলেন— আমারও তো মেয়ে আছে, এ ঘটনা মানা যায় না। আজ অবধি তার সময় হয়নি কন্যাহারা মায়ের পাশে দাঁড়াতে। এমনকি তৃণমূলের ব্লক সভাপতি, ওই গ্রামেই থাকেন। তিনিও যাননি। বিজেপি’র প্রার্থী নিয়ম রক্ষায় একবার ওদের বাড়িতে গিয়েছিলেন। আর কোনও বিজেপি নেতার দেখা নেই। ওরা অবশ্য পহেলগ্রাম ঘটনার সময় শহীদ সেনা ঝন্টু আলি শেখের শরীরে মালা দেয়নি, বাড়িতে যায়নি। সোশাল মিডিয়ায় দেখা গেছে বিজেপি’র নদীয়া উত্তর সভাপতি ফোনে বলছেন, মুসলমানদের কাছে গিয়ে লাভ নেই। ওরা আমাদের ভোট দেয় না। ঘৃণ্য এই ধর্মীয় বিভাজন প্রসারিত হয়েছে ওদের শীর্ষ বিধানসভার বিরোধী দলনেতা পর্যন্ত। মুর্শিদাবাদে নিহত হরগোবিন্দ দাস এবং চন্দন দাসের পরিবারকে শুভেন্দু অর্থ সাহায্য করেন ১০ লাখ টাকা। ঝন্টু আলী শেখের পরিবারকে অর্থ সাহায্য করেন দু’লাখ টাকা। শহীদেও ‘ধর্ম’ পাল্লার বৈষম্য তৈরি করা হয় হিন্দু -মুসলমান নিক্তিতে। এরাজ্যের রাজনীতিতে নৃশংসতা আর অমানবিকতার সৃজনশীল অমানবিকতার নতুন অধ্যায় যুক্ত করছে তৃণমূল-বিজেপি।
এই উপনির্বাচনেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যালঘু ভোট পেয়েছে তৃণমূল। তামান্নার খুনের পরে তাদের উদ্বেগ ঝড়ে পড়েছে। বিজেপি-কে সামনে রেখে সংখ্যালঘু নিরাপত্তার ওপর জোর দিয়ে তৃণমূল সংখ্যালঘুর ভোট নিচ্ছে। কিন্তু আদতে কি করছে? ওয়াকফ আন্দোলনের গলা চেপে ধরেছেন মুখ্যমন্ত্রী। কাকে খুশি করতে? ওবিসি শংসাপত্র, চিহ্নিতকরণ নিয়ে সরকারের যে অদক্ষ পদচারণা, তা কোন উদ্দেশ্য নিয়ে? পশ্চাৎপদ হিসাবে সংখ্যালঘুদের সংরক্ষণে সরকার যে অনুদ্যোগী, তা কি সঙ্ঘ পরিবারকে খুশি করতে? মুখ্যমন্ত্রী কি দেখছেন না, রাজ্য থেকে কাজ না পেয়ে বেরিয়ে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের এক উল্লেখযোগ্য অংশ সংখ্যালঘু! একটি মুসলিম মেয়ে খুন হলো। ২৪ জন অভিযুক্তই মুসলিম, সংখ্যালঘু। তাহলে সংখ্যালঘু পায়নি অধিকার সামাজিক সম্মান জীবন যাত্রার মানের উন্নয়ন সুযোগ, অথচ তাদের হাতে বোমা বন্দুক ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অবৈধ পথে অর্থ উপার্জনের চোরা রাস্তার সন্ধান দেওয়া হচ্ছে। সঙ্ঘ পরিবার, বিজেপি মুসলিমদের জিহাদি বলে যেভাবে চিত্রায়িত করতে চাইছে, মমতা সেই চিত্রে তুলি বোলাচ্ছেন। সিদ্দিকুল্লারাও চুপ। ওয়াকফে যিনি বাঘ হয়েছিলেন, এখন তিনি 'পুনর্মুষিক ভব'।
এই নির্বাচনে বিজেপি’র গর্বের হিন্দুর ভোটেও হাত বাড়িয়েছে তৃণমূল। তাই তামান্নার পরিবারের পরিবর্তে দীঘা জগন্নাথ মন্দিরে মনোনিবেশ করেছেন তিনি। নিরামিষ সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে যাওয়া আরএসএস’র সঙ্গে মেলবন্ধনের ইঙ্গিত। তৃণমূল এবং বিজেপি’র তরজা এখন রাস্তায় নেমে জয় জগন্নাথ বনাম জয় শ্রীরামে দাঁড়িয়েছে। তৃণমূল সরকারি পৃষ্ঠপোষণায় দীঘার জগন্নাথ মন্দিরের প্রসাদ বিলি করে। পালটা বিজেপি পুরীর স্বর্গদ্বারের গজা বিলি করে, কাজ হারানো শ্রমিক, ফসলের দাম না পাওয়া নিঃস্ব চাষি, বেকার গরিবদের বাড়ি। কি কুৎসিত সংসদীয় রাজনীতির ধর্মীয়করণ! এরাজ্যের বিধানসভাও এখন ধর্মীয় সভায় রূপান্তরিত। সরকারি দল নিজেদের কৃত পাপের চিহ্ন মুছে দেওয়ার জন্য নীরব থাকবে এটা বোঝা যায়। কিন্তু বাঙ্ময় বিরোধী দলনেতা এত বড় নারকীয় ঘটনা নিয়ে কোনও শব্দ উচ্চারণ করলেন না। কেন? কেবল খুন হওয়া মেয়ে মুসলমান বলে? এখানেও সংখ্যাগুরুর ভোটের টানে তথাকথিত হিন্দুত্ববাদীদের কাছে চাপা পড়ে গেল মানবিকতা!
তামান্নার মা বাবা আতঙ্কিত। ওদের রাতে ঘুম নেই। সারারাত উঠানে গুজরান। তাদের একটাই চিন্তা, ওরা তামান্নাকে মেরেছে। তামান্নার আছে স্বজনরা। ওদেরও কি একই দশা হবে? পুলিশ এসে বলছে আপনারা ঘুমান; যে পুলিশ অপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে পারে না, তাদের আড়াল করে। কে বলতে পারে আমরা ঘুমালে তারাই হন্তারক হবে কি না? বাড়ির ভিতরে বাঁশতলায় ঢুকে যারা তামান্নাকে বোমা মেরে খুন করতে পারে, যারা খুন করার পরেও তামান্নার বাবাকে মোবাইলে হুমকি দিতে পারে, তারা আর কি পারে? তামান্নার গ্রামের লোকেরা রাত পাহারা দিচ্ছে। তাদের চোখের জলে কবর ভিজেছে। গ্রামের মানুষ শপথ নিয়েছে, তামান্নার কবরের মাটি ছুঁয়ে— এরাজ্যের জঙ্গল রাজের অবসান ঘটাবোই। আমাদের ফুটফুটে মেয়েটা মাংসের দলা হয়ে ফিরে এসেছে। ঘৃণ্য রাজনীতির এ রক্ত পিপাসার প্রতিশোধ আমরা নেবো। শাসকের বিজয় উল্লাসে আমাদের ঘরের মেয়ে শব হয়েছে। আমরা এদের ছেড়ে দেবো না। গ্রামের মানুষ তামান্নার কবরের মাটি মহম্মদ সেলিমের কাছে পৌঁছে দিয়েছে, গ্রামের কথা সারা রাজ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য। তামান্নার মা সাবিনা ইয়াসমিনের বুক ফাটা আর্তনাদ বড় কানে বাজছে— তামান্নাকে ফিরিয়ে দাও, না হলে বিচার দাও।
Comments :0