নোবেল শান্তি পুরস্কার পাবার জন্য মার্কিন রাষ্ট্রপতি এতটাই উতলা হয়ে পড়েছিলেন যে দুনিয়ার সামনে নিজেকে শান্তির দূত হিসাবে প্রতিপন্ন করতে তড়িঘড়ি গাজায় সংঘর্ষ বিরতির জন্য ২০ দফা শান্তি প্রস্তাব তৈরি করে দু’পক্ষকে সমঝোতায় আসার ব্যবস্থা করেন। একাজে অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতার দায়িত্ব পালন করে মিশর, কাতার ও সৌদি আরব। এটা ঠিক দু’বছরের ওপর চলতে থাকা গাজায় ইজরায়েলি গণহত্যা থামানোর ক্ষেত্রে এই সমঝোতা তথা আপাত শান্তি নিঃসন্দেহে স্বস্তিদায়ক, তবে স্থায়ী শান্তির ভিত্তি প্রস্তাব নয়।
নোবেল শান্তির বাসনায় তড়িঘড়ি শান্তি প্রস্তাব তৈরি হলেও ২০ দফার কোনোটিই ট্রাম্প নিজের মরজি মতো চিহ্নিত করেননি। সবকটিই হয়েছে গণহত্যার নায়ক ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানেয়াহুর সঙ্গে পরামর্শ ও বোঝাপড়ার ভিত্তিতে। ২০ দফার দিকে তাকালেই স্পষ্টত বোঝা যায় ইজরায়েলের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থকে সুরক্ষিত রেখে এবং প্যালেস্তাইনিদের স্বার্থকে অস্বীকার করে দফা সাজানো হয়েছে। স্বাধীন প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রের দাবিতে প্যালেস্তাইনিদের মুক্তি সংগ্রাম সম্পর্কে যারা কমবেশি ওয়াকিবহাল তারা সকলেই জানেন পশ্চিম এশিয়ায় স্থায়ী শান্তির একমাত্র শর্ত স্বাধীন প্যালেস্তাইন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। বিশ্বের ৮১ শতাংশ দেশ এমনকি মার্কিন সহযোগী ইউরোপের দেশগুলিও এই প্রশ্নে একমত। এই সব দেশগুলি সকলেই স্বাধীন প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে। কেবলমাত্র আমেরিকা এবং আমেরিকার অনুগত দেশই স্বাধীন প্যালেস্তাইন রাষ্ট্র মেনে নিতে রাজি নয়।
মধ্য এশিয়া তথা সমগ্র আরব দুনিয়ায় আমেরিকার পা রাখার শক্ত মাটি আছে ইজরায়েলে। বস্তুত ইজরায়েলের অস্তিত্ব পুরোপুরি নির্ভরশীল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থকে ঘিরে। ইজরায়েলের জন্ম থেকে তার প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়া, প্যালেস্তাইন ভূখণ্ড দখল করে প্রসারিত হওয়া ইত্যাদি সবটাই মার্কিন বরাভয়ের জোরে। প্রতি বছর আমেরিকা থেকে বিপুল আর্থিক, সামরিক সহায়তা পায় ইজরায়েল। যে কোনও ধরনের সমস্যায় কূটনৈতিকভাবে রক্ষা করে আমেরিকা। অনেকে মনে করেন পশ্চিম এশিয়ায় আমেরিকারই অঘোষিত অগ্রণীবাহিনী ইজরায়েল। ইজরায়েলকে সামনে রেখে আমেরিকা যুগ যুগ ধরে পশ্চিম এশিয়ায় তাদের আধিপত্য বজায় রেখে চলেছে। ইজরায়েল যদি দুর্বল হয় বা কোণঠাসা হয় তাহলে সেটা আমেরিকারই পশ্চাদপসরণ। তাই গত দু’বছর ধরে ইজরায়েল গণহত্যা চালিয়ে লক্ষ মানুষ খুন করতে পেরেছে আমেরিকার সাহায্যে। আমেরিকা না চাইলে গাজায় এই দীর্ঘ হত্যালীলা চলত না।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি আমেরিকাকেও হাত গোটাতে বাধ্য করেছে। বিশ্বজুড়ে ইজরায়েল গণহত্যাকারী দেশ হিসাবে নতুন পরিচিতি পেয়েছে। মার্কিন সঙ্গী ইউরোপের দেশগুলি ক্ষুব্ধ হয়ে প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে। আরব দুনিয়ায় আমেরিকার সঙ্গে সু-সম্পর্কযুক্ত দেশগুলিও সন্দিহান হয়ে উঠেছে। এই অবস্থায় ইজরায়েল কার্যত এক ঘরে হয়ে যাওয়ায় ট্রাম্প বাধ্য হন যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ নিতে। উদ্যোগ নিলে ‘জাতে মাতাল তালে ঠিক’-র মতো ইজরায়েলের দীর্ঘ মেয়াদি স্বার্থকে সুরক্ষিত রেখেই প্রস্তাব তৈরি করেছেন। কোনও অবস্থাতেই যাতে প্যালেস্তাইন স্বাধীন রাষ্ট্র হতে না পারে সেটাই ছিল ট্রাম্পের প্রধান লক্ষ্য। প্যালেস্তাইনের স্বাধীনতার বদলে গোটা প্যালেস্তাইন ভূখণ্ড ইজরায়েলের দখলে নেবার চূড়ান্ত ছক মাথায় রেখেই সাজানো হয়েছে ২০ দফার খসড়া।
Editorial
‘জাতে মাতাল তালে ঠিক’

×
Comments :0