ঈশিতা মুখার্জি
দেশের জিডিপি বা জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির হার নিয়ে দেশের সরকারের বড়ই গর্ববোধ হয়েছে। ভারত বিশ্বের দরবারে চতুর্থ হয়ে যাবে জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির হারের নিরিখে— এরকমই খবরে প্রকাশ। খোদ আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার এই বাবদ সার্টিফিকেট দিয়েছে দেশের সরকারকে। তাহলে আর মোদী সরকারের এত সমালোচনা করছ কেন— এরকমই ভাবখানা দেশের বিজেপি সরকারের। এই সরকারের আমলেই তো এত বাড়বাড়ন্ত— এই সামান্য কথাটা দেশের মানুষ বুঝতে পারছে না কেন?- এরকম কথা শোনা যাচ্ছে সরকারি দপ্তরগুলির করিডরের আনাচে কানাচে। নিন্দুকেরা এবার হয়েছে জব্দ— এই ভেবে এবং বলে খুশি সরকার পক্ষের মানুষজন। এই টালমাটাল সময়ে যখন দীর্ঘ মন্দায় বিশ্ব আর্থিক ব্যবস্থা আক্রান্ত, তখন ভারতের সরকার এরকম মনমোহিনী পরিসংখ্যান হাজির করে চমক দিয়েছে বলে নানাদিকে প্রচার হচ্ছে।
এই পরিসংখ্যানের উৎস কি? আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার ভবিষ্যৎবাণী করেছে যে এই বছরেই ভারত জাপানের অর্থনীতিকে ছাপিয়ে বিশ্বে চতুর্থ অর্থনীতি হয়ে উঠবে। আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার বা আই এম এফ যে বিশ্ব অর্থনীতির খতিয়ান প্রতি বছর প্রকাশ করে, এই বছর সেই রিপোর্ট জানিয়েছে যে ২০২৬ সালের মধ্যে ভারতের জিডিপি আনুমানিক ৪১৮৭.০১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছাবে যা জাপানের আনুমানিক জিডিপি যা ৪১৮৬.৪৩১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার তার চেয়ে বেশি। এই দুটি অনুমানের পরিসংখ্যান পাঠকের কাছে রাখা হলো এই কারণে যে এই অনুমান দুটির মধ্যে ফারাক কিন্তু বিশেষ নেই। তাও এই আনুমানিক ভিত্তির উপরেই প্রচার পেল যে ভারত জাপানকেও ছাড়িয়ে চলেছে। তাহলে দেশের বৃদ্ধির হার নিয়ে নানা জনের নানা মত শোনা যাক। আইএমএফ বলেছে যে ভারতের অর্থনীতির বৃদ্ধির হার ২০২৫ সালে আনুমানিক ৬.২% এ দাঁড়াবে এবং ২০২৬ সালে আনুমানিক ৬.৩% এ দাঁড়াবে। কিন্তু “বাবু যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ”, তাই দেশের সরকারের পরিসংখ্যান আমাদের আরও সোনালি রুপোলি তথ্য শোনালো। কি সেই তথ্য? রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানালো দেশের বৃদ্ধির হার ৮.২%। দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং বিজেপি দলের প্রচার তুঙ্গে উঠল যে বিজেপি’র আমলেই বিশ্বের দরবারে দেশের অর্থনীতির এত উন্নতি।
এই পরিসংখ্যানে সমস্যা কোথায়? পরিসংখ্যানে ভুল নেই। কিন্তু যা আছে তা অর্ধসত্য। এই ধরনের পরিসংখ্যানে দুটি দিক থাকে। এক,মুদ্রাস্ফীতি মাথায় না রেখে টাকার অঙ্কে মোট জিডিপি’র পরিমাণ। অন্যটি হলো, প্রকৃত জিডিপি যা মুদ্রাস্ফীতি মাথায় রেখে পরিমাপ করা। মুদ্রাস্ফীতি মাথায় রেখে পরিমাপ করলে বোঝা যায় যে এই জিডিপি দিয়ে কত জিনিস কেনা যায়। কিন্তু প্রকৃত জিডিপি’র হার না মাপলে এই হার কি কাজে আসে তা বোঝা যায় না। আইএমএফ’র পরিসংখ্যান টাকার অঙ্কে মোট জিডিপি’র হার, প্রকৃত নয়। তাহলে আইএমএফ এরকম পরিসংখ্যান দিল কেন? প্রতি বছরই এরকম পরিসংখ্যান আইএমএফ দেয় প্রতিটি দেশের মোট অর্থনীতির আকার, ব্যাপ্তি বোঝানোর জন্য। স্বাভাবিকভাবেই বড় দেশ, বেশি জনবসতি, বেশি লেনদেনের দেশের আর্থিক ব্যাপ্তি বেশি। কিন্তু তা দিয়ে এই জিডিপি’র প্রকৃত বৃদ্ধির হার বোঝা যায় না। এই জিডিপি দিয়ে কি করা যায় সে বিষয়েও কিছু অনুমান করা সহজ হয় না টাকার অঙ্কে জিডিপি’র হিসাব দেখে। এই পরিসংখ্যানের আরেকটি অসুবিধা হলো এই যে এই পরিসংখ্যান মার্কিন ডলারে মোট জিডিপি। সব দেশের জিডিপি-কেই মার্কিন ডলারে মাপা হয়েছে। তাহলে কি বিভিন্ন দেশের মুদ্রার সাথে মার্কিন ডলারের বিনিময় মূল্য এই পরিসংখ্যানে প্রভাব ফেলবে না? নিঃসন্দেহে ফেলবে। এ ছাড়াও বিভিন্ন দেশে ক্রয়ক্ষমতার তারতম্য বিভিন্ন। প্রকৃত জিডিপি দেখলে এবং বিভিন্ন দেশের ক্রয়ক্ষমতার নিরিখে সেই পরিমাপকে বিচার করলে এই জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির হার কি কাজে লাগে তা বোঝা যায়। আইএমএফ’র পরিসংখ্যানেই পাওয়া যায় যে বিভিন্ন দেশের ক্রয় ক্ষমতা সমতার নিরিখে মাপা জিডিপি বৃদ্ধির হারে ভারতের স্থান ২০০২ থেকে ক্রমাগত নেমে এসে এক স্থানে দাঁড়িয়ে আছে আজ ২০১০ সালের পর থেকে। এর কারণ বিভিন্ন দেশের মুদ্রার সাথে মার্কিন ডলারের বাজারে বিনিময় মূল্যের তফাৎ এবং বিভিন্ন দেশের মধ্যে সেই দেশের মুদ্রা বাবদ পণ্য কেনার দামের তফাৎ। তাই এই তফাৎ গুলির জন্যই যে পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে ভারতকে শ্রেষ্ঠ স্থান দেওয়া হচ্ছে, তা দিয়ে বিভিন্ন দেশের প্রকৃত অর্থনীতির তুলনা করা যায় না। এর জন্যই এই তথ্য অর্ধসত্য।
এই পরিসংখ্যানে দ্বিতীয় সমস্যা হলো যে কোনও দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হারে জোয়ার ভাটার মতো নানা তরঙ্গ হয়। সেই তরঙ্গের মধ্যে যে কোনও অর্থনীতির স্বাভাবিক উত্থান পতন থাকে। বেশ কয়েক বছরের পরিসংখ্যান একসঙ্গে চোখের সামনে থাকলে অর্থনীতির এই স্বাভাবিক ওঠাপড়া চোখে পড়ে। এর মধ্যে কিছু সাময়িক ওঠা পড়া থাকে, কিছু আর্থিক বৃদ্ধি জনিত ওঠা পড়া থাকে। এরকম ঢেউয়ের মতই চলে আমাদের অর্থনীতি। সেই ঢেউয়ের কোন জায়গায় একটি বছরের অর্থনীতি রয়েছে, তা না বুঝলে এই বৃদ্ধির হার নিয়ে বড়াই করার কোনও কারণই খুঁজে পাওয়া যায় না। অর্থনীতির এই ওঠাপড়ার কোনও উল্লেখ না করে এই আস্ফালন একেবারেই শূন্য হয়ে যায়।
সম্প্রতি দেশের সরকারি পরিসংখ্যানেই এই ফাঁপা আস্ফালনের বিষয়টি বেরিয়ে পড়েছে। দেশের পরিসংখ্যান দপ্তর ২০২৪-২৫ সালের ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে জিডিপি বৃদ্ধির হার প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে যে গত বছরে কোভিড পরবর্তী সময়ে ২০২৫ সালের বৃদ্ধির হার সর্বনিম্ন। ২০২০-২১ সালের পর এই বছরের আর্থিক বৃদ্ধির হার সবচেয়ে শ্লথ। সরকারের তথ্যেই জানা যাচ্ছে যে ২০২৪-২৫ সালের শেষ তিন মাসে প্রকৃত জিডিপি বৃদ্ধির হার ৭.৪% হয়েছিল যা তার আগের ত্রৈমাসিক বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি, কিন্তু গত দুই বছরের বৃদ্ধির হারের চেয়ে তা বেশ খানিকটা কম। যদি আর্থিক ক্ষেত্র অনুযায়ী এই বৃদ্ধির হারকে ভেঙে দেখা যায়, তবে পরিসংখ্যান চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে বছরের শেষ তিন মাসে কৃষি,পশুসম্পদ,বনসম্পদ, এবং মাছচাষে বৃদ্ধির হার ছিল ৫.৪%- এতেই বৃদ্ধির হারকে উপরে উঠতে সাহায্য করেছে। শিল্পপণ্যের উৎপাদনে বৃদ্ধির হার গত এক বছরে ১২.৩% থেকে ৪.৫% এ নেমে এসেছে। নির্মাণ ক্ষেত্রে উন্নতি লক্ষ্য করা গেছে শেষ তিন মাসে কিন্তু এক্ষেত্রেও সারা বছরে বৃদ্ধির হার ৯.৪% যা গত বছরের ১০.৪% এর থেকে কম। পরিষেবা ক্ষেত্রেও বৃদ্ধির হার গত বছরের চেয়ে কম। তাই ওঠাপড়ার মধ্যে এখন আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি এই কথা বিবেচনায় আনা জরুরি। কোভিডের পরবর্তী সময়ে চলতি বছরে আর্থিক বৃদ্ধির হার সবচেয়ে নিচে— এই তথ্য সরকারি পরিসংখ্যানে প্রকাশিত হওয়ার পড়েও জিডিপি’র হার নিয়ে এই ফ্ল্যাশলাইটের আভা কি একটু কম হবে? হওয়া তো উচিত পরিসংখ্যান বলছে, কিন্তু প্রচার মাধ্যম, কর্পোরেটের গণমাধ্যম তা হতে দিচ্ছে কই?
এই ধরনের পরিসংখ্যান নিয়ে হইচইয়ের তৃতীয় সমস্যায় চলে আসি। সমস্যাটি নজরে পড়েছে অনেকের। জিডিপি বৃদ্ধির হার সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানকে কতটা প্রভাবিত করে? অর্থাৎ দেশের জিডিপি’র হার বাড়লে আমার আপনার কি আসে যায়? আদৌ কিছু আসে যায় কিনা তা জানতে গেলে দেশের মোট জিডিপি’র হার নয় মাথা পিছু জিডিপি’র হার দেখতে হয়। যে জাপানের অর্থনীতিকে ছাড়িয়ে যাবে বলে এত প্রচার হলো, ২০২৫ সালে সেই জাপানের মাথা পিছু জিডিপি’র চেয়ে ভারতের মাথা পিছু জিডিপি ১২ গুণ কম। আবার এমন দেশ আছে যার জনসংখ্যা কম এবং ভৌগোলিক আকার কম বলে মোট জিডিপি ভারতের চেয়ে কম হলেও মাথা পিছু জিডিপি ভারতের চেয়ে অনেক বেশি। এরকম একটি দেশ হলো পোল্যান্ড। পোল্যান্ডের মোট জিডিপি ভারতের চেয়ে চার গুণ কম হলেও, মাথা পিছু জিডিপি নয় গুণ বেশি। মাথা পিছু জিডিপি বোঝায় যে আদৌ এই বৃদ্ধির হার দেশের মানুষের কোনও কাজে লাগবে কি না।
মানুষের জীবনে এই জিডিপি বৃদ্ধির প্রভাব কতটুকু? জিডিপি বৃদ্ধির হার কি দেশের মানুষের বেকারত্ব, মজুরি কমে যাওয়া, মানুষের বেঁচে থাকার মান ইত্যাদিকে কতটুকু বুঝতে সাহায্য করে? জিডিপি বৃদ্ধির হার বেড়ে গেলেও তো দেশের বেশির ভাগ মানুষের অপুষ্টি, ক্ষুধা বেড়ে যাচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে আর্থিক বিপন্নতা, বেড়ে যাচ্ছে আর্থিক বৈষম্য। নীতি আয়োগ,রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, মোদী দেশের মানুষকে সাফল্যে গর্বে আহ্লাদ করতে বলছে, কিন্তু খালি পেটে, বন্ধ স্কুলকলেজ, ভগ্ন স্বাস্থ্যে, অপুষ্টিতে দেশের বেশির ভাগ মানুষ আহ্লাদ করবে কি করে? এই জিডিপি বৃদ্ধির হার কতটুকু দেশের মানুষের কাছে চুইয়ে আসবে, বা আদৌ আসবে কিনা, তা কি দেশের মানুষ জানে? দেশের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে দেশের উন্নতির কথা কোনোদিনই ভাবেনি মোদী সরকার। কাজেই নীতি আয়োগকে ভাবতে হয় না দেশের বেশির ভাগ মানুষের বেড়ে যাওয়া আর্থিক বিপন্নতার সঙ্গে কিভাবে পাল্লা দিয়ে আর্থিক অগ্রগতির ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে। এই দুই বিপরীত গতি আসলে কোন সর্বনাশকে গোপন করছে? কেন জিডিপি বৃদ্ধির হার নিয়ে এই প্রচারের সাথে বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে দেশের অধোগতি অব্যাহত? কেন বারে বারে দেশের বেশির ভাগ মানুষকে বঞ্চনা করার জন্য, ভুল বোঝানোর জন্য আর্থিক পরিসংখ্যানকে প্রকাশ করা হবে না, নানা তথ্য গোপন করা হবে? এই প্রশ্নে বারে বারে দেশের বিদেশের আর্থিক বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন করেছেন, কিন্তু মোদী সরকার এই প্রশ্নের উত্তর দেয়নি।
Comments :0