গার্গী চ্যাটার্জি
আগামী ১৩ থেকে ১৫ জুন,২০২৫ পূর্ব মেদিনীপুরের শিল্পনগরী হলদিয়ায় অনুষ্ঠিত হতে চলেছে সিআইটিইউ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির ত্রয়োদশ সম্মেলন। এই সম্মেলন শুধুমাত্র একটি সাংগঠনিক বৈঠক নয়, বরং শ্রমিক শ্রেণির রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংগ্রামের এক ঐতিহাসিক অধ্যায়ের সন্ধিক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের মঞ্চ । এই সম্মেলনের গুরুত্ব আজকের সংকটময় সময়ে আরও বহুগুণে বেড়ে গেছে, যেখানে গোটা দেশ এক অঘোষিত নব্য ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের মুখোমুখি।
শ্রমিকশ্রেণি এক সংকটাপন্ন সময়ে দাঁড়িয়ে ভারতের আজকের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত এক গভীর সংকটের দিশা দেখাচ্ছে। কর্পোরেট স্বার্থে পরিচালিত কেন্দ্রের মোদী সরকার অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে দেশের শ্রমজীবী জনগণের অধিকারকে ক্ষয়িষ্ণু করে তুলেছে। ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক বিভাজন, রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদের বেসরকারিকরণ, শ্রম কোডের নামে শ্রমিক স্বার্থে চালু থাকা আইনগুলিকে নিষ্ক্রিয় করে তোলা, মজুরি হ্রাস, চাকরি হ্রাস, সামাজিক নিরাপত্তার বিলোপ—এই সবকিছু মিলিয়ে এক প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্র গড়ে তোলার চক্রান্ত চলছে।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের আবহে প্রযুক্তির দোহাই দিয়ে শ্রমিকের বাস্তব চাহিদাকে অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। gig economy, contract labour, fixed term employment-এর মতো নীতিতে স্থায়িত্বের নিশ্চয়তা নেই। কর্মসংস্থান সৃষ্টি দূরের কথা, বর্তমানে চলতে থাকা কর্মসংস্থানও আজ অনিশ্চয়তার মুখে।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স : শ্রমজীবী মানুষের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ
আজ বিশ্বজুড়ে চলছে তথাকথিত চতুর্থ শিল্প বিপ্লব—যেখানে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI), অটোমেশন, রোবটিক্স, বিগ ডেটা, ক্লাউড কম্পিউটিং ও মেশিন লার্নিং-এর মতো প্রযুক্তি দ্রুত শ্রমবাজারকে বদলে দিচ্ছে। এই পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে উৎপাদন প্রক্রিয়ার ডিজিটাল রূপান্তর এবং ‘মানুষ’ বা শ্রমিকের ভূমিকা ধীরে ধীরে কমিয়ে আনার প্রবণতা।
এই বিপ্লবের একটি বিপজ্জনক দিক হলো—মানবশ্রমের স্থানে মেশিন নির্ভরতা বেড়ে যাওয়া, যার ফলে প্রচুর কর্মসংস্থান ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বিশেষত উৎপাদন, পরিষেবা, ট্রান্সপোর্ট, ব্যাঙ্কিং, রিটেইল প্রভৃতি ক্ষেত্রে হাজার হাজার কর্মী কাজ হারাচ্ছেন। এআই প্রযুক্তি ব্যবহারের যুক্তি হিসাবে ‘দক্ষতা বৃদ্ধি’ ও ‘খরচ হ্রাস’-এর কথা বলা হলেও বাস্তবে এই পরিবর্তন শুধু কর্পোরেট লাভ বাড়াচ্ছে, আর শ্রমিকশ্রেণির জন্য তৈরি করছে বেকারত্ব, অনিশ্চয়তা ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার বিভীষিকা।
অন্যদিকে, কর্মসংস্থানে নতুন কিছু ক্ষেত্র তৈরি হলেও, সেগুলি অত্যন্ত সীমিত, প্রতিযোগিতাপূর্ণ এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চুক্তিভিত্তিক ও অনিশ্চিত। এছাড়া নতুন প্রযুক্তির প্রয়োগে শ্রমিকদের পুনঃপ্রশিক্ষণ বা re-skilling কার্যত হচ্ছে না বা অতি নগণ্য হারে হচ্ছে। ফলে, দক্ষতা বিভাজনের মাধ্যমে এক নতুন ধরনের টেকনোলজিক্যাল শ্রেণিচ্যুতি তৈরি হচ্ছে।
আরও গভীর সমস্যা হলো, এই ডিজিটাল প্রযুক্তির মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ একচেটিয়া কিছু গ্লোবাল কর্পোরেট সংস্থার হাতে। এআই ও ডেটা-ভিত্তিক অর্থনীতি শ্রমিকদের তথ্য অধিকারও হরণ করছে—surveillance capitalism এখন বাস্তবতা। কর্মক্ষেত্রে নজরদারি, উৎপাদনশীলতা পরিমাপের নামে মনুষ্যত্বহীন আচরণ, এবং ‘অ্যালগোরিদমিক শাসন’ একটি অদৃশ্য ফ্যাসিবাদী চরিত্র তৈরি করছে।
শ্রমিক আন্দোলনের উপর রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন শ্রমিকদের সংগঠিত প্রতিরোধকে দমন করতে কেন্দ্রীয় সরকার বারবার আইনি অস্ত্র ব্যবহার করেছে। ধর্মঘটের গণতান্ত্রিক অধিকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তাকে অপরাধ হিসাবে দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে। বিভিন্ন রাজ্যে আন্দোলনরত শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেপ্তার, ছাঁটাই—এইসব নিপীড়ন নিত্যদিনের চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এর পাশাপাশি, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের ভূমিকাও কম উদ্বেগজনক নয়। দুর্নীতি, তোলাবাজি, চাকরির নামে প্রতারণা, রাজ্য প্রশাসনের প্রত্যেক স্তরে মাফিয়াচক্রের দৌরাত্ম্য—এইসব পরিস্থিতি শ্রমিক স্বার্থের পরিপন্থী। রাজ্যে সরকারি হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পরিবহণ ব্যবস্থা—সবকিছুতেই বেসরকারিকরণের ভূতের ছায়া পড়েছে। এর পাশাপাশি রাজ্যের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে শাসকদলের লুটেরা বাহিনীর দ্বারা শ্রমিক সংগঠনের গণতান্ত্রিক কার্যক্রমে বাধা, ভয়ভীতি প্রদর্শন, ধর্মঘট প্রতিহত করার অপচেষ্টা—সব মিলিয়ে আন্দোলনকে দমন করার এক অভিন্ন ফ্যাসিবাদী চরিত্রই প্রতিফলিত হয়েছে।
উভয় সরকারের মালিকশ্রেণির পক্ষে দৃঢ় অবস্থানের প্রেক্ষিতে : শোষণের মাত্রা আরও ভয়ঙ্কর
বর্তমান সময়ে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য—উভয় সরকারের চরিত্রই স্পষ্টভাবে কর্পোরেট ও মালিকপক্ষের স্বার্থরক্ষায় নিবেদিত। শ্রমিক স্বার্থকে পদদলিত করে, সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলনের প্রভাবকে খর্ব করে মালিকশ্রেণিকে সম্পূর্ণরূপে ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে মালিকপক্ষ আজ আগের থেকে আরও সাহসী, আরও নির্লজ্জ, এবং আরও নিপীড়ক ভূমিকা গ্রহণ করেছে।
তাদের এই বেপরোয়া দুঃসাহস এতটাই বেড়ে উঠেছে যে, অনেক ক্ষেত্রেই সরকার স্বীকৃত ত্রিপাক্ষিক চুক্তি, যা শ্রমিক-নিয়োগকর্তা-সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি আইনসিদ্ধ ও ন্যায্য বোঝাপড়া, সেগুলিকে ঘৃণাভরে লঙ্ঘন করা হচ্ছে। ত্রিপাক্ষিকতার ন্যূনতম নীতি ও দায়বদ্ধতাকেও তারা মেনে চলার প্রয়োজন বোধ করছে না।
শ্রমিক স্বার্থে স্বাক্ষরিত বহু গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি— যেমন বেতন কাঠামো, সামাজিক নিরাপত্তা, কাজের পরিবেশ, পুনর্নিয়োগ বা ছাঁটাই সংক্রান্ত শর্তাবলি—এসবকিছুকে তারা নির্বিচারে অগ্রাহ্য করছে। তার উপর, প্রশাসনিক স্তর থেকেও এদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে একপ্রকার অনীহা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বরং প্রশাসনের একাংশ মালিক পক্ষের এই স্বার্থরক্ষাকারী ভূমিকারই পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ সহায়ক হিসাবে কাজ করছে।
এই প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে আসে—ত্রিপাক্ষিক ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ কী? রাষ্ট্র যদি শ্রমিক শ্রেণির অধিকার রক্ষায় নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন না করে, বরং মালিকপক্ষের অনৈতিক সিদ্ধান্তগুলিকে নির্বিঘ্নে কার্যকর করতে সাহায্য করে, তাহলে তা আসলে গণতান্ত্রিক কাঠামোর পরিপন্থী এবং শ্রমিক শ্রেণির ওপর একধরনের ‘নীতিগত বিশ্বাসভঙ্গ’।
সিআইটিইউ ত্রয়োদশ রাজ্য সম্মেলনের সাংগঠনিক তাৎপর্য
এই ভয়াবহ প্রেক্ষাপটে হলদিয়ার সম্মেলন এক গভীর ও সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য বহন করছে। এই সম্মেলন কেবল নেতৃত্ব নির্বাচন বা সাংগঠনিক রিপোর্ট গৃহীত করার সীমায় আবদ্ধ নয়। এই সম্মেলন শ্রমিক শ্রেণি ও তার নেতৃত্বের সামনে একটি রাজনৈতিক ঐতিহাসিক দায়িত্ব অর্পণ করতে চলেছে। শ্রমিক সংগঠন কীভাবে সাম্প্রতিক নব্য ফ্যাসিবাদী কর্পোরেট পুঁজি ও হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির যৌথ আক্রমণ এবং রাজ্যের দুর্নীতি, তোলাবাজি ও মাফিয়াচক্রের দ্বারা পরিচালিত রাজ্য প্রশাসনের আক্রমণকে রুখে দাঁড়াবে, কীভাবে সংগঠন বিস্তৃত করে শ্রেণির সংগ্রামকে বেগবান করবে, সে-কথা এখানে নির্ধারিত হবে।
সম্মেলন থেকেই ঠিক হবে আগামী তিন বছরে—
• শ্রমিক আন্দোলনের রাজনৈতিক লক্ষ্য কী হবে ।
• সংগঠনের ভিত মজবুত করতে কী কার্যক্রম নেওয়া হবে ।
• ধর্মঘট, প্রতিবাদ কর্মসূচি, মিছিল, পথসভা—সব কিছু কেমন করে সংগঠিত হবে ।
• অন্যান্য গণসংগঠন ও শ্রেণি সংগঠনের সঙ্গে কীভাবে সমন্বয় হবে ।
• যুব, মহিলা সহ সংগঠিত ও অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমজীবী মানুষের সংগঠনে নতুন নেতৃত্ব গড়ে তোলার কৌশল কী হবে ।
• সরকার ও মালিকপক্ষের যৌথ আক্রমণ মোকাবিলা করার কোন কৌশল গ্রহণ করা হবে ।
নব্য ফ্যাসিবাদী আক্রমণের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াই সিআইটিইউ মনে করে, আজকের সংকট কেবল অর্থনৈতিক নয়, এটি রাজনৈতিক। কর্পোরেট পুঁজি ও হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির যৌথ আক্রমণ থেকেই জন্ম নিচ্ছে এই ফ্যাসিবাদী চরিত্র। এই শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হলে শ্রমিক শ্রেণিকে শুধু নিজস্ব দাবি নিয়ে আন্দোলনে নামলে চলবে না, তাকে হতে হবে সমাজ বদলের কান্ডারি। তাই সংগঠন বিস্তারের পাশাপাশি মতাদর্শগত লড়াই, রাজনৈতিক সচেতনতা গড়ে তোলা, সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধকে জনপ্রিয় করে তোলার কাজ সম্মেলনের কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয় হওয়া উচিত।
বিকল্প অর্থনীতি, বিকল্প রাষ্ট্রচিন্তা
সম্মেলনে বিকল্প আর্থ-সামাজিক রূপরেখার প্রশ্নটিও জরুরি। সিআইটিইউ বারবার বলে এসেছে—শ্রমিকবান্ধব অর্থনীতি, সামাজিক নিরাপত্তা, সমান বণ্টন ব্যবস্থা, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার রক্ষা, কৃষক-শ্রমিক ঐক্য, শিক্ষার গণতান্ত্রিকীকরণ, স্বাস্থ্য পরিষেবার সর্বজনীনকরণ—এই সকল দাবিই শুধু দাবি নয়, ভবিষ্যতের সমাজচিন্তার ভিত্তি। এই সম্মেলনে সেই দিশা নির্ধারণে তত্ত্বগত ও প্রায়োগিক ভিত্তিতে আলোচনার পরিসর তৈরি হওয়া আবশ্যক।
নবীন নেতৃত্ব ও ভবিষ্যতের প্রস্তুতি
একটি নেতৃত্বদানকারী শ্রেণি সংগঠনের পরিচয় তার ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব গঠনের মধ্য দিয়েও প্রকাশ পায়। সম্মেলনে নবীন, তৃণমূল স্তর থেকে উঠে আসা নেতাদের গ্রহণযোগ্যতা, প্রশিক্ষণ, মতাদর্শগত প্রস্তুতি—এই সব দিকেই মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। বিশেষত মহিলা, তরুণ ও সংগঠিত-অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের নেতৃত্বে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া শক্তিশালী করতে হবে।
৯ জুলাইয়ের সাধারণ ধর্মঘট : সম্মেলনের তাৎক্ষণিক কর্তব্য
সম্মেলনের অব্যবহিত পরে, আগামী ৯ জুলাই দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব হিসাবে সম্মেলনের সামনে উপস্থিত হয়েছে। এই ধর্মঘট কেবল একদিনের প্রতিবাদ কর্মসূচি নয়, এটি শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকার প্রশ্নে এক চূড়ান্ত রাজনৈতিক অবস্থান। সম্মেলন থেকেই এই ধর্মঘটকে সর্বাত্মকভাবে সফল করার ডাক দিতে হবে। শিল্পাঞ্চল থেকে প্রত্যন্ত গ্রামীণ অঞ্চলে, সরকারি ক্ষেত্র থেকে গিগ-অর্থনীতি পর্যন্ত সর্বত্র ধর্মঘটের প্রস্তুতি গড়ে তুলতে হবে।
আজকের যে সময়, তা দ্বিধার নয়, সিদ্ধান্ত গ্রহণের। আজকের সময় পিছিয়ে পড়ার নয়, সংগঠিত হওয়ার। যখন রাষ্ট্রযন্ত্র কর্পোরেট ও সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতে বন্দি, তখন শ্রমিক শ্রেণির ঐক্য, সংগ্রাম এবং মতাদর্শগত দৃঢ়তা—এই তিনের মেলবন্ধনই একমাত্র মুক্তির পথ।
সিআইটিইউ’র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ত্রয়োদশ সম্মেলন হোক সিআইটিইউ’র নেতৃত্বে শ্রমিক শ্রেণির সংগ্রামের নতুন যুগের সূচনা। এই সম্মেলনে উচ্চারিত হোক এক রণধ্বনি, যেখানে প্রতিটি শ্রমিক উচ্চারণ করবে—
‘শ্রমিক শ্রেণির ঐক্য অটুট করো,
শোষণের শৃঙ্খল চূর্ণ করো!’
Comments :0