নির্বাচন কমিশনের চিঠিকে অগ্রাহ্য করে মুখ্যমন্ত্রীর কথা মতোই চার আধিকারিকের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করল না রাজ্য সরকার।
সাসপেন্ড করে এফআইআর করার নির্দেশ দিয়েছিল কমিশন। ব্যবস্থা গ্রহণের উত্তরে রাজ্য স্রেফ এক অস্থায়ী কর্মী সহ এক আধিকারিককে শুধু নির্বাচনী দায়িত্ব থেকে সরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ভোটার তালিকায় ভুয়ো নাম তোলার অভিযোগে, গত ৫ আগস্ট রাজ্যের মুখ্যসচিবকে চিঠি পাঠিয়ে চার আধিকারিক ও এক অস্থায়ী কর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ পাঠিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। পরদিনই ঝাড়গ্রামে দলীয় সভা থেকে নির্বাচন কমিশনকে ‘হরিদাস’, ‘ক্রীতদাস’ বলে তীব্র কটাক্ষ করে জবাব দিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। কোন অফিসারের শাস্তি হবে না জানিয়ে তাঁদের আশ্বস্ত করেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। রাজ্য সরকারের তরফ থেকে ব্যবস্থা গ্রহণের কোনও চিঠি না পেয়ে, গত শুক্রবার কমিশন ফের চিঠি দেয় মুখ্যসচিবকে। কী ব্যবস্থা নেওয়া হলো, জানতে চেয়ে ৭২ ঘণ্টা সময় উত্তরের জন্য বরাদ্দ করে কমিশন।
সোমবার নির্বাচন কমিশনের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যেই রাজ্যের মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ নির্বাচন কমিশনের সচিবের কাছে চিঠি পাঠিয়ে দেন। কিন্তু সেই চিঠিতে আধিকারিকদের বিরুদ্ধে সাসপেনশন নিয়ে একটি শব্দও খরচ করা হয়নি। একই সঙ্গে অভিযুক্ত দুই ডব্লিউবিসিএস (এক্সিকিউটিভ) আধিকারিকদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণের প্রসঙ্গই উল্লেখ করা হয়নি।
যে দুই অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁদের একজন পূর্ব মেদিনীপুর জেলার ময়না বিধানসভা কেন্দ্রের এইআরও (অ্যাসিস্ট্যান্ট ইলেকশান রেজিস্ট্রেশন অফিসার) পদে যুক্ত ছিলেন। তমলুক ব্লকের পঞ্চায়েত অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস অফিসার পদমর্যাদার আধিকারিক সুদীপ্ত দাসকে স্রেফ নির্বাচনী দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার। আর সরকারের তরফে আরও এক অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা নির্বাচন কমিশনকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার পূর্ব বারুইপুর বিধানসভা কেন্দ্রের অস্থায়ী কর্মচারী, ডেটা এন্ট্রি অপারেটর সুরজিত হালদারকেও একই ভাবে নির্বাচনী দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
কমিশনের কাছে মুখ্যসচিবের পাঠানো চিঠির বয়ান দেখে রাজ্যের এক অবসরপ্রাপ্ত শীর্ষ আধিকারিক বলেন, ‘‘কমিশনের চিঠির পর এদিন মুখ্যসচিব যে চিঠি পাঠালেন তা আসলে কমিশনের সিদ্ধান্তকে অমান্য করা। কমিশনের পরিবর্তে এমন চিঠি যদি মুখ্যসচিব তাঁর কোনও অধস্তন আধিকারিককে পাঠাতেন, আর তিনি যে ভাষায় উত্তর দিয়েছেন, সেই ভাষায় উত্তর পেতেন তাহলে কী হতো!’’ ফলে রাজ্যের মুখ্যসচিবের থেকে পাওয়া চিঠি হাতে আসায় নির্বাচন কমিশন কী নতুন পদক্ষেপ নিতে পারে সেদিকে তাকিয়ে আছে রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ মহলও। একাংশ আধিকারিকের মতে, এরপর নির্বাচন কমিশন মনে করলে অভিযুক্ত আধিকারিকদের বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিত ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি এফআইআর পর্যন্ত করার দিকে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে এরাজ্যে ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধন অভিযান শুরু হওয়ার আগে রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সঙ্ঘাত আদালত পর্যন্ত গড়াতে পারে।
নির্বাচন কমিশনকে লেখা চিঠিতে মুখ্যসচিব অভিযুক্ত আধিকারিকদের বিরুদ্ধে সরকারের অভ্যন্তরীণ তদন্তের কথা জানিয়েছেন। ফলে অভ্যন্তরীণ তদন্ত পর্যন্ত রাজ্য সরকার অপেক্ষা করে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে কমিশনকে লেখা হয়েছে। কিন্তু ঘটনা হলো, গত ৫ আগস্ট নির্বাচন কমিশনের তরফে রাজ্য সরকারকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, প্রাথমিক তদন্তে অভিযুক্ত আধিকারিকদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। তার ভিত্তিতে রাজ্যের আধিকারিক হলেও নির্বাচনের কাজে যুক্ত আধিকারিকরা বর্তমানে কমিশনের অধীনে। তাই ১৯৫০ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের ধারা উল্লেখ করে ভোটার তালিকায় ভুয়ো নাম তোলার অভিযোগে সরাসরি সাসপেন্ড করার সঙ্গে এফআইআর করার নির্দেশ এসেছিল। ফলে রাজ্যের অভ্যন্তরীণ তদন্তের এই সিদ্ধান্তকে নির্বাচন কমিশন কীভাবে গ্রহণ করবে সেটাই এখন দেখার।
নির্বাচন কমিশনের তরফে শাস্তির চিঠি আসার পর মুখ্যমন্ত্রী যেমন আধিকারিকদের পক্ষ নিয়েছিলেন, তেমনই ডব্লিউবিসিএস আধিকারিকদের সংগঠনের পক্ষ থেকেও রাজ্যের মুখ্যসচিবের কাছে চিঠি এসেছিল। নবান্ন সূত্রের খবর, এরাজ্যের ডব্লিউবিসিএস সংগঠনের নেতারা মুখ্যসচিবের সঙ্গে বৈঠকও করেন। সেই বৈঠকে তাঁরা অভিযুক্ত আধিকারিকদের শাস্তির বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কথা বলে বিবেচনার মধ্যে রাখার অনুরোধ করে।
মুখ্যসচিব চিঠিতে কমিশনকে আশ্বস্ত করে লিখেছেন, প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে ময়না বিধানসভা কেন্দ্রের এইআরও সুদীপ্ত দাস ও পূর্ব বারুইপুর বিধানসভা কেন্দ্রের ডেটা এন্ট্রি অপারেটর সুরজিৎ হালদারকে নির্বাচনী দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সরকারের তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষার কথা চিঠিতে জানিয়েছেন মুখ্যসচিব।
কিন্তু পূর্ব বারুইপুর কেন্দ্রের ইআরও (ইলেকশান রেজিস্ট্রেশন অফিসার) ২০১২ ব্যাচের ডব্লিউবিসিএস আধিকারিক বর্তমানে দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার গ্রামোন্নয়ন সেলের ডেপুটি প্রজেক্ট ডিরেক্টর পদে কর্মরত দেবত্তম দত্ত চৌধুরি। ওই একই কেন্দ্রের এইআরও তথাগত মণ্ডল জয়নগর ১ ব্লকের রেগা সেলের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রাম অফিসারের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণের কথা উল্লেখ করা হয়নি। ময়না বিধানসভা কেন্দ্রের ইআরও বিপ্লব সরকারের বিরুদ্ধে কোনও কথা নেই মুখ্যসচিবের পাঠানো ব্যবস্থা গ্রহণের রিপোর্টে।
ভোটার তালিকায় ‘ফর্ম ৬’-কে ব্যবহার করে ভুয়ো ভোটারদের নাম তোলার জন্য অভিযুক্ত আধিকারিকদের সাসপেন্ড করার পাশাপাশি, এফআইআর করার নির্দেশ ছিল কমিশনের। কেবলমাত্র ডেটা এন্ট্রি অপারেটরের কাজে নিযুক্ত অস্থায়ী কর্মচারীকে সাসপেন্ড করার কোনও প্রয়োজন নেই বলেই তাঁর বিরুদ্ধে সরাসরি এফআইআর করার কথা জানিয়েছিল কমিশন।
কমিশনের এই চিঠিকে কার্যত কোনও আমল না দিয়ে দলীয় সভায় মমতা ব্যানার্জির নির্দেশকে মান্যতা দিলো রাজ্য সরকার।
Comments :0