শমীক লাহিড়ী
আহা, লিওনেল মেসির এই সুবিখ্যাত কলকাতা সফর— সত্যিই এক অনবদ্য, অবিস্মরণীয় মহাকাব্য! তবে এই মহাকাব্য রচিত হলো সুযোগের সদ্ব্যবহারে নয়, বরং নিখুঁত উচ্ছৃঙ্খলতায়! কোটি টাকার এক আন্তর্জাতিক সুযোগকে কীভাবে দক্ষতার সাথে শূন্যে পরিণত করা যায়, তা এই রাজ্যের ক্ষমতাসীনেরা প্রমাণ করে দেখালেন। তাঁদের অসাধারণ ‘ব্যবস্থাপনা’ দক্ষতার কাছে আমাদের মাথা নত করতেই হয়— বিস্ময়ে, ক্ষোভে, ধিক্কারে!
আসুন, আমরা সকলে মিলে এই তথাকথিত ‘সম্মানীয়’ রাজ্য সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সংগঠক সংস্থাদের নির্লজ্জ, তুলনাহীন সাফল্যকে অভিবাদন জানাই। তাঁরা শুধু একটি খেলার আয়োজন করেননি; তাঁরা ভিআইপিদের সীমাহীন লোভ এবং প্রশাসনিক অদক্ষতার এক এমন নিখুঁত প্রদর্শনী মঞ্চস্থ করেছেন, যা ক্রীড়াজগতের প্রহসনের ইতিহাসে রক্তাক্ষরে লেখা থাকবে!
দর্শকদের অর্থে মন্ত্রীদের সেলফি
বছরের পর বছর ধরে আমরা গণতন্ত্রের পাঠে পড়েছি, সরকারের কাজ জনগণের সেবা করা। কিন্তু মেসি-সফরের দিন সব নিয়ম উলটে গেল, যেন ‘উলটো রথের মেলা’। স্পষ্ট বোঝা গেল, দর্শকরা এখানে এসেছিলেন মূলত মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী সহ অন্যান্য মন্ত্রীদের আত্মীয় এবং সাঙ্গোপাঙ্গদের সেলফি তোলার মহড়া দেখতে!
আশি হাজার ফুটবল প্রেমী, যাঁদের অনেকেই নিজেদের কষ্টার্জিত সঞ্চয় উজাড় করে, কেউ কেউ তো ঋণ করেও এসেছিলেন, ফুটবলের জাদুকরকে এক ঝলক দেখার জন্য। কিন্তু তাঁদের সেই হাজার হাজার টাকা ছিল আসলে নব্য ধনী কিছু মাফিয়া এবং রাজনৈতিক নেতাদের জন্য আয়োজিত এক বিশেষ সেলফি পার্টির প্রবেশমূল্য। তাঁরা মেসিকে দেখতে এই টাকা দেননি; বরং মন্ত্রী ও তাঁদের অনুচরদের ইনস্টাগ্রামে নিজেদের বাহারি মুখবদন পোস্ট করার রাজকীয় অধিকার কিনে দিয়েছেন।
সরকারের প্রকৃত ‘সাফল্য’ নিহিত ছিল — বিশৃঙ্খলতা আর অব্যবস্থাপনায় আচ্ছন্ন ফটো বুথের একজন মডেল হিসাবে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ফুটবলারকে ব্যবহার করতে পারায়। আর এই অসাধারণ প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়ার বিনিময়ে, টিকিট কেটে আসা সাধারণ দর্শককুল শুধু ক্ষমতার দম্ভে স্ফীত পশ্চাৎদেশের এক সুবিশাল তরঙ্গ দেখেই তৃপ্ত হতে বাধ্য হলেন।
চরম প্রহসন
শৃঙ্খলা? এই সরকারের কাছে তার মূল্য কী! নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল এক পরিহাসের বিষয়। যে পুলিশকে ভিড় নিয়ন্ত্রণ করতে বলা হয়েছিল, তাদের কাজ কি ভিআইপি সুরক্ষায় নিয়োজিত থাকা ছিল না? আর গ্যালারিতে বসা আশি হাজার মেসি ভক্তের দৃষ্টি যারা আড়াল করল— মুখ্যমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীদের আত্মীয়স্বজন এবং সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা কি পুলিশ আর ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির আছে? ঘাড়ে মাথা থাকবে তাহলে? তাই তারা ভিভিআইপি সেলফি শিকারিদের সুরক্ষা দিতেই ব্যস্ত ছিলেন, নিজেদের সরকারি কর্তব্যকে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে— যেমনটা তারা করে থাকেন সর্বত্রই।
আয়োজকদের বিশ্বাসযোগ্যতা যেমন তাসের ঘরের মতো দ্রুত ধসেছিল, তেমনই ভেঙে পড়েছিল ব্যারিকেড। প্রতারিত দর্শক অনিবার্যভাবে ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। একদল উচ্ছৃঙ্খল তখন সরকারের ফাঁপা প্রতিশ্রুতির মতোই স্টেডিয়ামের কাঠামোও ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়ে গেল।
টাকা ফেরতের গল্প, চিট ফান্ডের ছায়া
এরপরই এলো এই মহাকাব্যের গ্র্যান্ড ফিনালে— টাকা ফেরতের নাটকীয় প্রতিশ্রুতি! নিশ্চিন্ত থাকুন, চিট ফান্ডের টাকা ফেরতের মতো আপনার টিকিট মূল্যও পাবেন— তবে কবে, তা শুধু তিনিই জানেন! এর নাকি তদন্ত হবে! যাদের জন্য মেসিকে দর্শকরা দেখতে পেলেন না, তাদের বাঁচিয়ে কাউকে একটা বলির পাঁঠা বানানো হবে, ঠিক যেমন অভয়া কাণ্ডের সময়ে হয়েছিল। আচ্ছা একই ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি তো হায়দরাবাদ এবং মুম্বাইতেও মেসি সফরের ব্যবস্থা করেছিল। এই দু’জায়গাতেই তো চমৎকার অনুষ্ঠান হয়েছে। তাহলে ত্রুটি কার? শুধু ঐ ইভেন্ট ম্যানেজারের নাকি সরকারের?
পিসি-ভাইপোর বাড়ির সবারই তো সেলফি তোলার প্রদর্শনী দেখার মাশুল তো আপনাকেই দিতে হবে! ‘মেসি মেস’ নিছক একটি অনুষ্ঠান ছিল না; এটি ছিল একটি নিখুঁতভাবে সম্পাদিত রাজনৈতিক নাটক, যা দেখালো — হাজার হাজার টাকা খরচ করে টিকিট কেটে আসা দর্শকরা নয়, ব্যানার্জি পরিবার আর কয়েকজন মন্ত্রীর ব্যক্তিগত ছবি তোলাই সরকার এবং আয়োজকদের কাছে একমাত্র অগ্রাধিকার। অভিনন্দন, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, আপনারা হাজার হাজার ফুটবল ফ্যানকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন এবং গর্ব করার মতো একটি অনুষ্ঠানে সাফল্যের সাথে আন্তর্জাতিক কলঙ্ক লেপে দিতে পেরেছেন!
বিশ্ব মঞ্চে বাংলার কলঙ্ক
মেসি সফরের এই বিশৃঙ্খলা আন্তর্জাতিক বড় ক্রীড়া ইভেন্ট আয়োজনের ক্ষেত্রে কলকাতার সুনামের ওপর এক গভীর, স্থায়ী কালো ছায়া ফেলবেই। অব্যবস্থাপনা এবং রাজনৈতিক মাতব্বরিতে দৃশ্যমান ব্যর্থতা, বিশ্ব মঞ্চে এই শহরের ভবিষ্যতের বিশ্বাসযোগ্যতার ক্ষেত্রে বিরাট প্রশ্নচিহ্ন তুলে দিয়েছে নিঃসন্দেহে।
ভাঙচুর, ফ্যানদের ক্ষোভ, এবং চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে মন্ত্রী ও তাঁদের আত্মীয়দের সেলফি তোলার জন্য হুড়োহুড়ির দৃশ্য বিশ্বজুড়েই গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। কলকাতাকে আবেগপ্রবণ ফুটবলপ্রেমীদের কেন্দ্র হিসাবে নয়, বরং এমন একটি শহর হিসাবে চিহ্নিত করেছে যেখানে বিশৃঙ্খলাই পেশাদার ইভেন্ট ব্যবস্থাপনার মূল বৈশিষ্ট্য।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের নামী ক্রীড়াবিদ এবং তাদের ম্যানেজমেন্ট টিম এখন ভবিষ্যতে কলকাতায় উপস্থিতির জন্য বিশাল অঙ্কের গ্যারান্টি দাবি করবে বা সফর প্রত্যাখ্যানও করতে পারে। কোনও বড় ক্রীড়া ব্যক্তিত্বই সতর্কতার সাথে নিজেদের তৈরি ব্র্যান্ডকে উশৃঙ্খল মন্ত্রীদের হুড়োহুড়িতে কলঙ্কিত হতে দিতে চান না। ফিফা বা আন্তর্জাতিক ক্লাবগুলি অথবা প্রধান ক্রীড়া ফেডারেশনগুলি নিরাপত্তার ত্রুটি এবং প্রশাসনিক অদক্ষতার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কায় কলকাতাকে একটি উপযুক্ত স্থান হিসেবে পুনর্বিবেচনা করবে কী আর?
হারানো সুযোগ এবং আর্থিক মাশুল
‘মেসি মেস’ থেকে সৃষ্ট ক্ষতি কেবল সুনামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এর অর্থনৈতিক পরিণতিও রয়েছে। এই শহরকে এখন লাভজনক প্রদর্শনী ম্যাচ, আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট বা কনসার্ট আকর্ষণ করতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে। এর ফলে পর্যটন, হোটেল ব্যবসা এবং টিকিট বিক্রি থেকে আসা উল্লেখযোগ্য রাজস্ব হাতছাড়া হবে। ভবিষ্যতে কলকাতাকে বিবেচনা করার ক্ষেত্রে যে কোনও আন্তর্জাতিক সংস্থা এখন অতিরিক্ত নিরাপত্তা, বিমা এবং অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির জন্য বিশাল অঙ্কের অর্থ দাবি করতেই পারে, যার ফলে এখানে যে কোনও আন্তর্জাতিক ইভেন্ট করা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হবে।
যে শিক্ষা নেওয়া হয়নি
দিয়েগো মারাদোনার ২০০৮ সালের সফর অনেকের স্মৃতিতেই রয়েছে। ঐ অনুষ্ঠান দেখিয়েছিল, যে ব্যবস্থাপনা যখন দক্ষ ও পেশাদার হয়, এবং সরকার যদি দখলদারির ভুমিকা নেওয়ার পরিবর্তে সহায়কশক্তি রূপে কাজ করে, তাহলে কলকাতা যে কোনও বিশ্বতারকাকেই সফলভাবে বরণ করে নিতে সক্ষম।
মারাদোনার ভ্রমণসূচি ছিল শহর এবং মফস্বলের মধ্যে বোনা নিখুঁত পরিকল্পনা, যা শুধু সল্টলেক স্টেডিয়ামের বিশাল মঞ্চই নয়, মহেশতলা থেকে মোহনবাগান ক্লাবের মাঠ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তিনি মাদার টেরেসার বাড়ি এবং জ্যোতি বসুর বাড়িতেও গিয়েছিলেন। এই পাঁচটি ভিন্ন স্থানেই উৎসাহী, ভক্ত ফ্যানদের দল একত্রিত হয়েছিলেন — ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছিলেন ‘ফুটবলের রাজপুত্রকে’ এক ঝলক দেখতে।
২০১১ সালে কলকাতায় আয়োজিত ভারতের প্রথম ফিফা ফ্রেন্ডলি ম্যাচ, যেখানে মেসি, ডি’মারিয়া, আগুয়েরা সহ তারকাখচিত আর্জেন্টিনা দল ভেনেজুয়েলার মুখোমুখি হয়েছিল, তা বিশ্বমানের ক্রীড়া ইভেন্ট নিখুঁতভাবে সম্পাদনের ক্ষেত্রে বাংলার সক্ষমতার এক উজ্জ্বল প্রমাণ। এই অসাধারণ খেলা সরকারি আমলাতন্ত্রের নিয়মের বেড়াজাল বা মন্ত্রীদের আস্ফালনের মঞ্চে পরিণত হতে পারেনি, কারণ ফিফার আইন অনুযায়ী একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থাই ছিল মূল উদ্যোক্তা।
কিংবদন্তীদের অক্ষয় উত্তরাধিকার
সাম্প্রতিক বিশৃঙ্খল অধ্যায় শুরু হওয়ার বহু আগে থেকেই, পশ্চিমবঙ্গ বিশ্ব ফুটবলের মহাতারকাদের আতিথেয়তা দিয়েছে। বিগত চার দশক ধরে, কলকাতা শ্রদ্ধাভরে সাক্ষী হয়েছে ফুটবলের সর্বকালের সেরা কিছু নায়কের— পেলে, সক্রেটিস, অলিভার কান, রোনাল্ডো, রোমারিও, দিয়েগো ফোরল্যান সহ অনেক ফুটবল তারকা। সমগ্র বিশ্ব, বাংলার ফুটবল প্রেমীদের শৃঙ্খলা এবং আবেগের এক অসামান্য মেলবন্ধন প্রত্যক্ষ করেছিল এই সব অনুষ্ঠানে। লক্ষ জনতা ইভেন্ট জুড়ে সুশৃঙ্খল আচরণ এবং সম্মানের পরিবেশ বজায় রেখেছিল। এই সোনালী স্মৃতিগুলি, যা সুশৃঙ্খল উদ্দীপনায় পূর্ণ, সেটাই বাংলার ফুটবলের অক্ষয় উত্তরাধিকার নির্মাণ করেছে।
যখন লোভ জেতে, খেলা হারে
সাম্প্রতিক ব্যর্থতা দেখিয়েছে, যখন ব্যক্তিগত প্রচার এবং রাজনৈতিক মাতব্বরি, বিপুল অর্থ দিয়ে টিকিট কাটা উৎসাহীদের নিরাপত্তা এবং অভিজ্ঞতার চাইতে বেশি অগ্রাধিকার পায়, তখন বিপর্যয় নিশ্চিত।
যতক্ষণ না এই চূড়ান্ত বিপর্যয়ের কুশীলব অর্থাৎ সংগঠক সংস্থাগুলি এবং ভিভিআইপিদের সীমাহীন লোভকে খেলার প্রাঙ্গণ থেকে সম্পূর্ণরূপে বিতাড়িত করার গ্যারান্টি নিশ্চিত করা যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ‘মেসি মেস’-এর সেই দীর্ঘ ছায়া প্রলম্বিত হতেই থাকবে।
এটা স্পষ্ট, এর জন্য দোষী নন ফুটবল প্রেমীরা— তাঁরাই বাংলার ফুটবলের স্তম্ভ। সম্পূর্ণ দায়ভার বর্তায় ঐ লোভী মন্ত্রী এবং স্বার্থপর প্রশাসনের কাঁধে। এদের ক্ষণিকের সেলফির জন্য অদম্য লিপ্সা যে কোনও উচ্ছৃঙ্খলতার চেয়ে বেশি ক্ষতিকারক প্রমাণিত হয়েছে। তাঁদের অহমিকা এবং সুযোগসন্ধানী মনোভাব, বাংলার সুনামকে অপূরণীয়ভাবে কলঙ্কিত করেছে; এই ঘটনাটিকে রাজনৈতিক লোলুপতার এক লজ্জাজনক স্মৃতিস্তম্ভে পরিণত করেছে, যা শহরের ক্রীড়া ভবিষ্যতের বিরুদ্ধে আত্মঘাতী গোলের মালা পরিয়েছে।
Messi's Kolkata Trip
কলকাতা ‘গোট কেলেঙ্কারি’: যখন লোভের কাছে হার মানে খেলা
×
Comments :0