"হিস্ট্রি নয়, হিস্টিরিয়া তৈরি করা হচ্ছে।" এনসিইআরটি ইতিহাস নিয়ে অষ্টম শ্রেণির যে পাঠ্যপুস্তক তৈরি করেছে, তার বিষয়বস্তু নিয়ে প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে শুক্রবার এই কথা বলেছেন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিব। গণশক্তির সঙ্গে এদিন এই বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে প্রবীন ইতিহাসবিদ বলেছেন, যে সব রাজ্যে অ-বিজেপি, ধর্মনিরপেক্ষ দলের সরকার চলছে, তাদের উচিত ইতিহাসের এই বিকৃতি রোখা, ইতিহাসকে রক্ষা করা।
এনসিইআরটি’র এই সপ্তাহে প্রকাশিত ‘এক্সপ্লোরিং সোসাইটি’ : ইন্ডিয়া অ্যান্ড বিয়ন্ড’ নতুন পাঠক্রমের বই। অষ্টম শ্রেণির এই বইতে দিল্লির সুলতানি আমল, মুঘল আমল, মারাঠা এবং ঔপনিবেশিক যুগ সম্পর্কে জানানো হয়েছে। প্রাথমিকভাবে বইটির বেশ কিছু অংশ সামনে এসেছে। তাতে বলা হয়েছে, আকবরের শাসন ছিল ‘বর্বরতা এবং সহনশীলতার মিশ্রণ’। বাবর নির্মম বিজেতা। আওরঙ্গজেব সামরিক শাসক যিনি অমুসলিমদের উপর কর বসিয়ে ছিলেন, হিন্দু মন্দির ভেঙেছিলেন ইত্যাদি। এই বইতেই ২২ পাতা খরচ করা হয়েছে মারাঠা সাম্রাজ্য এবং শিবাজীকে মহিমান্বিত করার জন্য। শিবাজীর রণকৌশল সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলা হয়েছে, সামান্য কয়েকজন সৈন্য নিয়ে রাতের অন্ধকারে শিবাজী দুঃসাহসিক অভিযান চালাতেন। যা বর্তমান সময়ের ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’এর মতন! অন্যদিকে ‘রিশেপিং ইন্ডিয়া’স পলিটিক্যাল ম্যাপ’ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, বাবর মহিলাদের ক্রীতদাস বানাতেন। যে সব শহরে অভিযান চালাতেন সেখানে মাথার খুলির মিনার বানিয়ে ফেলতেন ইত্যাদি। আগে এসসিইআরটি’র ইতিহাসে সপ্তম শ্রেণিতে মুঘল আমল পড়ানো হতো। তা আগেই বাদ দেওয়া হয়েছে। তার বদলে এনসিইআরটি এখন তার বদলে মগধ সাম্রাজ্য, মৌর্য, শূঙ্গ, সাতবাহন সাম্রাজ্য সম্পর্কে পড়ায়।
এখন এনসিইআরটি অষ্ঠম শ্রেণিতে ‘এক্সপ্লোরিং সোসাইটি : ইন্ডিয়া অ্যান্ড বিয়ন্ড’ অধ্যায়ে ইতিহাসের কিছু অন্ধকার পর্বে মুঘল শাসকদের সম্পর্কে বলা হয়েছে। সেখানে তাদের ক্রুর, নিষ্ঠুর, নৃশংস হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা হয়েছে। এইসব বিষয়েই ইরফান হাবিব এদিন গণশক্তির সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি জানান, পাঠ্য বইটি এখনও দেখেননি, সংবাপত্রে পড়েছেন।
নতুন পাঠ্যপুস্তকে আকবরকেও ত্রুর, নির্মম হিসাবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছে। বলা হয়েছে চিতোরগড়ে আকবর ৩০ হাজার নাগরিককে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে ইরফান হাবিব বলেছেন, ইতিহাস নির্ভর করে সম্পূর্ণ তথ্যের উপর, ধর্মের উপরে নয়। চিতোরে গণহত্যা তো বহুচর্চিত বিষয়। কিন্তু তার সঙ্গে যদি আকবরের ধর্মীয় নীতি, যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, উচ্চপদে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে নিয়োগ ইত্যাদি বিষয়গুলির উল্লেখই করা না যায় তাহলে অন্য উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়। তিনি বলেন, শিবাজীর ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু শিবাজী আওরঙ্গজেবকে লেখা চিঠিতে আকবরের ধর্মীয় নীতির যে প্রশংসা করেছেন, সেটা বলা হচ্ছে না।
সিলেবাস থেকে একটা অংশকে মুছে ফেললেই অতীত বদলে ফেলা যায় না। নৃশংসতার প্রশ্নে ইরফান হাবিব বলেন, তখন তো কেউ সংবিধান মেনে শাসন করতেন না। সমস্ত শাসকই তরবারির জোরেই শাসন করতেন। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় রাজপুতরাও একইরকম নিষ্ঠুর ছিলেন। তাই একে ধর্মের আয়নায় দেখার কোনও প্রয়োজন নেই। যদি শাসকরা দক্ষ কৌশলবিদ বা তাদের শক্তিশালী সৈন্যদল না থাকতো, তাহলে কোনও রাজবংশই টিকতো না।
ইরফান হাবিব বলেন, ভারতের সমাজ কাঠামোয় জাত-ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ। এর আগে বলা হয়েছিল জাত ব্যবস্থা প্রাচীন ভারতে ছিলই না। তা ভারতে নাকি চালু হয়েছে মধ্যযুগে। মুসলিমদের হাত থেকে হিন্দুদের রক্ষা করতেই নাকি জাত ব্যবস্থার প্রবর্তন হয়েছিল! ইতিহাসের নামে এই ধরনের বিষয় চালু করা হচ্ছে। তিনি বলেন, এর আগেও ইতিহাসের নানারকম বিকৃতির চেষ্টা হয়েছে। তাজমহল নিয়েও হয়েছে। তাজমহল হিন্দু মন্দির, তেজোমহল ইত্যাদি একটা সময় খুব প্রচার করা হয়েছিল। অত্যন্ত উষ্মা প্রকাশ করে তিনি বলেন, এগুলি অশিক্ষিত, সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই করা হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে পড়ুয়াদের মাথায় এখন থেকেই যে মতাদর্শ প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা হচ্ছে। ইরফান হাবিব বলেন, দীর্ঘ চেষ্টা, পরিশ্রমের মাধ্যমে এনসিইআরটি’র খুবই ভালো পাঠ্যপুস্তক তৈরি করা গিয়েছিল। নয়া শিক্ষা নীতির নামে এই সরকার সবটাকেই বদলে দিতে চাইছে। যাতে এরা যা বলতে চায়, যে মতাদর্শ ছড়াতে চায় তার প্রচার করা যায়। তাই যতটা পরিশ্রম করা হয়েছিল, যে পাঠ্যক্রম তৈরি হয়েছিল সবই এই সরকার শেষ করে দিয়েছে। তার বদলে প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িক মতাদর্শের চাষ করা হচ্ছে শিশু মনে।
এই প্রসঙ্গে ইরফান হাবিবের মত, যে সব রাজ্যে বিজেপি’র সরকার নেই, তাদের অন্তত ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থাকে রক্ষা করা উচিত। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যেরও সেই কাজ করা উচিত। আর যদি কেন্দ্র সরকারকেই অনুসরণ করে, তাহলে শিশুদের ভবিষ্যৎ বিপদে পড়বে। তাই ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি যে সব রাজ্যে সরকার পরিচালনা করছে তাদের ইতিহাসের বিকৃতি রুখে যুক্তিবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থা বজায় রাখা প্রয়োজন।
Irfan Habib
“ইতিহাস সম্পূর্ণ নির্ভর করে তথ্যের উপর, ধর্মের উপরে নয়” যুক্তিবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থা রক্ষার আহ্বান ইরফান হাবিবের

×
Comments :0