গত সপ্তাহেই ওয়াশিংটনের হুকুম মেনে রাশিয়ার থেকে তেল কেনা বন্ধ করে, তার পরিবর্তে আমেরিকার থেকে জ্বালানি আমদানি করার প্রতিশ্রুতি দেয় নয়াদিল্লি। শুক্রবার মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আরও একটু খুশি করতে আমেরিকার সঙ্গে দশ বছরের বিশেষ প্রতিরক্ষা সমঝোতায় স্বাক্ষর করল মোদী সরকার। এদিনই মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং ও মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব পিট হেগসেথের মধ্যে এই সমঝোতা হয়েছে। আসন্ন বাণিজ্য চুক্তিতে আমদানি শুল্কে কিছু ‘রেহাই’ পেতেই মোদী সরকারের সমঝোতায় স্বাক্ষর করেছে, মনে করছেন বিশ্লেষকদের বড় অংশ।
মোদী সরকার যদিও অজুহাত দিচ্ছে, এই সমঝোতায় কোনও নতুনত্ব নেই। এটা ২০০৫-র ভারত-মার্কিন সামরিক সমঝোতার পুনর্নবীকরণ। তবে বিষয়টা মোটেই তা নয়। তথ্য আদান প্রদান, প্রতিরক্ষা সমাগ্রী কেনাবেচা সহ সামরিক পরিকাঠামো ব্যবহার নিয়ে একাধিক নতুন শর্ত ভারতের ওপর চাপিয়েছে আমেরিকা। বিশেষ করে ভারত সাগরে আমেরিকার সামরিক উপস্থিতিতে ভারতের প্রকাশ্য সমর্থন এবং নানা ধরনের পরিকাঠামোর জোগান সংক্রান্ত নতুন শর্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। সমঝোতার শর্ত অনুসারে আমেরিকার থেকে আরও বেশি করে ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র ও যন্ত্রাংশ কিনতে ভারতকে বাধ্য করা হবে। প্রসঙ্গত গত সেপ্টেম্বর মাসেই এক বিজ্ঞপ্তি জারি করে ১৮ রকম প্রতিরক্ষা সামগ্রীর আমদানিতে শুল্ক মকুব করেছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। এর মধ্যে রয়েছে মালবাহী বিমান, যুদ্ধবিমানের যন্ত্রাংশ, ড্রোন ব্যাটারি, সাবমেরিন ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র প্রমুখ। কেন্দ্র দাবি করে, প্রতিরক্ষা সামগ্রীর আমদানি ‘বাধা-মুক্ত’ করতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। তবে বিশ্লেষকদের দাবি, এর পিছনে আমেরিকার আর্থ-বাণিজ্যিক চাপ ও ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপই মূলত দায়ী।
উল্লেখযোগ্যভাবে মালয়েশিয়ায় এই সমঝোতা এমন এক সময়ে হচ্ছে, যখন দেশে দেশে গিয়ে ট্রাম্প ভারতকে নিয়ে নানা বিদ্রুপ করে চলেছেন। ভারতের সার্বভৌমত্বকে আক্রমণ করে প্রায় তিরিশ বার তিনি দাবি করেছেন, আমেরিকার চাপেই গত মে মাসের ভারত-পাক সংঘাত বন্ধ হয়েছে। তাঁর ‘বিশেষ বন্ধু’ প্রধানমন্ত্রী মোদীকে নিয়েও ব্যঙ্গ করতে তিনি থামেননি। বুধবার কোরিয়ায় গিয়ে তিনি একদিকে মোদীকে ‘বলিষ্ঠ নেতা’, অন্যদিকে পাকিস্তানের সেনা প্রধানকে ‘দুর্ধর্ষ যোদ্ধা’ বলে সম্বোধন করেছেন। অপারেশন সিঁদুরে ভারতের ‘সাত-আটটা ঝা চকচকে যুদ্ধবিমান’ হারিয়েছে বলেও তিনি দাবি করেছেন। তিনি দাবি করেন, যুদ্ধ বন্ধ করতে তিনি ভারতকে ২৫০ শতাংশ শুল্ক চাপানোর হুমকি দেন। তারই ভয়ে ভারত অপারেশন সিঁদুর থেকে সরে এসেছে। অবশ্য মোদী সরকার এ নিয়ে কোনও প্রত্যুত্তর না দিয়ে উলটে ট্রাম্পের তেলা মাথায় তেল দেওয়ার পথ অবলম্বন করাকেই বেশি সহজ বলে মনে করেছেন। মার্কিন কূটনৈতিক স্বার্থের কাছে নতিস্বীকার করলেই আর্থ-বাণিজ্যিক খাতে ট্রাম্প বোধহয় কিছুটা রেহাই দেবেন বলে মোদী সরকার মনে করছে।
২০০৫-এ দশ বছরের ভারত-মার্কিন সামরিক সমঝোতা স্বাক্ষর করা হয়। এতে যৌথ সামরিক মহড়া ও অস্ত্র লেনদেনের বিষয়ে কিছু শর্ত থাকে। ২০১৫ সালে এই কাঠামো প্রথমবারের জন্য পুনর্নবীকরণ করা হয়। এবছর তা দ্বিতীয়বার করা হলো। এর আগে ২০১২-এ ভারত ও আমেরিকার মধ্যে ‘ডিফেন্স টেকনোলজি অ্যান্ড ট্রেড ইনিশিয়েটিভ’ (ডিটিটিআই) স্বাক্ষর করা হয়। এর মাধ্যমে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে যৌথ প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, যৌথ উৎপাদন ও প্রযুক্তি হস্তান্তর আরও সহজ হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। তবে বাস্তবে এই চুক্তির মাধ্যমে এখনও পর্যন্ত কোনও প্রকৃত ‘যৌথ উন্নয়ন, উৎপাদন বা প্রযুক্তি হস্তান্তর’ ঘটেনি। উলটে এর ফলস্বরূপ জিএসওএমআই, এলইএমওএ, কমকাসা’র মতো নানা একতরফা চুক্তিতে ভারতকে স্বাক্ষর করতে হয়েছে। এর মাধ্যমে আমেরিকার চাপিয়ে দেওয়া শর্তের অধীনে ভারতকে তার প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত সার্বভৌমত্ব আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে।
২০০২-র জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফরমেশন (জিএসওএমআই) চুক্তি মেনে দুই দেশের মধ্যে সামরিক ও প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত তথ্য ভাগাভাগি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে বাস্তবে এই আদান প্রদান একতরফা থেকেছে— ভারত নিজের সংগ্রহ করা তথ্য শুধু দিয়েছে, বিনিময়ে কিছু পায়নি। ২০১৬-র ‘লজিস্টিক্স এক্সচেঞ্জ মেমোরান্ডাম’ (এলইএমওএ) চুক্তি অনুযায়ী, দুই দেশের সামরিক বাহিনীকে একে অপরের ঘাঁটি ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়া হয়। তবে এই চুক্তির ভিত্তিতেএ একতরফাভাবে ভারতের সামরিক ঘাঁটি মার্কিন সেনা ইচ্ছামতো ব্যবহার করার সুযোগ পেয়েছে, উলটোটা হয়নি। ২০১৮-র ‘কমিউনিকেশনস কম্প্যাটিবিলিটি অ্যান্ড সিকিউরিটি’ (কমকাসা) চুক্তি অনুযায়ী দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সামরিক অভিযানের ক্ষেত্রে যোগাযোগ ও তথ্য বিনিময় সহজ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। অর্থাৎ ভারত কোনও সামরিক অভিযান চালালে তার যাবতীয় তথ্য আমেরিকাকে দেওয়া বাধ্যতামূলক হয়ে যায়।
Indo US Defence Deal
শুল্কে রেহাই পেতে এবার ওয়াশিংটনের সঙ্গে নতুন প্রতিরক্ষা চুক্তি নয়াদিল্লির
×
Comments :0