এম এ বেবি
হুবেই প্রদেশে সফর
চীনে হুবেই (Hubei) প্রদেশে আমাদের সফর ছিল শিক্ষণীয়। বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, থ্রি গর্জেস ড্যাম (Three Gorges Dam), হুবেই প্রদেশের ইয়াংসি (Yangtze) নদীর উপর নির্মাণ করা হয়েছে। এই বাঁধ তৈরির উদ্দেশ্য ছিল— নিয়মিত বন্যা প্রতিরোধ করা, যা নদী তীরবর্তী বাসিন্দাদের বিপদে ফেলতো প্রতি বছরই। এছাড়াও বিপুল পরিমাণে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন, আধুনিক সেচ ব্যবস্থা তৈরি এবং অন্যান্য সুবিধা ছাড়াও নদী ধরে বড় জাহাজ চলাচলের সুবন্দোবস্ত করা।
বিশাল মালবাহী জাহাজ এবং যাত্রীবাহী জাহাজগুলির বাঁধ অতিক্রম করার বিস্ময়কর দৃশ্যটি এখানকার একটি অন্যতম আকর্ষণ, যা দেখতে বিশ্বের নানা দেশের পর্যটকদের আসেন। এই বাঁধকে সমগ্র বিশ্বজুড়েই একটি বিস্ময়কর নির্মাণ-প্রযুক্তি হিসাবেই গণ্য করা হয়। এই বাঁধটিতে একটি অসাধারণ শিপ লক (Ship Lock) এবং এসকেলেটর সিস্টেম রয়েছে, যা জলের স্তর বাড়িয়ে বাঁধের নিচ থেকে উপরের দিকে পাঁচটি স্তরের মাধ্যমে জাহাজগুলিকে তুলে নিয়ে যায়, যা পৃথিবীর কোথাও নেই।
এই বাঁধ নির্মাণের সময়ে একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ ছিল সেখানে বসবাসকারী প্রায় ১০ লক্ষ মানুষের পুনর্বাসন। পুনর্বাসন প্রক্রিয়া নিয়ে তাদের মধ্যে কোনও অভিযোগ দেখা যায় না। আমরা এই পুনর্বাসন দেওয়া গ্রামগুলির কয়েকটি পরিদর্শন করতে এবং স্থানীয়দের সাথে কথা বলতে পেরেছিলাম, যার থেকে আমদের এই অভিজ্ঞতা হয়েছে। এর পরে, আমরা উচ্চ-গতির ট্রেনে করে হুবেই-এর রাজধানী উহান (Wuhan)-এ যাই।
ঐতিহাসিক উহান
উহানের উচাং (Wuchang) জেলায়, সেন্ট্রাল পিজ্যান্ট মুভমেন্ট ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (Central Peasant Movement Training Institute) ঐতিহাসিক বিপ্লবী আন্দোলনের সাক্ষ্য বহন করে। এটিকে বেজিঙের চীনের কমিউনিস্ট পার্টির (CPC) জাদুঘরের সমতুল্য বিবেচনা করা যেতে পারে, যেটা চীনা কমিউনিস্ট পার্টির শতবর্ষ পালনের সময় তৈরি করা হয়েছিল। একমাত্র পার্থক্য হলো বেজিঙের জাদুঘরে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার করা হয়েছে, যা এখানে নেই। কিং (Qing) রাজবংশের একটি স্কুল ভবনে অবস্থিত উহান রেভোলিউশন মিউজিয়াম চীনের বিপ্লবী ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলিকে স্মরণ করে তৈরি করা হয়েছে।
কমিউনিস্ট পার্টি এবং কুওমিনতাং (Kuomintang)-এর মধ্যে সহযোগিতার সময়কালে, এই প্রতিষ্ঠানটি উভয় পক্ষের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যখন কমরেড মাও জে দঙ (Mao Zedong) চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কৃষক কমিটির সচিব ছিলেন। নতুন কর্মীদের প্রস্তুত করতে এবং কৃষক আন্দোলনকে উন্নত করতে যৌথভাবে প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা কর্মসূচি এই কেন্দ্র থেকেই পরিচালনা করা হয়েছিল।
কেন্দ্রটিতে কঠোর শৃঙ্খলা বজায় রাখা হতো, নিয়ম লঙ্ঘনের জন্য সাত ধরনের শাস্তি ছিল। পর্যায়ক্রমে ত্রুটির গুরুত্ব অনুযায়ী সতর্কীকরণ, তিরস্কার, রাইফেল হাতে একই স্থানে দাঁড়িয়ে থাকা, রবিবারের ছুটি বাতিল করা, বাধ্যতামূলক কায়িক শ্রম, বাধ্যতামূলক প্রহরী ডিউটি এবং অধ্যয়ন কর্মসূচি এবং সবশেষে পার্টি সদস্যপদ থেকে বহিষ্কার। এসবের মধ্যে দিয়ে বোঝা যায়, সেই বিপ্লবী উত্থানের দিনগুলিতে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচিগুলি কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং সুশৃঙ্খল ছিল। এই সময়েই মাও জে দঙ তাঁর বিখ্যাত থিসিস, 'হুনান প্রদেশের কৃষক আন্দোলন নিয়ে একটি তদন্তমূলক প্রতিবেদন' ('Report on an Investigation of the Peasant Movement in Hunan') লিখেছিলেন।
সেখান থেকে বেশি দূরে ছিল না মাও-এর বাসভবন, যেখানে তিনি কখনও পরিবারের সাথে, আবার কখনও একা থাকতেন। ১৯২৭ সালের ২৭ এপ্রিল থেকে ৯ মে পর্যন্ত, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ঐতিহাসিক পঞ্চম কংগ্রেসের কাছাকাছিই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই কংগ্রেসের মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে, ১২ এপ্রিল, জেনারেল চিয়াং কাইশেক (Chiang Kaishek) এবং তাঁর ন্যাশনাল (কাউন্টার)-রেভোলিউশনারি আর্মির নেতৃত্বে কুওমিনতাং-এর ডানপন্থী দল সাংহাই ম্যাসাকার (Shanghai Massacre) নামে পরিচিত সেই ঘটনায় প্রায় দশ হাজার পার্টিকর্মী ও সমর্থককে হত্যা করেছিল। এটি কুওমিনতাং-এর মধ্যে ডানপন্থী ও বামপন্থীদের মধ্যে বিভেদকে আরও গভীর করে তোলে। কুওমিনতাং-এর প্রতিবিপ্লবী নীতির বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টির পরবর্তী সংগ্রামগুলি, বিশেষ করে লং মার্চ-এর মতো ঘটনা, বিশ্বজুড়ে বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলির মধ্যে স্মরণীয় হয়ে রয়ে গেছে।
আমরা একটি রাষ্ট্র পরিচালিত অত্যাধুনিক অটোমোবাইল প্রদর্শনী কেন্দ্রও পরিদর্শন করেছিলাম। এম-হিরো ৯১৭ হলো একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বিলাসবহুল এসইউভি, যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার (AI) সহ অত্যন্ত উন্নত প্রযুক্তিগত ক্ষমতা এবং শ্রেষ্ঠত্বকে তুলে ধরেছে। এতে চারটি চাকায় নিজস্ব স্টিয়ারিং রয়েছে এবং এটি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দ্রুত গতি বাড়াতে পারে। বেজিঙের একটি ব্যস্ত জনবহুল রাস্তায় ড্রাইভারবিহীন গাড়িতে চড়ার আকর্ষণীয় অভিজ্ঞতাও মনে পড়ছে।
দারিদ্র্য দূরীকরণ
আমাদের সফরের শেষ পর্বে আমরা ঝেজিয়াং (Zhejiang) প্রদেশে আসি। সাংহাই এবং জিয়াংজি-র কাছে অবস্থিত ঝেজিয়াং, জ্যাক মা (Jack Ma)-এর মতো উদ্যোক্তা এবং ডিপসিক-এর (DeepSeek) মতো কোম্পানির জন্য বিখ্যাত। চীনের বর্তমান রাষ্ট্রপতি এবং সিপিসি’র সাধারণ সম্পাদক শি জিনপিং (Xi Jinping), ২০০২ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছর এখানেই প্রাদেশিক সচিব হিসাবে কাজ করেছিলেন। তিনি ক্ষমতায় থাকাকালীন, পার্টির মধ্যে আলোচনা এবং চূড়ান্তভাবে গ্রহণের জন্য সাধারণ সমৃদ্ধির (Common Prosperity) ধারণাটি প্রবর্তন করেন।
আমরা এমন বেশ কয়েকটি কেন্দ্র পরিদর্শন করেছি যা জনগণকে বিভিন্ন জনসেবা প্রদান করে। সেগুলোর মধ্যে শাংচেং (Shangcheng) জেলায় অবস্থিত একটি কেন্দ্র ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এখানে পার্টির পক্ষ থেকেই নানা পরিষেবা মানুষকে দেওয়া হয়। প্রতিবেশী পরিষেবা, সরকারি পরিষেবা এবং জনসেবা সবই দক্ষতার সাথে এবং সময়মতো দেওয়া হয়। পরিষেবাগুলি নেওয়ার পাশাপাশি, এখানকার আশপাশের লোকেরা আড্ডার জন্য এবং অবসর বিনোদনের জন্যও এই দপ্তরে আসতে পারে। কেন্দ্রটিতে চুল কাটা, সেলাই, ছাতা মেরামত থেকে শুরু করে গৃহস্থালী সরঞ্জাম ঠিক করা— এমন কোনও পরিষেবা নেই, যা সেখানে পাওয়া যায় না।
আমাদের প্রতিনিধিদল দারিদ্র নির্মূল কর্মসূচিগুলি সরাসরি দেখার সুযোগও পেয়েছিল, যা অত্যন্ত নিবিড়ভাবে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করা হয়। এখানকার অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির জন্য গ্রামগুলিকে পর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তরিত করা হয়েছে, যার ফলে কৃষক এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার প্রভূত উন্নতি সম্ভব হয়েছে। একইভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় সম্ভাবনার সাথে মিল রেখে বাস্তবায়িত হয়েছে। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, কেরলের সিপিআই(এম)-নেতৃত্বাধীন বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের সরকারও অনুরূপ গ্রামীণ পর্যটন উন্নয়ন প্রচেষ্টা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে, যদিও পরিস্থিতি এবং প্রেক্ষাপট ভিন্ন।
অর্থনৈতিক বৃদ্ধি
চীনের অর্থনীতি বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হিসাবে কাজ করছে। এই দীর্ঘস্থায়ী উন্নতির পিছনে একটি প্রধান কারণ হলো দেশটির স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নীতি। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হওয়ার বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে, চীনের প্রকৃত মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (GDP) ছিল ১১৪ লক্ষ কোটি ইউয়ান (১,১০৪ লক্ষ কোটি টাকা)। ২০২৫ সালে সেই অঙ্কটি বেড়ে হয়েছে ১৩৭.৩৬ লক্ষ কোটি ইউয়ান (১৬৯২.৬ লক্ষ কোটি টাকা)। সেখানে ভারতের প্রকৃত জিডিপি ২০২৫ সালে হতে পারে ১৮৭.৯৭ লক্ষ কোটি টাকা (আনুমানিক)। শস্য উৎপাদনে চীন বিশ্বে প্রথম স্থানে রয়েছে এবং উৎপাদন শিল্পেও চীন অগ্রণী ভূমিকায় রয়েছে, যা এটিকে 'বিশ্বের কারখানা' হিসাবে খ্যাতি এনে দিয়েছে।
চীনের বার্ষিক মাথাপিছু আয় হলো ২৬,৯২০ মার্কিন ডলার, যেখানে ভারতের মাথাপিছু আয় এর অর্ধেকেরও কম, প্রায় ১১,০০০ মার্কিন ডলার। চীনের অগ্রগতির আরেকটি চালিকাশক্তি হলো শিক্ষা, বিশেষত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার দান। আগে জার্মানিকে উদ্ভাবনের নেতা হিসাবে গণ্য করা হতো। কিন্তু বিশ্ব মেধাসম্পদ সংস্থা (WIPO) দ্বারা প্রকাশিত ১৩৯টি অর্থনীতির নতুন বিশ্ব ক্রমানুসার অনুযায়ী, জার্মানি আর বিশ্বের দশটি সবচেয়ে উদ্ভাবনী দেশের মধ্যে নেই। চীন এখন তার স্থান দখল করেছে এবং এই পরিবর্তন এখন সুপ্রতিষ্ঠিত।
২০২৩ সালে, চীনে ৫০ লক্ষ পেটেন্ট নথিভুক্ত ছিল, যা অন্য যে কোনও দেশের চেয়ে বেশি। পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় চীনের পেটেন্ট কার্যকলাপ ১৮.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। রাষ্ট্র-সমর্থিত গবেষণা ও উন্নয়নে (R&D) বিনিয়োগের কারণে চীন এখন সংখ্যার বিচারে বিশ্বের সবচেয়ে উদ্ভাবনী দেশগুলির মধ্যে অন্যতম দেশ হিসাবে বিবেচিত হয়।
চীনে বেসরকারি ক্ষেত্রগুলি সরকারি ক্ষেত্রের কঠোর নজরদারি এবং তত্ত্বাবধানে কাজ করে। বেসরকারি উদ্যোক্তাদের কাজ কেবল কর্মসংস্থান তৈরি করা এবং সরকারি কোষাগারে কর জমা দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকাও তাদের পালন করতে হয়। চীনের রাষ্ট্রপতি এবং কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক শি জিনপিং বারবার গুরুত্ব দেন যাতে এই পদ্ধতি সমাজতন্ত্রের প্রাথমিক পর্যায়ের নির্দিষ্ট পরিস্থিতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ থাকে। উল্লেখ্য, স্বাধীন মার্কসবাদী চিন্তাবিদ ডেভিড হার্ভে (David Harvey), যিনি একসময় চীনের বেশ কিছু নীতির কঠোর সমালোচক ছিলেন, তিনিও এই নতুন দিকনির্দেশের যথেষ্ট প্রশংসা করেছেন।
একটি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী দল হিসাবে, এখানকার পার্টি তিনটি প্রধান বিষয়কে অগ্রাধিকার দেয়। প্রথমত, এটি অঞ্চল এবং নাগরিকদের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমাতে সচেষ্ট। দ্বিতীয়ত, সরকার, পার্টি এবং সমাজে দুর্নীতি দৃঢ়ভাবে দমন করতে চায়। তৃতীয়ত, বাস্তুসংস্থানগত ভারসাম্য এবং পরিবেশ সুরক্ষায় খুবই গুরুত্ব দিচ্ছে। ঘোষণা করা হয়েছে, আগামী পঞ্চদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাতেও অসাম্য মোকাবিলার জন্য বিভিন্ন যে উদ্যোগগুলি চলছে, সেগুলিকে নতুন উদ্যম নিয়ে চালিয়ে যাওয়া হবে।
দুই-ধাপের কৌশলগত পরিকল্পনা
চীনের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিশতবার্ষিকীর যাত্রার অংশ হিসাবে, দুই-ধাপের কৌশলগত পরিকল্পনা তৈরি করেছে। প্রথম ধাপ, ২০২৫ থেকে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত, সমাজতান্ত্রিক আধুনিকীকরণ অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করবে রাষ্ট্র। দ্বিতীয় ধাপটি ২০৩৫ থেকে ২০৪৯ সাল পর্যন্ত— যা গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার শতবর্ষকে চিহ্নিত করবে। এই সময়ের মধ্যে চীন একটি মহান আধুনিক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হতে চায়। চূড়ান্তভাবে, লক্ষ্য হলো একটি সমৃদ্ধ, শক্তিশালী, গণতান্ত্রিক, সাংস্কৃতিকভাবে উন্নত, ছন্দবদ্ধ এবং সুন্দর চীন গড়ে তোলা।
চীনের কমিউনিস্ট পার্টি দুর্নীতি দমনের জন্য অত্যন্ত কঠোর সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আমরা যখন চীন সফর করি, তখন পার্টির আন্তর্জাতিক বিভাগের প্রধান দুর্নীতির অভিযোগে তদন্তাধীন ছিলেন এবং ফলস্বরূপ তাঁকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। আমরা ফিরে আসার পর জানতে পারি সে অভিযোগগুলি প্রমাণিত হয়েছে, যার ফলে তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সেন্ট্রাল কমিশন ফর ডিসিপ্লিন ইন্সপেকশন-এর হস্তক্ষেপের ফলে দুটি পার্টি কংগ্রেসের মধ্যে বিভিন্ন স্তরের ৭৪,০০০ পার্টিসদস্য দুর্নীতির জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। ২০১৫ সাল থেকে, ৪,৭০০ জন পার্টি কর্মকর্তার আত্মীয়দের দ্বারা পরিচালিত ব্যবসার বিরুদ্ধেও একই ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
কাজ, আচরণ ও শৃঙ্খলার উন্নতি
পার্টি এবং সরকার উভয়ের মধ্যে কাজ, আচরণ এবং শৃঙ্খলার উন্নতির জন্য পলিট ব্যুরো এবং কেন্দ্রীয় কমিটি আটটি প্রধান নির্দেশিকা জারি করেছে।
১) প্রকৃত পরিস্থিতি বুঝতে তৃণমূল স্তরে গভীর গবেষণা পরিচালনা করা। ২) সভাগুলি সুপরিকল্পিতভাবে এবং দক্ষতার সাথে সংগঠিত করা। ৩) সরকারি নথি এবং প্রতিবেদনগুলি সংক্ষেপে স্পষ্টভাবে লেখা। ৪) বিদেশে সফরের জন্য নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করা। ৫) নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা এবং জনসাধারণের সাথে মিশে যাওয়ার কাজ উন্নত করা। ৬) সংবাদ প্রতিবেদনের মান এবং উপস্থাপন উন্নত করা। ৭) নিবন্ধ প্রকাশের ক্ষেত্রে কঠোর নিয়মাবলী কার্যকর করা। ৮) পার্টি ও সরকারি কাজে সততা ও সরলতা বজায় রাখা, দুর্নীতি এবং অপচয় এড়িয়ে চলা।
চীনের কমিউনিস্ট পার্টি আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাপন এবং জনসমক্ষে মদ্যপানের বিরুদ্ধেও দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। অতীতে, প্রতিনিধিদলের জন্য আয়োজিত ভোজসভায় প্রায়শই বক্তৃতা এবং অনুষ্ঠানের অংশ হিসাবে ওয়াইন বা মদ পানীয় হিসাবে দেওয়ার ব্যবস্থা থাকত। এই প্রথাটি এখন সম্পূর্ণভাবে বাতিল করা হয়েছে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নীতি মদ্যপানের অভ্যাসকে কঠোরভাবে নিরুৎসাহিত করে, যা জনগণের বৃহত্তর অংশের মধ্যে পার্টি সম্পর্কে একটি অনুকূল ভাবমূর্তি তৈরি করেছে। চীনের কমরেডদের সাথে এই বিষয়ে আলোচনা করার সময়, তাঁরা উল্লেখ করেন যে ব্যাপক ভদকা আসক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও বিচ্ছিন্নতার ক্ষেত্রেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
নিউইয়র্কে রাষ্ট্রসঙ্ঘ আয়োজিত জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনে (United Nations Climate Summit) তাঁর অনলাইন ভাষণে রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় চীনের আন্তরিক ও সক্রিয় অংশগ্রহণের কথা আবারও উল্লেখ করেন। অন্যান্য অনেক জাতির তুলনায়, চীনে শহর ও গ্রামীণ পরিবেশ উন্নত বলেই মনে হয়েছে। সর্বত্র সবুজ গাছপালাপূর্ণ শহর এবং আবাসিক এলাকা আমাদের চোখে পড়েছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যবিধিও একটি মাপকাঠি নির্ধারণ করে বজায় রাখা হয়, সেটা স্পষ্ট। এখানকার শৃঙ্খলাবদ্ধ মানুষ সত্যিই অনুকরণীয় এবং রাস্তার আশপাশে একটিও বেওয়ারিশ কুকুর দেখতে পাইনি।
চীনে কঠোর পার্টি শিক্ষা কর্মসূচিও একটি অত্যন্ত শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতা ছিল। ২০৪৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ উদ্যাপনের সময় একটি শক্তিশালী এবং সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে উন্নত সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসাবে অগ্রগতি লাভের জন্য প্রযুক্তি, শিল্প, কৃষি, অবকাঠামোর (Infrastructure) উন্নয়ন এবং জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে চীন যে অগ্রগতি অর্জন করেছে, তা প্রত্যক্ষ করেছিলাম আমরা।
আমাদের প্রতিনিধিদলে ছিলেন কমরেড মহম্মদ সেলিম, জিতেন্দ্র চৌধুরি, আর অরুণ কুমার, কে হেমলতা এবং সিএস সুজাতা। আমরা সর্বত্র চমৎকার আতিথেয়তা পেয়েছি। এককথায়, এই আট দিনের সফর আমাদের প্রতিনিধিদলকে দুই দেশ, দুই দেশের মানুষ এবং দুই দেশের পার্টির মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে শক্তিশালী করতে নিঃসন্দেহে সাহায্য করেছে।
Comments :0