অরূপ সেন: নয়াদিল্লি
সমাজতন্ত্র এবং গণতন্ত্র দুটিরই মূল্য অপরিসীম। একটিকে ছাড়া অন্যটির মূল্য স্থির করা যায় না। তাই আজকের ভারতের প্রেক্ষাপটে, আমাদের উচিত শুধু সাম্যবাদের প্রচার করা নয়, পূর্ণ গণতন্ত্রের জন্যেও সওয়াল করা। সীতারাম ইয়েচুরির আদর্শকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে আমাদের সমাজতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের আদর্শকেও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে, বললেন ইরফান হাবিব। সোমবার নয়াদিল্লির হরকিষাণ সিং সুরজিত ভবনে প্রথম সীতারাম ইয়েচুরি স্মারক বক্তৃতা দেন প্রবীণ ইতিহাসবিদ। ‘জাতীয় আন্দোলনের বামপন্থীদের ভূমিকা ও তার উত্তরাধিকার’ বিষয়ে দীর্ঘ ৪০ মিনিট বক্তব্য রাখেন ইরফান হাবিব। সেখানে তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে কমিউনিস্টদের ভূমিকা উল্লেখ করেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে কমিউনিস্টদের ভূমিকার পর্যালোচনা করেন নিস্পৃহভাবে।
গত বছর ১২ সেপ্টেম্বর সিপিআই(এম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির জীবনাবসান হয়। তাঁর মৃত্যুর এক বছর পূর্তিতে গোটা দেশেই নানা স্মরণ অনুষ্ঠান হচ্ছে। এরমধ্যে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি নয়াদিল্লিতে কমরেড সীতারাম ইয়েচুরির স্মরণে স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করে। এদিনের অনুষ্ঠানে মঞ্চে ছিলেন সিপিআই(এম) সাধারণ সম্পাদক এম এ বেবি, প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ প্রভাত পট্টনায়েক, পলিট ব্যুরো সদস্য ইউ বাসুকি এবং পার্টির প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাত। প্রবীণ পার্টি নেতা বিমান বসু, বৃন্দা কারাত, সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরা ছাড়াও সীতারাম ইয়েচুরির স্ত্রী বিশিষ্ট সাংবাদিক সীমা চিস্তি, তাঁদের ছেলে উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন শর্মিলা ঠাকুর, প্রাক্তন উপাচার্য গোপীনাথ, প্রাক্তন তথ্য কমিশনার ওয়াজাহাত হবিবুল্লাহ, সাংবাদিক সিদ্ধার্থ বরদারাজন সহ নানা বিশিষ্ট জন। ছাত্র-ছাত্রীরা সহ তরুণদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। অনুষ্ঠানের তেমন প্রচার না হলেও সুরজিৎ ভবনের প্রেক্ষাগৃহ এদিন উপচে পড়ে ভিড়ে।
অনুষ্ঠানের শুরুতে এম এ বেবি বলেন, ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিব আমাদের দেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের একজন। যিনি তাঁর অল্পবয়সেই কমিউনিস্ট হয়েছিলেন। গোটা জীবন তিনি শ্রমিক শ্রেণি এবং মেহনতি মানুষের জন্য কাজ করেছেন। অর্থনীতিবিদ প্রভাত পট্টনায়েক বলেন, ইরফান হাবিব সারা জীবন অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে দৃঢ়তার সঙ্গে দাঁড়িয়েছেন। অনেকেই বলে থাকেন, বুদ্ধিজীবীদের রাজনীতিতে অংশ নেওয়া উচিত নয়। কিন্তু দুনিয়ার ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, বার্নাড শ, জ্যাঁ পল সাত্রেকে। আমাদের দেশে তেমনই ইরফান হাবিব। এদিন মঞ্চে ইরফান হাবিবকে বসে বলার জন্যেই বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। কিন্তু ৯৪ বছরের প্রবীণ ইতিহাসবিদ দাঁড়িয়েই টানা ৪০ মিনিট বক্তব্য রাখেন।
ইরফান হাবিব এদিন ভারতের জাতীয় আন্দোলনে কমিউনিস্টদের ভূমিকা নিয়েই মূলত বক্তব্য সীমাবদ্ধ রাখেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, কমিউনিস্টরা কীভাবে শুরু থেকেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের চরিত্র উন্মোচিত করেছিলেন। এরপরে তিনি বিশেষ করে ৩০-৪০ এর দশকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নানা বাঁকে মোড়ে কমিউনিস্টদের ভূমিকার পর্যালোচনা করেন। এই আলোচনা প্রসঙ্গেই তিনি জোরের সঙ্গে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময়ে কমিউনিস্টদের ভূমিকার পক্ষে সওয়াল করেন। ইরফান হাবিব বলেন, ভারতের সীমান্তে যখন ফ্যাসিস্ত জাপান উপস্থিত, তখন কংগ্রেসের ভারত ছাড়ো প্রস্তাব গ্রহণ সঠিক ছিল না। হিটলারের জার্মানি সোভিয়েত রাশিয়া আক্রমণ করার পরে এটাকে শুধুমাত্র দুই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির লড়াই বলে বর্ণনা করা ভুল। কংগ্রেসের মধ্যে জওহরলাল নেহরুও সেই সময়ে ভারত ছাড়ো প্রস্তাবের বিরোধী ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি বিশেষ পরিস্থিতিতে এই প্রস্তাবকে সমর্থন করেন। ইরফান হাবিব বলেন, ফ্যাসিবাদী শক্তিকে অন্য শক্তির সঙ্গে এক করে দেখা সঠিক নয়। সেই কারণেই কমিউনিস্ট পার্টি তখন ফ্যাসিবাদ মোকাবিলায় যে অবস্থান নিয়েছিল, তা সঠিক। ওই সময়ে পার্টি যে অবস্থান নিয়েছিল তার পক্ষে আমাদের দৃঢ়তার সঙ্গেই অবস্থান নিতে হবে বলে মতপ্রকাশ করেন তিনি। তবে স্বাধীনতা আন্দোলনে কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগ সম্পর্কে কমিউনিস্ট পার্টির মূল্যায়ন যথাযথ ছিল না বলে তিনি মতপ্রকাশ করেন। হাবিব বলেন, কংগ্রেস একটি জাতীয়তাবাদী দল এবং মুসলিম লিগ একটি সাম্প্রদায়িক দল, দুটিকে কখনও এক করে দেখা যায় না। কমরেড রজনী পাম দত্তর ‘ইন্ডিয়া টুডে’ বইয়ের উল্লেখ করে ইরফান হাবিব বলেন, সেখানে তিনি ১৯৪৫ সালে বলেছিলেন সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে ভারতকে ভাগ করা যাবে না।
ইরফান হাবিবের বক্তৃতার শেষে ধন্যবাদ জানিয়ে এম এ বেবি বলেন, প্রত্যাশিতভাবেই অধ্যাপক ইরফান হাবিবের বক্তব্য অনেক আলোচনার জন্ম দেবে। যা আমাদের অধ্যয়ন এবং আমাদের ভূমিকাকে সমালোচনামূলক এবং আত্মসমালোচনামূলকভাবে পর্যালোচনার সুযোগ করে দেবে। যদিও তিনি বলেছেন, তাঁর কথাগুলি নতুন নয়। তবুও এগুলি আমাদের ভবিষ্যতের চিন্তার গঠনে এবং চিন্তাকে উদ্দীপ্ত করার সংগ্রামে সাহায্য করবে।
Irfan Habib
সীতারাম ইয়েচুরি স্মারক বক্তৃতায় ইরফান হাবিব

×
মন্তব্যসমূহ :0