Post Editorial

রাজনীতির এসআইআর

উত্তর সম্পাদকীয়​

পলাশ দাশ

বহুল আলোচিত এসআইআর শুরু হয়েছে বাংলায়। বিধানসভা ভোটের ঠিক আগেই বিহারে স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন (SIR) হয়েছে। এবার ১২ টি ভোট মুখী রাজ্যে শুরু হয়েছে সেই বিতর্কিত প্রক্রিয়া। বিহারে নির্বাচনী লড়াইয়ে প্রধান ইস্যু এসআইআর’র দাপটে বে-রোজগারি, মূল্যবৃদ্ধি, শিক্ষা, চিকিৎসা, পরিযায়ী শ্রমিক ইত্যাদি জীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলো আড়ালে চলে গেছে। বিজেপি বলছে ঘুষপেটিয়া বাদ দিয়েছি, আর মহাগঠবন্ধন নির্বাচন কমিশনের তথ্য তুলে ধরে দেখাচ্ছে অনুপ্রবেশকারী নয়, বাদ গেছে কিছু মৃত, স্থানান্তরিত আর একাধিক বার থাকা নাম আর নথি দেখাতে না পারা দরিদ্র, অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া ভোটারদের একাংশ। বিতর্ক চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পরেও স্তিমিত হয়নি। প্রশ্ন উঠছে— এই প্রক্রিয়া আদৌ কি ভোটার তালিকা শুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে? এবং এর মূল লক্ষ্য— প্রতিটি যোগ্য ভোটারকে তালিকাভুক্ত করা ও অযোগ্যদের বাদ দেওয়া— তা কি বাস্তবে হয়েছে? বিতর্কের ধূসর মেঘ এখন বাংলার আকাশে।

কে কিভাবে দেখছে!
গত কয়েক মাস ধরে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর দল হুঙ্কার দিয়ে মিডিয়া মাতিয়ে রেখেছিলেন— “এসআইআর করতে দেবো না”। মিডিয়ার বাকি অর্ধেকে বিজেপি নেতারা বলছেন রোহিঙ্গাদের বাদ দেবোই। মারাত্মক প্রচারে সাধারণ মানুষ আশঙ্কিত, বিভ্রান্ত হয়েছেন, মনে দ্বিধা-সন্দেহ, ভয়, বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়েছে। বিজেপি বিহারেও অনুপ্রবেশের তত্ত্ব প্রচার করলেও, কমিশন প্রকাশিত তথ্যে অনুপ্রবেশকারীদের সন্ধান পাওয়া যায়নি। বিজেপি’র প্রচার থেকে স্পষ্ট তারা এসআইআর প্রক্রিয়াকে বিভাজনের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে চায়। তৃণমূল মৃত, স্থানান্তরিত, ভুয়ো সবার নাম ভোটার তালিকায় রাখতে মরিয়া, কারণ সেটাই তাদের লাইফ লাইন। তারা সরকারি আধিকারিক থেকে বিএলও-দের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে আর বিজেপির সঙ্গে বোঝাপড়া তো আছেই।  
বামপন্থীরা চায় স্বচ্ছ ও নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়নের জন্য মৃত, স্থানান্তরিত, ভুয়ো নাম বাদ দিতে, যা এতদিন কমিশনের বদান্যতায় থেকেছে। বামপন্থীরা এমন নাম বাদ দিতে যেমন সক্রিয়, তেমনই তারা লড়ছে প্রকৃত প্রতিটি ভোটারের অধিকার রক্ষার জন্য, যাতে তাদের নাগরিকত্বহীন করতে না পারে। সিপিআই(এম) সর্বত্র ভোটার অধিকার রক্ষায় সহায়তা ক্যাম্প করছে, বাড়ি বাড়ি যাচ্ছে সাধারণ মানুষকে সাহায্য করতে।  
ভোটার তালিকায় এনআরসি’র ছায়া
এসআইআর প্রক্রিয়ার অদ্ভুত নিয়মকানুন অতীতে কখনও দেখা যায়নি। অন্তর্ভুক্তি নয় এসআইআর’র লক্ষ্য যেন ভোটারকে নাগরিকত্বহীন করা। ভোটার তালিকার সংশোধন নয়, এর সঙ্গে সাদৃশ্য আছে এনআরসি’র। তাই ভীতি ছড়িয়েছে হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মের গরিব, প্রান্তিক মানুষের মধ্যে, এমনকি সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের মধ্যেও। বিজেপি বুঝছে শুধু মুসলমান নয়, ২০০২ সালে নাম না থাকা বা ডকুমেন্টস না থাকায় বাদ পড়বে বহু হিন্দু মানুষ। মনে রাখতে হবে আসামের এনআরসি’র ফলাফলের কথা। ১৯ লক্ষ চিহ্নিত নাগরিকত্বহীনের মধ্যে ১২ লক্ষই হিন্দু। পশ্চিমবঙ্গে আরও সাংঘাতিক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। বিজেপি নিজের পিঠ বাঁচাতে চরম মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে সিএএ ক্যাম্প খুলে বলছে, সিএএ-তে আবেদন করলেই নাকি ভোটার লিস্টে নাম উঠবে। অথচ নির্বাচন কমিশন এমন কোনও নিয়ম করেনি। তাই কমিশনের কাছে বামপন্থীদের স্পষ্ট দাবি, এসআইআর নিয়ে যারা মানুষকে  প্রতারিত করছে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। বিজেপি’র সৃষ্টি করা সঙ্কট থেকে পরিত্রাণের রাস্তা একটাই— অধিকার রক্ষার সংগ্রাম।  

মেওয়া না বুড়ো আঙুল!
যাঁরা ভাবছেন সাংঘাতিক কিছু মিলবে এসআইআর থেকে, তাঁদের স্মরণ করাই নোটবন্দির কথা। মানুষ পেয়েছেন প্রতিশ্রুতি ও হেনস্তা। এসআইআর কি দিয়েছে, চলুন বিহার থেকে জানি! 
বিহারে ৭.৮৯ কোটি ভোটার ছিল, এসআইআর’র পরে তা কমে হয়েছে ৭.২৪ কোটি। বাদ ৬৫ লক্ষ ভোটার। বাদ পড়ল কারা? ২২ লক্ষ মৃত, ৩৫ লক্ষ স্থায়ী স্থানান্তরিত, ৭ লক্ষ একাধিক স্থানে থাকা ভোটার বাদের তালিকায় পড়েছে; আর ১.২ লক্ষ ফর্ম খতিয়ে দেখছে বলে নির্বাচন কমিশন জানায়। তাহলে অনুপ্রবেশকারী, ঘুষপেটিয়া, রোহিঙ্গারা কোথায় গেল? সেই সংক্রান্ত কোনও তথ্য কমিশনের কাছে নেই বলে জানানো হলো। চূড়ান্ত ভোটার তালিকায় ৩.৬৬ লক্ষ ভোটারকে বাদ দেওয়া হয়, এবং ২১.৫৩ লক্ষ নতুন ভোটারকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যার মধ্যে ১৪ লক্ষ প্রথমবারের ভোটার। চূড়ান্ত তালিকায় ৭.৪২ কোটি ভোটার রয়েছে— অর্থাৎ  ৪৭ লক্ষ ভোটার কমেছে। এই ৩.৬৬ লক্ষ আবেদন বাতিল হলো কেন, তা কেউ জানতে পারলো না। এমন কি গোপন কারণ আছে যার জন্য তা প্রকাশ করা হলো না? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চলুন যাই সুপ্রিম কোর্টের অলিন্দে।
আদালতে এসআইআর
সুপ্রিম কোর্টে বিহারের এসআইআর প্রক্রিয়াকে চ্যালেঞ্জ করে একাধিক মামলা হয়। আদালত এসআইআর স্থগিত না করলেও, কয়েকটি  অন্তর্বর্তী আদেশ দেয়। আদালত নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দেয় যে ৬৫ লক্ষ বাদ পড়া ভোটারের নাম এবং বাদের কারণ প্রকাশ করতে হবে, আধার ও EPIC (ভোটার আইডি কার্ড)-কেও ১১টি নথির তালিকার পাশাপাশি রাখতে হবে। আদালতে কমিশন ভোটার কার্ড জাল হওয়ার সম্ভাবনার কথা ও আধার কোনও নাগরিকত্বের প্রমাণ বহন করে না— এমন যুক্তি হাজির করে। কমিশন যুক্তি দেয় যে, আইন অনুসারে তারা বাদ পড়া ভোটারদের তালিকা প্রকাশ করতে বা কারণ জানাতে বাধ্য নয়। পরে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মতো কমিশন, আধারকে গ্রহণ করলেও তাকে নিছকই পরিচয় পত্র হিসাবেই রাখে। ১১ টি মূল নথির ৫টি নথিতে কিন্তু জন্ম তারিখ ও জন্মস্থানের উল্লেখ নেই অর্থাৎ নাগরিকত্ব প্রমাণ করে না, কিন্তু তবু তারা আধারকে মান্যতা দেয়নি। নির্বাচন কমিশনের কাজে স্বচ্ছতার অভাব দেখা যাচ্ছে যেমন, তেমনই রাজনৈতিক প্রভাব স্পষ্ট হচ্ছে। তার নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হলে গণতন্ত্র বিপন্ন হবে। যতটুকু মানুষ জানতে পারছেন তা আদালতের নির্দেশের ফলেই। বিহারের চূড়ান্ত ভোটার তালিকায় প্রচুর অসঙ্গতি মেলায় সেই সন্দেহ গাঢ় হয়েছে। কি সেই অসঙ্গতি! 
অসঙ্গতির এসআইআর
‘রিপোর্টারস কালেকটিভ’ বিহার এসআইআর বিশ্লেষণ করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে তারা বলছে - বিহারে ভোটার তালিকায় সম্ভাব্য ১৪.৩৫ লক্ষ ভোটারের নাম একাধিক স্থানে আছে। ১.৩২ কোটি ভোটারের ঠিকানা সন্দেহজনক। বাল্মীকিনগর বিধানসভা কেন্দ্রে ৫০০০ ভোটারের নাম রয়েছে, যাদের নাম উত্তর প্রদেশের এক বিধানসভা কেন্দ্রেও নথিবদ্ধ রয়েছে। বিহারের তিনটি বিধানসভা কেন্দ্রে (পিপড়া, বাগহা ও মোতিহারি) ৮০,০০০ ভোটার ভুয়ো ঠিকানায় নথিভুক্ত। 
সমাজ গবেষক যোগেন্দ্র যাদব দেশের সর্বোচ্চ আদালতে বিহারের চূড়ান্ত ভোটার লিস্টের নানা অসঙ্গতি তুলে ধরেছেন। তাঁর উপস্থাপনা অনুযায়ী, বিহারে ভূতুড়ে ভোটারের তালিকা তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে বিহারে নথিভুক্ত ভোটার নয় এমন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের সংখ্যা ছিল ২৭ লাখ যা এসআইআর’র পর বেড়ে হলো ৮১ লাখ। এই না মেলা ভোটারদের মধ্যে মহিলাদের সংখ্যা জানুয়ারি (২০২৫) মাসে ছিল ৭ লাখ, এসআইআর’র পর তা বেড়ে হলো ১৬ লাখ।  ভোটারের পরিচিতি ভুল, এমন সংখ্যা যোগেন্দ্র যাদবের হিসাব অনুসারে ৫,১৭,২১৬। নতুন অন্তর্ভুক্তিতেও আছে বহু অসঙ্গতি। 
বিশিষ্ট আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ আদালতে লিখিতভাবে জানিয়েছেন যে, বিহারের প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যা আনুমানিক ৮.২২ কোটি, কিন্তু চূড়ান্ত ভোটার তালিকায় রয়েছে ৭.৪২ কোটি ভোটার। প্রায় ৮০ লক্ষ মানুষ, অর্থাৎ রাজ্যের মোট প্রাপ্তবয়স্কদের প্রায় ১০ শতাংশ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন এসআইআর’র ফলে। সেপ্টেম্বর ২০২৫-এ বিহারের নারী-পুরুষ অনুপাত হাজার পিছু ৯৩৪ হলেও চূড়ান্ত ভোটার তালিকায় তা নেমে এসেছে ৮৯২-এ। অর্থাৎ প্রায় ১৭ লক্ষ মহিলা ভোটার ‘নিখোঁজ’। মুসলিম ভোটারদেরও বৈষম্যমূলকভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে। তাঁর দাবি, ‘নেম-রেকগনিশন সফটওয়্যার’-এর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, খসড়া তালিকার ৬৫ লক্ষ বাদ পড়া ভোটারের মধ্যে ২৫ শতাংশ মুসলিম, আর চূড়ান্ত তালিকার ৩.৬৬ লক্ষ বাদ দেওয়া ভোটারের মধ্যে ৩৪ শতাংশ মুসলিম। এই অনুপাতগত ফারাকের ফলে প্রায় ৬ লক্ষ মুসলিম ভোটার ভোটাধিকার হারিয়েছেন।
বিহারের মডেল এবার বাংলায়। তৃণমূল-বিজেপি বোঝাপড়া, সঙ্গে আইপ্যাক— জমজমাট খেলা হবে। যারা দারুণ উত্তেজিত রোহিঙ্গা বাদ যাবে বলে তাঁরা যদি একটু পাড়া প্রতিবেশীদের ঘরে ঘরে খোঁজ নেন তাহলে দেখবেন— গরিব, প্রান্তিক, পিছিয়ে থাকা মানুষের মনে আশঙ্কার মেঘ। ২০০২ সালে ভোটার তালিকায় নাম খুঁজে পাচ্ছেন না বহু মানুষ, বিবাহিতা মহিলাদের আরও বেশি সমস্যা। ২০০২ সালে নাম নেই এবং ১১ রকমের নথির একটিও নেই এমন বহু মানুষ আপনার চারদিকে আছেন, তাঁদের সিংহভাগই ধর্মে হিন্দু। বিহারের মতোই বা তার চেয়েও বেশি মৃত, ভূতুড়ে, একই নামের পুনরাবৃত্তি বাংলার চূড়ান্ত ভোটার তালিকায় রাখার চেষ্টা হবে, আর প্রকৃত বহু ভোটার নিশ্চিহ্ন হবেন। এইসব অসঙ্গতি আর বিভাজনের মেরুকরণ তৈরিতে অনুঘটকের কাজ করবে এসআইআর।  
গোপন বোঝাপড়া 
মাস খানেক আগে বুথ পুনর্বিন্যাস নিয়ে নির্বাচন কমিশন সর্বদলীয় সভা করে। সেই সভায় তৃণমূল ও বিজেপি’র প্রথম সারির নেতাদের মধ্যে তুমুল ঝগড়া হয় এসআইআর নিয়ে। তৃণমূল নেতারা হুঙ্কার দেন, বাংলায় তাঁরা এসআইআর করতে দেবেন না। বিজেপি নেতারা বলেন এসআইআর হবেই। অথচ সেই সভার বিষয় এসআইআর ছিলই না। আশ্চর্য ব্যাপার, গত ২৮ নভেম্বর এসআইআর অ্যা জেন্ডায় নির্বাচন কমিশনের সর্বদলীয় সভায় তৃণমূল নেতাদের ভূমিকা ছিল কমিশনের বাধ্য ছাত্রের মতো। সেদিন এসআইআর প্রক্রিয়ার নানা অসঙ্গতি নিয়ে বাম ও কংগ্রেসের প্রতিনিধিদের অকাট্য সব যুক্তি ও প্রশ্নে জর্জরিত হয় নির্বাচন কমিশন ও তার সঙ্গী বিজেপি। সভা জোরালো তর্কবিতর্কে উত্তপ্ত হলে, তৃণমূল নেতাদের দেখা যায়, কমিশনের উপস্থাপনা বাধাপ্রাপ্ত যাতে না হয় তার জন্য সকলকে অনুরোধ করতে। এ যেন ভূতের মুখে রাম নাম। এতদিন মুখ্যমন্ত্রী সহ তৃণমূল নেতারা এসআইআর করতে দেবেন না বলে বাজার গরম করলেন, বিতর্ক করলেন বিজেপি’র সঙ্গে, এমনকি বিএলএ-১ নিয়োগ করলেন না, আজ তারাই নির্বাচন কমিশনের কোল বিজেপি’র সঙ্গে ভাগাভাগি করলেন এবং বিএলএ- ১ ও ২  নিয়োগ করবেন জানালেন। গত কয়েকমাস ধরে এসআইআর তরজা চালিয়ে সমাজে হিন্দু-মুসলমান, ঘটি-বাঙাল ইত্যাদি নানা বিভাজন, বিদ্বেষ ও ভীতি-আশঙ্কার পরিবেশ সৃষ্টি করেছে তৃণমূল ও বিজেপি এবং ভোট পর্যন্ত এই তরজা তারা প্রকাশ্যে  চালাবে। অথচ পর্দার আড়ালে বোঝাপড়া সেরে এসআইআর-এ শামিল তৃণমূলও।  
সেটিংয়ের সূত্র
বিহারে ২০২০ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এনডিএ জোট পায় ১২৫টি আসন এবং রাষ্ট্রীয় জনতা দল, জাতীয় কংগ্রেস, বাম দলগুলোর জোট মহাগঠবন্ধন পায় ১১০টি আসন। এবারে চূড়ান্ত ভোটার তালিকায় দেখা যাচ্ছে এনডিএ জোটের আসনগুলোতে গড়ে ভোটার বাদ পড়ার সংখ্যা ১৩৪০ কিন্তু মহাগঠবন্ধনের আসনে গড়ে ভোটার বাদ পড়ার সংখ্যা ১৫৪৮। আসন পিছু মুসলিমদের বাদ পড়ার সংখ্যা এনডিএ জোটের আসনগুলিতে ২২৪ (১৬.৭%) অথচ মহাগঠবন্ধনের আসনে তা গড়ে ৪১২ (২৭.২%)। আবার যদি অঞ্চল ভেদে হিসাব করা যায়, যেমন সীমাঞ্চল (আসন সংখ্যা ২৪) যা কংগ্রেস ও আরজেডি’র গড় হিসাবে চিহ্নিত, সেখানে আসন পিছু বিয়োজন গড়ে ২,৭৩৫ এবং মুসলিমদের ক্ষেত্রে গড়ে ১,৩৮৮। অথচ বিজেপি’র শক্তিশালী ক্ষেত্র মগধ অঞ্চলে (৪৪টি আসন) আসন পিছু গড় বিয়োজন ১১৭৬ এবং মুসলিমদের ক্ষেত্রে গড়ে মাত্র ১৭৯। বিজেপি’র আরেক ঘাঁটি ত্রিহুত অঞ্চল (৫৩টি আসন) সংখ্যাটা যথাক্রমে ১২২১ এবং ২২৮। আবার গতবারে দলভিত্তিক জেতা আসনের যদি বিচার করা যায় তবে দেখা যাবে, রাষ্ট্রীয় জনতা দল (জেতা আসন ৭৫)-এর আসনগুলোতে গড় বিয়োজন ১৬৪৩, জাতীয় কংগ্রেস (জেতা আসন ১৯)-এর আসনগুলোতে গড় বিয়োজন ১৭২৭, যা সবচেয়ে বেশি। এনডিএ জোটের বড় শরিক বিজেপি (জেতা আসন ৭৪)-এর গড় বিয়োজন মাত্র ১২৮৯, নীতীশ কুমারের জনতা দল ইউনাইটেড (জেতা আসন ৪৩)-এর ক্ষেত্রে গড় বিয়োজন মাত্র ১৩৫৩। এর থেকে স্পষ্ট হচ্ছে এসআইআর-এ ভোটার বাদ পড়ার এক বিশেষ ধরণ বা চিত্র। তৃণমূল এসআইআর মেনে নিল কি এই সূত্র ধরেই, সময় তা প্রকাশ করবে।    
এনআরসি না এসআইআর!
বিহারে এসআইআর নামক বিভাজনের অস্ত্র বিজেপি’র ভোটকে সংহত করতে সাহায্য করেছে, বিপরীতে মহাগঠবন্ধন সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছে অসংখ্য মানুষ অধিকারের প্রশ্নে, বিভাজনের বিরুদ্ধে। এ রাজ্যে বিজেপি ও তৃণমূল এসআইআর-কে তাদের বাসনা মেটাতেই ব্যবহার করবে। আশঙ্কার প্রহর গুনবে শুধু উলুখাগড়া উদ্বাস্তু, মতুয়া, আদিবাসী, তফসিলি জাতি-উপজাতি, রাজবংশী, মুসলমান, মহিলা, তৃতীয় লিঙ্গের প্রান্তিক মানুষ। ধর্ম-জাতি নির্বিশেষে এইসব মানুষকে বিপদে ফেলেছে বিজেপি। তৃণমূলও বিভাজনের মুদ্রার উলটো পিঠের দখল নিতে তৎপর। বিপন্ন মানুষ খুঁজছে কাগজ আর অন্যদিকে বিজেপি হিন্দু ভোট আর তৃণমূল ছাপ্পা ভোট ও সংখ্যালঘু ভোট। নির্বিকল্প কমিশন তার সার্বজনীন ভোটাধিকারের অন্তর্ভুক্তি মূলক ভূমিকা থেকে সরে এসে, ভোটারের ঘাড়ে নাগরিকত্ব প্রমানের ফর্ম পূরণের দায় চাপিয়ে দিয়েছে। সঙ্গে যুক্ত করেছে নথি - নাগরিকত্ব আইনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে শুধু নিজের নয়, বাবা ও মায়েরও। প্রশ্ন, এটা ভোটার তালিকার সংশোধন না এনআরসি! নাগরিকত্ব নির্ধারনের দায়িত্ব কে দিয়েছে কমিশনকে? সংবিধান তো দেয়নি।
অধিকার রক্ষার লড়াই
এখন সময় সাহসে ভর করে সাহস জোগানোর, মানুষের পাশে সব শক্তি, উদ্যম নিয়ে দাঁড়ানোর। অসহায় মানুষের অধিকার রক্ষায় সহায়তা যেমন দরকার তেমনই বামপন্থীদের সামনে আছে লড়াইয়ের প্রশস্ত ময়দান। স্বচ্ছ, নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন, প্রকৃত ভোটারের অধিকার রক্ষা এবং বিপদাপন্ন মানুষের সঙ্গে প্রতারণার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বামপন্থীদেরই উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে। অসংখ্য নতুন মানুষকে এই লড়াইয়ে সাথি করতে হবে। দুর্বার লড়াই সরিয়ে দেবে চক্রান্তের মেঘ, ঐক্য গড়ে উঠবে গরিবের। গণতন্ত্র, অধিকার, জীবন-জীবিকার অন্তহীন সমস্যা নিরসনের সংগ্রামের উন্মেষে সিংহাসন টলবে শাসকের।

Comments :0

Login to leave a comment