চন্দন দাস ও রণদীপ মিত্র: পাঁচামী
খনির কাজ শুরু হয়েছে চাঁদায়। আপনারা কী করবেন? জমি দেবেন?
ধানী হেমব্রমকে প্রশ্ন করা হলো।
বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে পশ্চিমে। আদিবাসী গ্রাম, সংখ্যালঘুদের ঘর আর পাথর খাদান, ক্রাশারের দুনিয়ায় ক্লান্তি নামছে। ধানী হেমব্রম, সিপিআই(এম)’র পঞ্চায়েত সদস্যা, ফিরছিলেন মাঠ থেকে। দাদা, বৌদি আর তাঁকে নিয়ে সংসার। নিজেদের সামান্য জমি। বর্ষা এসেছে। হাটগাছার মতো পাঁচামীর গ্রামগুলির মাটি ঢেকে আছে জলে।
ধানী হেমব্রমের জমি আজ অস্তিত্বের সঙ্কটের মুখোমুখি। ধানী তাই রুক্ষ্ম। প্রশ্নটি শেষ হওয়ার পর সময় নিলেন না। পড়ন্ত বিকালে তাঁর কথায় মধ্যাহ্নের রোদের তেজ। বললেন, ‘‘কাজ তো শুরু করেছে দশ কিলোমিটার দূরে, ওই চাঁদায়। হচ্ছে তো পাথর তোলার কাজ। তাও এখনও ওঠেনি। কয়লা কোথায়? সেখানে তো বেশি জমি ছিল জঙ্গলে। আমাদের গ্রামের জমির দিকে আসুক। তখন দেখবেন কী হয়।’’
কী হবে? কী করবেন আপনারা? জমি দেবেন?
ধানী বললেন,‘‘গ্রামের লোকের সঙ্গে কথা বলুন না। দেখুন কী বলছে। আমাদের তো সরকার কিছু জিজ্ঞাসা করেনি। আমাদের মত নিয়েছে? নেয়নি।’’ এই বলে থামলেন। তারপর তৃণমূল আর বিজেপি-কে পঞ্চায়েত নির্বাচনে হারিয়ে জেতা সিপিআই(এম) প্রার্থী বললেন,‘‘জমি আমরা দেবো না। আমার জমি, আমাদের জমি। কেন দেবো? বংশের পর বংশ এখানে আমরা থাকছি। আছি। চাষ করছি। সেই জমি খনির জন্য আমরা দেবো না।’’
ধানীর একার কথা নয় এটি। ধানীর সংসদে প্রায় দেড় হাজার মানুষের বাস। গোটা গ্রাম একজোট। ধানীর সঙ্গে কথা বলার সময় জড়ো হয়েছেন আরও মানুষ। তাঁরাও ঘাড় নাড়ছেন, সায় দিচ্ছেন—‘বাপ ঠাকুর্দার জমি দেবো না।’
মূলত চার ধরনের মানুষ আছেন—আদিবাসী, সংখ্যালঘু মুসলমান, তফসিলি জাতি এবং সাধারণ (জেনারেল কাস্ট)। তবে সবাই মূলত শ্রমজীবী। এলাকায় খেতমজুর কম। রেজাউল মোমিনের কথায়,‘‘আদিবাসীরা জমির মালিক। তাঁদের অল্প আছে জমি, কিন্তু বেশিরভাগের আছে। মুসলমানদের মধ্যে সামান্য অংশের জমি আছে। যেমন আমার অল্প জমি আছে। কিন্তু বেশিরভাগ মুসলমান লেবার। তাঁরা ক্রাশারে, খাদানে কাজ করেন। কেউ ড্রিল চালান, কেউ ট্রাক ড্রাইভার। কেউ আবার খাদানে অন্য কাজ করেন। দৈনিক মজুরি পান তাঁরা। জমি যদি সরকার জোর করে নিয়ে নেয়, তাহলে আদিবাসীদের জমি যাবে, ঘর যাবে। গরিব মুসলমানদের ঘর যাবে। কাজ পাবে সব্বাই এমন গ্যারান্টি নেই। ফলে আদিবাসীদের বেশিরভাগ যেমন জমি দেওয়ার বিরুদ্ধে এখনও, মুসলমানদেরও অনেকে জমি দেওয়ার বিরুদ্ধে।’’
রেজাউল মোমিনও পঞ্চায়েতের সদস্য। সিপিআই(এম)’র প্রতীকে জিতেছেন ২০২৩-এর নির্বাচনে। পাঁচামীর এই ভাড়কাটা পঞ্চায়েতের পাঁচটি আসনে সিপিআই(এম) জয়ী হয়েছিল গত পঞ্চায়েতে। সিপিআই(এম) কতগুলি আসনে জিতেছিল এটি প্রধান বিষয় নয়। তৃণমূল দেদার ভোট লুটের পরেও আদিবাসী সহ গ্রামগুলির মানুষের সমর্থনে সিপিআই(এম) এই এলাকায় জিতেছিল, এটি একটি প্রবণতা, মেজাজের ইঙ্গিতবাহী। কিন্তু আজকের পাঁচামীতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো— জল জমি জঙ্গলের অধিকার রাখতে লড়াইয়ের মেজাজ জারি আছে সেই গ্রামগুলিতেই, যেখানে ধানী হেমব্রম, বদন সরেন, স্মৃতিলতা টুডুদের পাশে আছেন মানুষ।
তাই ১১টি গ্রামে গড়ে উঠেছে গ্রাম সভা। গ্রাম সভাগুলি মূলত প্রতিরোধী মানুষদের ঐক্যবদ্ধ করছে। গ্রাম সভাগুলির আয়োজক ‘গ্রাম সভা সমন্বয় হুল কমিটি।’ ল পাহাড়ি, নতুন পাড়া, কেন্দ্র পাড়া, পাঁচামী, গিরি জোড়-১, গিরিজোড়-২, পাথর পাড়া, হাটগাছা, বুড়িতলা, রামপাড়া, ধেনুপাড়ার মতো গ্রামগুলিতে গ্রামসভা দৈনিক প্রচার করছে জল জঙ্গল জমিনের অধিকার রক্ষার লড়াই চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে। ‘গ্রাম সভা সমন্বয় হুল কমিটি’র সভাপতি সুশীল মুর্মূ জানালেন,‘‘আমরা জমি দেবো না। আমাদের প্রয়োজন উন্নয়ন। উপস্বাস্ত্য কেন্দ্র আছে। সেটির খারাপ অবস্থা। গিরিজোড় সাঁওতাল উচ্চ বিদ্যালয় আছে। সেখানে শিক্ষক নেই। বাংলা, ইতিহাস, জীবন বিজ্ঞান, সংস্কৃত, ফিলোজফির টিচার নেই। স্কুলের দেওয়াল ভেঙে গেছে। এসব নিয়ে সরকারের মাথাব্যথা নেই। জমির দাম, কাজের লোভ দেখিয়ে আমাদের উচ্ছেদ করতে নেমেছে। আমরা মানবো না।’’
লড়াই দাবিয়ে রাখতে সরকারের দুটি হাতিয়ার— টাকার বিনিময়ে তৃণমূলের হয়ে ভাড়া খাটা কিছু বেকার যুবক আর পুলিশ। এই দুই বাহিনী আদিবাসী সহ এখনও জমি দিতে না চাওয়া গ্রামবাসীদের ভয় দেখাচ্ছে বলে অভিযোগ। পথে আটকাচ্ছে। হুমকি দিচ্ছে। সুশীল জানালেন,‘‘আমাকেই দু’বার ভয় দেখিয়েছে রিভলভার নিয়ে। পুলিশের কাছে গেছি। বলছে আমাদের কিছু করার নেই।’’ পাঁচামীতে লড়াকু গ্রামবাসীদের পাশে দাঁড়ানো সমাজকর্মীদের বারবার আটকেছে পুলিশ। যেমন, গত মার্চে পরপর দু’দিন বোলপুর থেকে সমাজকর্মীদের অপর প্রতিনিধিদল পাঁচামীর উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার প্রস্তুতি নিতেই পুলিশ তাঁদের রাস্তায় আটকায়। পুলিশ প্রতিনিধিদলের অন্যতম সদস্য শিবু সরেনকে থানায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে রাখে।
পাঁচামীর কয়লা খনির জন্য মাটি খোঁড়ার কাজ শুরু হয়েছে শুধু চাঁদায়। সেখানে জঙ্গল ছিল। সেই জঙ্গল মুড়িয়ে শুরু হয়েছে কাজ। মোট ১২একর জমিতে কাজ চলছে। বেশিরভাগ জমি ছিল খাস। ফলে এই ক্ষেত্রে গ্রামবাসীদের সরাতে হয়নি। কিছু গ্রামবাসীর জমি ছিল ওই এলাকায়। চাষ হতো একবার, পাঁচামীর বাকি এলাকার মতোই।
বীরভূমের মহম্মদবাজার ব্লকের চাঁদায় মাত্র ১২ একর জমিতে ক্ষুদ্র প্রকল্প দেখিয়ে দেউচা পাচামীর জন্য পরিবেশগত প্রভাব পরীক্ষা করিয়ে ছাড়পত্র আদায় করেছে রাজ্য সরকার। যদিও ৪৩১.৪৭ একর জমিতে ব্যাসল্ট তোলাকেই লক্ষ্য বলে সরকার জানিয়েছিল। কয়লা উত্তোলনের কোনও প্রকল্পই সেখানে শুরু হয়নি, শুরু হয়েছে ব্যাসল্ট পাথর খননের কাজ। সেক্ষেত্রে বিরাট মুনাফার হাতছানি। সমগ্র এলাকায় ১২টি গ্রামে ২১ হাজারেও বেশি মানুষ বসবাস করেন। রয়েছে পাথর ভাঙার কল, পাথর খাদান, চাষজমি।
Comments :0