Post Editorial

গণনাট্য : সৃজনে অটল লক্ষ্যে অবিচল

উত্তর সম্পাদকীয়​

হিরণ্ময় ঘোষাল 


ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ, পশ্চিমবঙ্গর সপ্তদশ রাজ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে এক গভীর সঙ্কটপূর্ণ অথচ প্রবল সম্ভাবনাময় ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে। আগামী ১৪ থেকে ১৬ নভেম্বর, ২০২৫ সল্টলেকে ‘ঋত্বিক ঘটক ও সুকান্ত ভট্টাচার্য নগর’ (পূর্বাঞ্চলীয় সংস্কৃতি কেন্দ্র পূর্বশ্রী প্রেক্ষাগৃহে) ‘সলিল চৌধুরি মঞ্চে’। ‘দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন’-এর মধ্যে ওই তিনটি দিনে গণনাট্য সঙ্ঘের শিল্পী কর্মীরা মিলিত হবেন অতীতের পর্যালোচনা, বর্তমানের পর্যবেক্ষণ এবং ভবিষ্যতের সৃষ্টিকর্মের পদ্ধতি-প্রকরণ নির্ধারণের লক্ষ্যে।  
 ‘Peoples’ Theatre  stars the people’ - রল্যাঁর এই কথাটিকে শিরোধার্য করে যদি গণনাট্য সঙ্ঘকে কাজ করতে হয়, তাহলে সমাজের নিম্ন কোটির সেই মানুষকে, যারা এই সমাজের নিপীড়িত, নিষ্পেষিত, ক্ষুধার্ত, তাদেরকেই নায়কের আসনে বসাতে হয়।  আর সে কাজ করতে হলে তাদের চিনতে হয়, বুঝতে হয়, তাদের দুর্দশার প্রকৃত কারণটি খুঁজতে হয়, আর আলোকিত করতে হয় তাদের বন্ধন মুক্তির সঠিক পথটিকে। পর্যবেক্ষণ করতে হয় তাদের জীবন-সংগ্রামের প্রতিটি পর্যায়ে তারা কেমন করে তাদের শত্রুকে চিহ্নিত করে এবং প্রতিটি বাঁকে কেমন করে রণকৌশলে  পরিবর্তন ঘটায়। দেশে দেশে পরিস্থিতির ভিন্নতা থাকলেও লড়াইয়ের স্তর এবং ধরণ স্বতন্ত্র হলেও মূলে কিন্তু সমস্যার কারণ এবং লড়াইয়ের লক্ষ্য ও অভিমুখ নির্দিষ্টই থাকে। 
 গণনাট্য সঙ্ঘের স্রষ্টা ও শিল্পীদের তাই চিনতে হয় নিজের দেশ আর দেশের মানুষকে, পাশাপাশি পৃথিবীর দেশে দেশে মানুষের জীবন-সংগ্রামের প্রতি সহমর্মিতার মনোভাব গড়ে তুলতে হয়,  বিশ্বমানবতার সুরে সুরে মেলাতে হয়— ঠিক যেমন বিশ্ব মানবতার মহান মঞ্চে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিলেন আইনস্টাইন, রল্যাঁ, বারবুস, গোর্কি, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ। আমরা তো  তাঁদেরই উত্তরাধিকার বহন করছি। 
 আজ আমরা দেখছি সারা বিশ্বজুড়ে ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক সঙ্কট ও মন্দা, যা বিগত শতকের সঙ্কটের থেকে আরও গভীর। ফলশ্রুতিতে দেশে দেশে দক্ষিণপন্থা আরও উগ্র রূপ ধারণ করছে। মানুষের উপর আক্রমণ বাড়ছে, মানুষের সমস্ত অধিকারকে অবদমিত করে পৃথিবী জুড়ে নানা কায়দায় আধিপত্যবাদ চাপিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া আরও শক্তিশালী হচ্ছে। নৃশংসতার চরম শিখরে পৌঁছেছে গাজার ভূখণ্ডে ইজরায়েলের সেনা অভিযান। একতরফা মারণ যজ্ঞে মেতেছে মার্কিন মদতপুষ্ট  ইজরায়েলের সেনাবাহিনী। একইভাবে ইউক্রেনকে সামনে রেখে পিছন থেকে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ পরিস্থিতিকে জিইয়ে রাখা ও দীর্ঘায়িত করার ঘৃণ্য কাজে লিপ্ত হয়েছে আমেরিকা।   
সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পরে ‘There is no alternative ’( TINA) বলে ধনবাদী ব্যবস্থাকেই সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্ব ব্যবস্থা বলে জাহির করে যারা বিশ্বায়নী দর্শনের মোড়কে মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু করেছিল, তারাই আজ অর্থনৈতিক সঙ্কটের চাপে পড়ে হাঁসফাঁস করছে।  সঙ্কট যত বাড়ছে ততই তারা বাজারকে আর মুক্ত না রেখে কবজায় আনার জন্য নানা বেপরোয়া চেষ্টা  চালাচ্ছে। অন্যদিকে বন্ধ্যা অর্থনীতির সঙ্কটের চাপে পৃথিবীর দেশে দেশে অসাম্য, দারিদ্র, বেকারি, ক্ষুধা ও অপুষ্টি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।   
 স্বাভাবিকভাবেই যুদ্ধ ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সর্বত্র প্রতিবাদ ধ্বনিত হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য,  ফ্রান্স, গ্রিসের মতো উন্নত দেশগুলিতে সংগ্রামের ঢেউ উঠছে। চীন, ভিয়েতনামের মতো দেশগুলি ছাড়াও ইদানীং কলম্বিয়া, ব্রাজিল, মেক্সিকো, উরুগুয়ে, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি দেশগুলির মানুষও বিপরীতমুখী পথ ধরেছে। এই বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আন্তঃসমীকরণে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশ্বায়নের রসপুষ্টিতে একমেরু বিশ্ব গড়ে তোলার স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে। পক্ষান্তরে, ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চায়না, সাউথ আফ্রিকা (BRICS)-র মঞ্চে আরও অন্যান্য দেশের যোগদানের সুবাদে ( BRICS PLUS ) আবার বহুমেরু বিশ্বের ছবি স্পষ্ট হচ্ছে।   
ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের শিল্পী স্রষ্টারা বিভিন্ন দেশের মানুষের যুদ্ধ বিরোধী সংগ্রামে, স্বাধিকার রক্ষার সংগ্রামের পাশে থেকে তাদের জীবন যুদ্ধে সর্বাঙ্গীণ সমর্থন জানাবে এবং তাদের সৃষ্টির মধ্যেও তারই শিল্পীত্ব প্রকাশ ঘটাবে এটাই তো স্বাভাবিক। সৃষ্টিতে তারা প্রতিবাদী মানুষের ছবি আঁকবে, আর মানুষের মনের দ্বিধা-দ্বন্দ্বগুলিকে অতিক্রম করে সামনের দিকে এগিয়ে চলার লক্ষ্যে মানুষের অন্তঃসংগ্রামের জীবন্ত আলেখ্য রচনা করবে, যা একই সঙ্গে দেশের মানুষের কাছেও তুলে ধরবে বিশ্ব মানবতার এক মহৎ আদর্শকে। বলা যেতে পারে, মৃত্যুশয্যায় শুয়েও প্রতিদিন হিটলারি আক্রমণের মোকাবিলায় সোভিয়েত সেনাদের অগ্রগতির সংবাদের জন্য উদগ্রীব রবীন্দ্রনাথ সোভিয়েতের বিজয় কামনায় যেভাবে তুলে ধরেছিলেন বিশ্ব মানবতার চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত, সেই উত্তরাধিকারকেই আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। সমবেত কন্ঠে আবৃত্তি করি— “ উদয়শিখরে জাগে মাভৈঃ মাভৈঃ                                                                                                                                                   নবজীবনের আশ্বাসে                                                                                                                                                            জয় জয় জয় রে মানব অভ্যুদয়                                                                                                                                                               মন্দ্রি উঠিল মহাকাশে।’’

আমার স্বদেশ ভারতভূমি 
 যে দেশে “শক হুন দল পাঠান মোঘল এক দেহে হলো লীন’’,  সেই দেশে রাষ্ট্রীয় মদতে আজ রূপায়িত হচ্ছে হিন্দুত্বের কর্মসূচি। মুসলমান সংখ্যালঘুদের আজ নিশানা করা হচ্ছে। ‘‘নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান / বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান’’ - বহুত্ববাদী সংস্কৃতির তীর্থক্ষেত্র এই ভারতবর্ষে জাতিতে-জাতিতে ধর্মে-ধর্মে হানাহানি কখনোই আমাদের ঐতিহ্য-অনুসারী নয়। তবু হিন্দু সংহতি গড়ে তোলার নাম করে ভারতবর্ষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টি করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা জারি আছে।  
 যে কোনও বিভাজনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে লালন-রবি ঠাকুরকে সামনে রেখে ঐক্যের মন্ত্র উচ্চারণ করতে হবে আমাদের সৃষ্টিতে। ‘জাতের লড়াই দিয়ে নিরন্ন মানুষের ভাতের লড়াইয়ে কারা আঘাত হানে’- তা স্পষ্ট করে দিতে হবে আমাদের গানে, নাটকে। 
 কোন বহিঃ শত্রু নয়, বন্ধুবেশী দেশীয় শত্রুরাই দেশের বুকে বসে দেশের দাড়ি ওপড়াচ্ছে। দেশেরই প্রাকৃতিক সম্পদ লুট করে তারা পেট ভরাচ্ছে মুষ্টিমেয় কয়েকজন ধনবাদীর, আর বে-রোজগেরে হয়ে বুভুক্ষু মানুষ গভীর অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। তাদের না আছে কোনও অধিকার, না আছে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-খাদ্য-বাসস্থান। পৃথিবীতে সবচেয়ে অসাম্য বিরাজ করছে এমন দেশগুলির মধ্যে ভারত অন্যতম। 

২ 
আমাদের দেশে স্বাধীন, সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রী সংবিধানকে রক্ষা করার শপথ-নেওয়া-সংসদ আছে। লোকসভায়-রাজ্যসভায় বিরোধী সাংসদেরাও আছেন—  শুধু প্রকৃত গণতন্ত্রটাই নেই। বিরোধী সাংসদদের সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, তাদের কথায় কর্ণপাত না করেই “এক দেশ -এক জাতি -এক ভাষা -এক ধর্ম -এক নির্বাচন ”, এমনকি “এক স্টেশন-এক পণ্য’’ কায়েম করার লক্ষ্যে অবিচল বর্তমান শাসকেরা। এর পাশাপাশি তারা ইতিহাসকে বিকৃত করছে, পুরাণের গল্পগুলিকেও ইতিহাসের মর্যাদা দিয়ে প্রচার করছে। সে ক্ষেত্রে ইতিহাসের প্রকৃত ঘটনাগুলিকে মানুষের সামনে উপস্থিত করার দায়িত্ব তো আমাদেরই নিতে হবে। একই সঙ্গে মহাত্মা গান্ধীর গলায় মালা পরানো আর নাথুরাম গডসে’কে বীরের সম্মান জানানো, মানুষ কখনোই মেনে নেবে না। অতীত ঐতিহ্যের সরণি বেয়ে ইতিহাসের সদর্থক উপাদানগুলিকে পাথেয় করে সমকালকে দেখা, বোঝা এবং ঐতিহ্যের ক্রিয়াশীল উত্তরাধিকারের আলোয় ভবিষ্যতের লক্ষ্য পথকে আলোকিত করার পবিত্র কর্তব্য গণসংস্কৃতি কর্মীরা কখনোই অস্বীকার করতে পারেন না।   
 এই ভাবনার আলোকেই গণনাট্য সঙ্ঘের আসন্ন রাজ্য সম্মেলন সৃষ্টিকর্মে ও উপস্থাপনায় তাদের ত্রুটি ও দুর্বলতাগুলিকে চিহ্নিত করবে, তাদের সৃষ্টি কতটা  প্রচারধর্মী হবে, প্রচারকেও প্রকাশে পরিণত করার নান্দনিক লক্ষ্যে কিভাবে অগ্রসর হওয়া যায় সেই চর্চাতেই সমৃদ্ধ হবে। 
 ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ গড়ে উঠেছিল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, যুদ্ধবিরোধী, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বিরোধী আন্দোলনের সাংস্কৃতিক শরিক হিসাবে। জন্মলগ্ন থেকেই গণআন্দোলনের সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্ক। তাই আন্দোলনের ময়দানেই সাংস্কৃতিক প্রচারে অকুতোভয় গণনাট্য শিল্পীরা স্বাভাবিক স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করেন।  কিন্তু মনে রাখতে হবে হাজার হাজার মানুষ লড়াইয়ের ময়দানে শামিল হলেও লক্ষ লক্ষ দরিদ্র মানুষ সেই আওতার বাইরে অবস্থান করেন। কোন কায়দায় কি ধরনের সাংস্কৃতিক উপচার নিয়ে সেই মানুষের অঙ্গনে পৌঁছানো যায় সেটাই হোক আজকের চর্চার বিষয়। কারণ খেটে খাওয়া মানুষের দৈহিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক আক্রমণের পাশাপাশি বিপুল প্রচার তরঙ্গে আজ নিরন্তর আক্রান্ত হচ্ছে মানুষের মস্তিষ্ক আর অরক্ষিত অবসর। সেখানে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের রূপরেখা কি হবে?  
 বর্তমানে এই বাজার অর্থনীতির যুগে বাজারই তো মানুষের পছন্দ রুচি এমনকি চাহিদাও নির্মাণ করে।  বিশ্ব জুড়ে লোভের পশরা সাজিয়ে মানুষকে বিশ্বায়নের ছাচে ঢালা খরিদ্দার হিসাবেই তারা দেখতে চায়।  সুলভ মূল্যে তারা কিনে নিতে চায় মানুষের মন, চিন্তা, বোধ— এককথায় সংস্কৃতি। নানা দেশের নানা জনগোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতিকে বিশ্বায়নের শিলে বেটে তারা সংস্কৃতির এমন একটি মণ্ড বানিয়ে তোলে যাতে সারা পৃথিবীর কোমর একই ছন্দে দুলতে পারে। শিল্পে আধুনিকীকরণের নামে তার স্বাভাবিক রূপ-রস-গন্ধকে বিকৃত করে বাজারি কক্টেলের সুদৃশ্য পেয়ালায় তারা পরিবেশন করে এবং বিপুল প্রচারে তাকে জনপ্রিয় করে তুলতে চায়।
মনে রাখতে হবে যা কিছু জনপ্রিয় তা সব ক্ষেত্রেই শারীরিক বা মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে মঙ্গলকর নাও হতে পারে। 
 ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ, পশ্চিমবঙ্গ মনে করে, আমাদের দেশের সংস্কৃতি আন্দোলন যে ধারায় বিকশিত হয়েছে সেই ধারাতেই তার স্বচ্ছন্দ ক্রমবিকাশে আরও যত্নবান হওয়া প্রয়োজন। শিকড়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেলে বহিরঙ্গে যত জলুষই থাকুক, সে তার দেশীয় ও জাতীয় চরিত্র হারিয়ে ফেলে। আমাদের দেশে গণসংস্কৃতি আন্দোলনকে মাটির সঙ্গে মানুষের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থেকে বিষয়গত দিকে সর্বাধুনিক আন্তর্জাতিক চেতনার প্রকাশ ঘটাতে হবে, সেই সঙ্গে শিল্পমানও উন্নত ও শাণিত করতে হবে। আঙ্গিক বা  উপস্থাপনাগত দিক দিয়ে আমাদের প্রযোজনাগুলিকে যেন আগন্তুক বলে মনে না হয়। মনে রাখতে হবে content internationalহলেও form যেন nationalহয়। দেশীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্যের পরম্পরা থেকে তা যেন বিচ্ছিন্ন না হয়।

 

Comments :0

Login to leave a comment