Post Editorial

শেখালেন তিনি শেখালেন

উত্তর সম্পাদকীয়​

কনীনিকা ঘোষ

পৃথিবীর ইতিহাসে এক অনন্য গ্রন্থ কমিউনিস্ট ইশ্‌তেহার, যা মার্কস এঙ্গেলস প্রকাশ করেন ১৮৪৮ সালে যেখানে তারা সমাজের বিকাশ ব্যাখ্যা করেন এবং বলেন আসল কথা এই সমাজকে বদলানো। তাই শোষিতের বঞ্চনাকে প্রতিহত করতে, নিপীড়িতের যন্ত্রণাকে রোধ করতে  তারা কমিউনিস্ট ইশ্‌তেহারে শ্রেণি সংগ্রামের কথা  বললেন এবং বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে সমাজ পরিবর্তনের কথা বললেন, বললেন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা,সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার কথা। 
মার্কস এঙ্গেলস তাদের জীবিতকালে  বাস্তবে এই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা দেখে যেতে পারেননি, তাদের মতাদর্শকে অবলম্বন করে কমরেড লেনিন অক্টোবর তথা নভেম্বর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে তা সফল করেছিলেন। এর জন্য লেনিনকে রাশিয়ায় এক দুর্বার লড়াই সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে হয়েছিল আর সে লড়াই সংগ্রামের পথেই লেনিন পড়েছেন - লড়েছেন - বলেছেন - লিখেছেন যা চিরকাল শোষণ মুক্তির পথে অবিস্মরণীয় শিক্ষা হয়ে থাকবে।
মার্কস এঙ্গেলসের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মতাদর্শ প্রচারের পর এই মতবাদের ভিত্তিতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ বিশেষতঃ পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলিতে শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠেছিল। ১৮৭১ সালে ফ্রান্সের প্যারিস শহরে সেখানকার মার্কসবাদী পথে  শ্রমিকশ্রেণি প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা করে। যা 'প্যারিকমিউন' নামে খ্যাত। যদিও এই চেষ্টা সফল হয়নি। বুর্জোয়াদের হিংস্র আক্রমণে  বীরত্বপূর্ণ লড়াই করেও পরাস্ত হন কমিউনার্ডরা। রক্তস্রোতে ভেসে  ৭১ দিন বাদে এর পতন ঘটে। কিন্তু প্যারি কমিউন ইতিহাসে রেখে যায় এক চিরস্থায়ী পদচিহ্ন।

১৯১৭ সালে জার শাসিত রাশিয়ায় কমরেড লেনিনের নেতৃত্বেই প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয় যা রাশিয়ার পুরানো ক্যালেন্ডারে অক্টোবর বিপ্লব (যাতে ১৩ দিনের পার্থক্য ) এবং পৃথিবীতে নভেম্বর বিপ্লব নামে খ্যাত। মার্কস এঙ্গেলস বলেছিলেন যে এগিয়ে থাকা পুঁজিবাদী দেশ তথা শিল্পোন্নত দেশেই আগে বিপ্লব হবে। তবে তারা যখন একথা বলেন তখন পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদের পর্যায়ে উন্নীত হয়নি। তাই তখন এ ধারণাই সঠিক ছিল কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর শেষে এবং বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় পুঁজিবাদ তার সর্বোচ্চ স্তর সাম্রাজ্যবাদে প্রবেশ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি গোটা পৃথিবীকে নিজেদের মধ্যে ভাগ বাঁটোয়ারা করে নেবার  যুদ্ধে লিপ্ত হয় আর সেই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়েই লেনিন বললেন, এটা ঠিক জার শাসিত রাশিয়া শিল্পোন্নত নয়, রাশিয়া ইউরোপের উঠোন কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বের ফলে রাশিয়া অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছে। সাম্রাজ্যবাদী শৃঙ্খলের এই দুর্বলতম গ্রন্থিতেই শ্রমিক শ্রেণিকে আঘাত হানতে হবে। এবং সে কথা সত্য হয়। এই বিপ্লবে নেতৃত্ব দেন লেনিন।

জারের শাসনে রুশ দেশ অন্য দেশের তুলনায় অনেক দেরিতে পুঁজিতান্ত্রিক অগ্রগতির পথে আসে।। পশ্চাৎপদ এই  রাশিয়ায়  ছিল ক্ষুধা, হাহাকার।  ফলে জারের স্বৈরশাসন ছিল জনগণের সবচেয়ে বড় শত্রু।
 পুঁজিবাদী শিল্পের বিকাশ যখন মোটামুটি দ্রুত গতিতে হলো, তখন আধুনিক শিল্পের সর্বহারা শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ে। তারা  পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য  সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা থেকে শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ে তোলে।  আর এই একই সময়ে পশ্চিম ইউরোপের শ্রমিক আন্দোলনের প্রভাবে রুশ দেশে প্রথম মার্কসবাদী সঙ্ঘগুলি গড়ে উঠতে থাকে। এর আগে মার্কসবাদ বিরোধী নারদনিকেরা রুশদেশে বিপ্লবী কাজ করতো। এরকম একজন নারদনিক ছিলেন লেনিনের দাদা। জার তৃতীয় আলেকজান্ডারকে খুন করার ষড়যন্ত্রের  জন্য তার তার প্রাণ দণ্ড হয়। মায়ের কাতর অনুরোধেও লেনিনের দাদা প্রাণ ভিক্ষা করতে অস্বীকার করেন।

দাদা আলেকজান্ডারের এই বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগ লেনিনকে গুপ্ত হত্যাপন্থী করে তোলেনি কিন্তু তাকে বৃহত্তর রুশ সমাজের সঙ্গে   যুক্ত করেছিল। তার মনে হলো এই সমাজ বদলানো দরকার, দরকার জার মুক্ত রাশিয়া, যা তার দাদা দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু  পথ  ওটা  না, তাই তিনি রাস্তা খুঁজেছেন। এই সময়ই বৌদ্ধিক জগতে তাকে আলোড়িত করেছে মার্কসবাদ। প্লেখানভ  প্রতিষ্ঠিত  শ্রমিক মুক্তি সঙ্ঘ লেনিনকে প্রভাবিত করে।  তারপর তার নেতৃত্বে শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে রুশ দেশে মার্কসবাদের মিলন ঘটে। এরপর থেকে তার জীবন শুধু  সংগ্রামের। সেই লড়াইয়ের মোড়ে আর বাঁকে তিনি লিখেছেন, ক্ষুরধার যুক্তিতে পরাস্ত করেছেন বিরোধীদের।।

১৮৯৫ সালে তার সেন্টপিটার্সবুর্গের যাবতীয় মার্কসবাদী শ্রমিক চক্রকে একটি দলে একত্রিত করে  'লিগ অব স্ট্রাগল ফর দ্য ইম্যানসিপেশন অব দি ওয়ার্কিং ক্লাস '  গঠন ছিল মার্কসবাদী শ্রমিক পার্টি গঠনের প্রস্তুতি।  ১৮৯৫ সালের ডিসেম্বর মাসে জার সরকার লেনিনকে গ্রেপ্তার করলেও জেল থেকেই লেনিন সঙ্ঘের কর্মসূচির খসড়া তৈরি করেন।

সংগ্রামের পথেই  লেনিন উপলব্ধি করেন যে এমন একটি পার্টি প্রয়োজন যা সুসংহত ও কেন্দ্রীভূত হবে এবং যা বিপ্লবী আন্দোলনকে পরিচালিত করার ক্ষমতা রাখবে। 'কোথায় আরম্ভ করিতে হইবে' নামে বিখ্যাত প্রবন্ধে, পরবর্তীকালে তার এই পরিকল্পনাকেই 'কি করিতে হইবে ''হোয়াট ইজ টু বি ডান ' গ্রন্থে  বর্ধিত আকারে প্রকাশ করেন যা ছিল পার্টি গঠনের এক অনন্য পরিকল্পনা। লেনিন বলেন, রুশ দেশের উপযোগী রাজনৈতিক সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠা করাই হইবে আমাদের কাজের আরম্ভ, আমাদের আকাঙ্ক্ষিত সংগঠন সৃষ্টির প্রথম ধাপ। তাই তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন তার বেআইনি সংবাদপত্র ইসক্রা। তিনি পার্টির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্বন্ধে বলেন, এই পার্টিকে হতে হবে শ্রমিক শ্রেণির অগ্রণী বাহিনী, শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনের পথপ্রদর্শক। পুঁজিতন্ত্রের উচ্ছেদ ও সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করাই হলো পার্টির চরম লক্ষ্য। এইভাবে লেনিন প্রতি পদক্ষেপে তত্ত্বে এবং হাতে-কলমে পার্টিকে গড়ে তুলেছিলেন।  
লেনিন বলেছিলেন পার্টি এমন একটি সুসংহত বাহিনী যার সভ্যরা কেবল পার্টিতে নাম লিখে প্রবেশ করতে পারবে তা না, পার্টির কোনও সংগঠন মারফত তাদের  পার্টিতে ঢুকতে হবে। সুতরাং পার্টি শৃঙ্খলাকেও  মেনে নিতে হবে। অন্যদিকে মারতভ তার বিপরীত বললে লেনিন যুক্তিতে যুক্তিতে  মারতভের বিরুদ্ধে লড়াই করেই, কংগ্রেসে জয় লাভ করেন। এই কংগ্রেস নির্বাচন উপলক্ষে লেনিন পন্থীরা অধিকাংশ ভোট পায় ও তাদের বলশেভিক (সংখ্যাগরিষ্ঠ) বলা হয় এবং অন্যরা মেনশেভিক নামে পরিচিত হয়। লেনিন মেনশেভিকদের সুবিধাবাদের  বিরুদ্ধে কলম ধরেন, লেখেন 'এক পা আগে দুই পা পিছে'  যাতে তিনি সংগঠনের প্রধান প্রধান নীতির ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন মার্কসবাদী পার্টি শ্রমিক শ্রেণির একটি অংশ, একটি বাহিনীর স্বরূপ কিন্তু যে কোনও বাহিনী শ্রমিক শ্রেণির পার্টি নয়। পার্টি হলো অগ্রগামী বাহিনী, চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাহিনী, শ্রমিক শ্রেণির মার্কসবাদী বাহিনী। পার্টি সম্মিলিত ইচ্ছার মূর্ত প্রতীক।  তিনিই পার্টিতে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার কথা বলেন, যা  আজও বিপ্লবী পার্টির  অন্যতম মর্মবস্তু।

শ্রমিকদের লড়াই  আন্দোলন রাশিয়ায় বাড়তে থাকে। ১৯০৫ সালের ৯ জানুয়ারি তাদের  নিরস্ত্র মিছিলে  জার দ্বিতীয় নিকোলাসের হুকুমে গুলি চললে রাশিয়ায়  বিপ্লব শুরু হয়। জুন মাসে কৃষ্ণ সাগরে নৌবাহিনীর পোটেমকিন  নামে একটি যুদ্ধ জাহাজে বিদ্রোহ হয়। এই বিদ্রোহের উপর বিরাট গুরুত্ব আরোপ করে লেনিন বলেন  যে এই আন্দোলনে নেতৃত্ব গ্রহণ করা এবং শ্রমিক কৃষক এবং স্থানীয় সেনাদলের আন্দোলনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা বলশেভিকের পক্ষে প্রয়োজন। নানান সমন্বয়ের অভাবে বিদ্রোহের অবসান ঘটে পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে।

বিপ্লব পরাজিত হলে  মেনশেভিকরা  বিপ্লবের পথ থেকে সরে সংস্কারপন্থী পার্টি গঠন করল নাম দিল 'স্তলিপিন লেবার পার্টি।' লেনিন তার 'মেটেরিয়ালিজম অ্যান্ড ইম্পেরিও ক্রিটিসিজম' গ্রন্থে  পার্টিকে এর বিরুদ্ধে তাত্ত্বিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করলেন।

১৯ জুলাই (নতুন হিসাবে ১ আগস্ট রুশ দেশ যুদ্ধে যোগ দিল।  লেনিন দেখিয়েছিলেন যুদ্ধ হলো পুঁজিতন্ত্রের এক অবশ্যম্ভাবী আনুষঙ্গিক ব্যাপার)।

যুদ্ধের  সূচনা থেকে  মেনশেভিক সহ পাতি বুর্জোয়া দলগুলি পিতৃভূমি রক্ষার উদ্দেশ্যে জার  সরকারকে যুদ্ধ চালাতে সাহায্য করল। দ্বিতীয়  আন্তর্জাতিকের বিভিন্ন পার্টিগুলি নিজ নিজ দেশের সাম্রাজ্যবাদী সরকারের পক্ষে যোগ দিল কিন্তু লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরা  বলল সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে জার সরকারের সামরিক পরাজয় জনসাধারণের পক্ষে অপেক্ষাকৃত কম অমঙ্গলের ব্যাপার, কারণ এর ফলে জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে জনগণের বিজয় এবং পুঁজিবাদী দাসত্ব ও সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের কবল থেকে শ্রমিক শ্রেণির মুক্তি সংগ্রামের সাফল্য লাভ সহজ হবে। বাস্তবে হলোও তাই।

১৯১৭ সালের শুরুই হলো ৯ জানুয়ারি, ধর্মঘটের মাধ্যমে। এই ধর্মঘট ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ১৯৯৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি  পেট্রোগ্রাডে পুটিলভ কারখানার ধর্মঘট শুরু হলো।  ২৩ ফেব্রুয়ারি (৮ মার্চ) আন্তর্জাতিক মহিলা দিবস ছিল,সেদিন  শ্রমিক মেয়েরা রাস্তায় বেরিয়ে অনাহার, যুদ্ধ ও জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করল। ধর্মঘট ক্রমে বাড়ছিল। শ্রমিক সাধারণের লাল ঝান্ডায় স্লোগান লেখা ছিল জার  নিপাত যাক,  যুদ্ধ নিপাত যাক, আমরা চাই রুটি।
বিপ্লব আরম্ভ হবার পরই সর্বহারা শ্রেণি শ্রমিক ও সৈনিক প্রতিনিধিদের সোভিয়েত তৈরি করে। এগুলিই ছিল  নভেম্বর  বিপ্লবের প্রাথমিক ভ্রূণ।  বিপ্লবের পর অস্থায়ী সরকার তৈরি  হয়। পেট্রোগ্রাড সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণ করতে বামপন্থীরা, তারা  সরকারে অংশ নেয়নি। কিন্তু মেনশেভিকদের  নেতা কেরেনেস্কি প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেছিলেন। এই সরকারের কাজ ছিল বিপ্লবী বক্তৃতা দিয়ে বিপ্লবের অবসান ঘটানো এবং বুর্জোয়াদের হাতে  ধীরে ধীরে ক্ষমতা তুলে দেওয়া। কেরেনেস্কি জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার কথা বলেন কিন্তু লেনিনের নেতৃত্বে একমাত্র বলশেভিকরা  যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। সৈন্যরা বুঝল তাদের কথা বলছে একমাত্র বলশেভিকরা। জারের রাশিয়া ছিল অবদমিত জাতিগুলোর জেলখানা বলশেভিকরাই বলেছিল স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দাও, কৃষকদের হাতে জমি দাও, শিল্প দাও শ্রমিকদের হাতে।


লেনিন তখন ছিলেন সুইজারল্যান্ডের জুরিখে।  সে সময় জার সরকারের এক নম্বর শত্রু  লেনিন অনেক কষ্টে ৩ এপ্রিল  পৌঁছালেন পেট্রোগ্রাডে। লেনিন ছাড়া পার্টির  অন্যান্য নেতৃত্ব জিনোভিয়েভ, কামেনভ, স্তালিন  সবাই রাশিয়ায়  ছিলেন কিন্তু তারা কেন্দ্রে বসে  বিপ্লবকে যেভাবে বুঝেছিলেন তার চেয়ে অনেক বেশি ভালো করে  বিপ্লবের চরিত্র সম্ভাবনা বুঝেছিলেন লেনিন, অথচ তিনি ছিলেন বাইরে। তাইতো  লেনিনই নভেম্বর বিপ্লবের প্রাণপুরুষ।  তার গোটা প্রস্তাব তিনি শুরু করলেন ক্ষমতা দখল দিয়ে। আশ্চর্য হলেন সবাই। নিজের পার্টিতেও লেনিন তখন সংখ্যালঘিষ্ঠ। এই খসড়া তিনি করে এনেছিলেন জুরিখ থেকে। ৩ এপ্রিল লেনিন পৌঁছালেন,  আর ৭ এপ্রিল থেকে প্রাভদাতে  প্রকাশিত হতে শুরু করল 'এপ্রিল থিসিস।' :সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ব্লু প্রিন্ট। সেখানেই তিনি বললেন কেন ক্ষমতা দখল করতে হবে। বললেন বর্তমানে এই  কেরেনেস্কি সরকারের নির্দেশে কেউ চলে না, চলে সোভিয়েতের নির্দেশে। তখন লেনিন নভেম্বর বিপ্লবের প্রধান স্লোগান হাজির করলেন, "সোভিয়েতের হাতে সমস্ত ক্ষমতা চাই।" বললেন ক্ষমতা কখনো অব্যবহৃত পড়ে থাকে না, সোভিয়েত যদি নিজের হাতে ক্ষমতা তুলে না নেয় প্রতিক্রিয়ার হাতে যাবে ক্ষমতা। ধ্বংস হবে বিপ্লব।

যদিও এই পেট্রোগ্রাডে  প্রধান শক্তি ছিল মেনশেভিকরা। লেনিন বললেন তারা এ কাজ করবে না, করতে হবে বলশেভিকদের।  তিনি মেনশেভিকদের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠা করলেন যে  সাম্রাজ্যবাদের যুগে পুঁজিবাদ কোনও বিপ্লবী সম্ভাবনার জন্ম দেবে না,  তাই অপেক্ষা নয়  এখনই ক্ষমতা দখল করতে হবে। পালটা আঘাত করল প্রতিক্রিয়ার শক্তি। ৩ জুলাই পেট্রোগ্রাডে শ্রমিক ও সৈনিকদের একটি স্বতঃস্ফূর্ত মিছিলের ওপর সরকার গুলি চালায়। লেনিন দেশ ছাড়তে বাধ্য হন, চলে যান ফিনল্যান্ড। বলশেভিক নেতারা গ্রেপ্তার হন।  এই অবস্থায় লেনিন লেখেন 'রাষ্ট্র ও বিপ্লব' যাতে তিনি আপসহীন  বিপ্লবের কথা বলেন।  এগুলির মধ্যে দিয়েই লেনিন হয়ে ওঠেন গোটা রাশিয়ার সমস্ত শোষিত মানুষের  অন্তরের নেতা, আর বলশেভিক পার্টি  শক্তি বাড়িয়ে নেয়। রুটি, শান্তি, জমির স্লোগান দেয় তারা।  যা ছিল মানুষের মনের দাবি।


অবশেষে আসে ২৪ অক্টোবর (৬ নভেম্বর।) কেরেনেস্কি  আবার মারাত্মক ভুল করেন। বলশেভিকদের উপর বেপরোয়া আক্রমণ শুরু করে। সাঁজোয়া গাড়ি  তাদের আক্রমণ করে, স্তালিনের যোগ্য নেতৃত্বে তা মোকাবিলা করা হয়। লেনিন  ঐদিন রাতে স্মোলনিতে আসেন এবং অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ২৫ শে অক্টোবর (৭ নভেম্বর)  রেডগার্ড সেনাবাহিনী, অভ্যুত্থান, শ্রমিক ও নাবিকরা রেলস্টেশন, ডাকঘর টেলিফোন, টেলিগ্রাম, সমস্ত সেতু রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোর দখল নেয়।  লেনিনের নির্দেশে  যুদ্ধ জাহাজ অরোরা থেকে কামানের তোপ দেগে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সূচনা হলো।  এই ৭ নভেম্বর থেকে শুরু হয়। বিপ্লবী  ক্ষমতা হস্তান্তরের ১৭ নভেম্বর এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়। আগুনের মতো বিজয়ের এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে গোটা রাশিয়ায়। এটাই ছিল' দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন।' 
বিপ্লব মানে তো গায়ের জোরে একটি শক্তিকে উচ্ছেদ করে নতুন শক্তির ক্ষমতা দখল, তার মানে তো যুদ্ধ, রক্ত। কিন্তু রাশিয়ার বিপ্লব ছিল  অন্যরকম। কেরেনেস্কিদের বলশেভিকরা  ঘিরে বসে থাকে তারপর তাদের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে ছেড়ে দেয়।  এরিক হবসবম তার ' Age of Extremes' এ  লিখেছেন বিপ্লব নিয়ে তৈরি আইজেনস্টাইনের অক্টোবর ফিল্মটি  তৈরি করার সময় যত লোক আহত হয়েছিল তার থেকে অনেক কম লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল আসল বিপ্লবের সময়। সাজোঁয়া  গাড়ি নিয়ে  বলশেভিকরা এসেছিল ভয় দেখাতে, কামানের  তোপ দেগে ছিল যুদ্ধজাহাজ অরোরা,  কিন্তু সেটা শ্বেতপ্রাসাদ দখল করতে নয়  তারা ক্ষমতা দখল করেছে সেটা সবাইকে জানান দিতে। বিপ্লবের পক্ষে বিপ্লবের বিপক্ষে অন্তহীন বিতর্ক চলেছে। পরাজিত পক্ষ নিজেদের মতন বলেছে কিন্তু না: তার জন্য তাদের অত্যাচার করা  হয়নি। এই ছিল নভেম্বর বিপ্লব।  প্রতিমুহূর্তে একদিকে তত্ত্ব উপস্থিত করে অন্যদিকে সঠিক প্রয়োগে, নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট  স্লোগান দিয়ে, মানুষকে পক্ষে এনে  লেনিন সফল  করেছিলেন নভেম্বর বিপ্লব, পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব যা শ্রমজীবী মানুষের লড়াইয়ের জন্য আজও প্রাসঙ্গিক, প্রাসঙ্গিক খেটে খাওয়া, বঞ্চিত, শোষিত, নিপীড়িত মানুষের জন্য, মেয়েদের জন্য, দলিতদের জন্য, সবার জন্য।, নভেম্বর বিপ্লব  আজও তাই  অনন্য,চিরজয়ী।

 

Comments :0

Login to leave a comment