Labour Code

অবাধ শোষণের লাইসেন্স

সম্পাদকীয় বিভাগ

শ্রম কোড চালুর প্রতিবাদ তামিলনাড়ুতে।

বিহারে নির্বাচনে বড়সড় জয়ের পর নিজেদের অপ্রতিরোধ্য ভেবে নিয়ে সংস্কারের নামে কর্পোরেট পুঁজির অবাধ শ্রম শোষণ ও মুনাফা লুণ্ঠনে প্রবল উদ্যমে মাঠে নেমে পড়েছে মোদী সরকার। বিহারের নির্বাচনে বিরোধী জোটের জয়ের সম্ভাবনা তৈরি হওয়ায় মোদী-শাহরা কিছুটা চাপে ছিলেন। তাই শ্রমজীবী তথা জনবিরোধী বেশ কিছু সংস্কারের কাজে তারা এতদিন ঝুঁকি নিতে চায়নি। জেতার পরই ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শুরু করেছে। কোনোরকম আলোচনা বা প্রাক প্রস্তুতি ছাড়াই চট‍‌জলদি একতরফাভাবে লাগু করে দিয়েছে চারটি শ্রমকোড। সংবিধানে শ্রম যৌথ তালিকায় থাকা সত্ত্বেও রাজ্যগুলির সঙ্গে কোনোরকম আলোচনা না করে গায়ের জোরে চাপিয়ে দেওয়া হলো নতুন শ্রম আইন। গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকেও তোয়াক্কা করেনি স্বৈরাচারী মানসিকতা। গণতন্ত্রে সরকারপক্ষই যে সব নয় বিরোধীদেরও গুরুত্ব আছে তাকে পুরোপুরি অস্বীকার করা হয়েছে। সর্বোপরি যে শ্রমিক কর্মচারীদের স্বার্থের দোহাই দিয়ে বর্তমান ২৯টি শ্রম আইনকে বাতিল করে চারটি শ্রমকোড তৈরি করা হয়েছে সেই শ্রমিক-কর্মচারীদের ১৩টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন একেবারে গোড়া থেকে এর সর্বাত্মক বিরোধিতা করে গেলেও তাকে পাত্তাই দেওয়া হয়নি। আরএসএস’র শ্রমিক সংগঠন বিএসএস ছাড়া দলমত নির্বিশেষে দেশের সমস্ত ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন এই শ্রম কোর্ডের যে বিরোধী এবং দেশের কৃষকরাও যে এই প্রশ্নে শ্রমিকদের পক্ষে তা প্রমাণ হয়েছে তিন তিনটি সর্বভারতীয় সাধারণ ধর্মঘটের অভাবনীয় সাফল্যের মধ্যে দিয়ে।
প্রাক স্বাধীনতাকাল থেকে শুরু করে শ্রমিকশ্রেণি বহু লড়াই আন্দোলন, আত্মত্যাগের বিনিময়ে যে সব সুযোগ সুবিধা ও অধিকার অর্জন করেছিল সেগুলি সুরক্ষিত ছিল ২৯টি শ্রম আইনের মাধ্যমে। মোদী ঘনিষ্ঠ কর্পোরেট মালিকদের পরামর্শে দেশি-বিদেশি কর্পোরেট পুঁজির নিয়ন্ত্রণহীন বর্ধিত মুনাফার স্বার্থে সংস্কারের নামে সেই সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার কেড়ে নেওয়া হলো চারটি শ্রমিক কোডের মাধ্যমে। এই কোডগুলিতে অনেক সুবিধার কথা আছে কিন্তু সেগুলি কার্যকরের আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। সবচেয়ে বড় কথা যারা সেই সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন সেই শ্রমিক-কর্মচারীদের কাজের নিরাপত্তাই নেই। শ্রমকোড মালিকদের অধিকার দিয়েছে যখন খুশি শ্রমিক ছাঁটাইয়ের। তাছাড়া স্থায়ী শ্রমিকের ব্যবস্থাটাই কার্যত তুলে দিয়ে ঠিকা প্রথায়, নির্দিষ্ট সময়ভিত্তিক কর্মী নিয়োগের অধিকার দেওয়া হয়েছে। মজুরির প্রশ্নে শ্রমিকদের মতামত বা দর কষাকষির সুযোগ তুলে দেওয়া হয়েছে। মজুরি ঠিক হবে মালিকের মরজিমাফিক। কোনও নিয়ম বা বিধি শৃঙ্খলার মধ্যে তাকে বাঁধা হয়নি। শ্রমিকরা যদি বাড়তি মজুরি, সুযোগ-সুবিধা দাবি করে, তাহলে তাদের ছাঁটাই করার অধিকার মালিকের হাতে। অর্থাৎ শ্রমকিদের কার্যত ক্রীতদাসের পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়েছে। একমাত্র কাজ না করার অধিকার ছাড়া আর কোনও অধিকার তাদের থাকছে না। শ্রমকোডের প্রতিটি ধারা উপধারা শেষ পর্যন্ত মালিকের চাহিদা পূরণকে সামনে রেখে তৈরি হয়েছে। নামে শ্রম কোড হলেও যারা শ্রম দেবে, যাদের শ্রমের বিনিময়ে পণ্য পরিষেবা তৈরি হবে, সম্পদ তৈরি হবে সেই শ্রমিকদের বঞ্চিত করে সর্বোচ্চ হারে তাদের শ্রম চুরির বন্দোবস্ত হয়ছে এই কোডে।
মালিক যদি অনেক বেশি মুনাফা না পায় তাহলে নির্বাচনী বন্ডের মতো শাসক আরএসএস-বিজেপি’র তহবিলে ঢালাও টাকা ঢালবে কি করে। মোদী সরকার সেই বন্দোবস্তই করে দিয়েছে। হিন্দুত্বের নামে ধর্মীয় আবেগ ছড়িয়ে, মুসলিম বিদ্বেষ ও ঘৃণা বাড়িয়ে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের সাফল্য বিজেপি ঘরে তুলেছে বিহারে। শ্রমজীবী মানুষ বুঝতে পারলেন না ধর্মান্ধতার আফিম গিলিয়ে তাদের যুক্তিবোধ ও বাস্তব চেতনাকে ভোঁতা করে দিয়ে তাঁদেরই চরম সর্বনাশের রাস্তা তৈরি করে দিয়েছে এই কোড।

Comments :0

Login to leave a comment