গত দু’তিন মাস ধরে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রী পীযূষ গোয়েল বারংবার বলেছেন ভারত-মার্কিন বাণিজ্য জট খুলে যাবার মুখে। কখনো ওয়াশিংটনে, কখনো দিল্লিতে দফায় দফায় দু’দেশের প্রতিনিধিরা আলোচনা করে চলেছেন জট খেলার জন্য। কিন্তু জট কিছুতেই খুলছে না। জটটা পাকিয়েছেন ট্রাম্প। আমেরিকার অর্থনীতির স্বার্থে ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ এবং ‘আমেরিকাকে আবার মহান করো (মেগা)’ নীতি কার্যকর করতে গিয়েই এই জট তৈরি হয়েছে। ট্রাম্পের রক্ষণশীল অতি দক্ষিণপন্থী ভাবনায় উদারনীতি তথা অবাধ বিশ্ব বাণিজ্যের কারণে আমেরিকার অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়ছে। আর শক্তিশালী হচ্ছে অন্যান্য দেশের অর্থনীতি। অর্থাৎ মার্কিন স্বার্থহানি করেই অন্য দেশের স্বার্থ সিদ্ধি হচ্ছে। সবদেশ কার্যত বিনাশুল্কে অথবা নামমাত্র শুল্কে তাদের পণ্য আমেরিকায় বিক্রি করছে অথচ নিজেদের দেশে মার্কিন পণ্য ঢুকতে দিচ্ছে না। ফলে বছর বছর আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি হু হু করে বাড়ছে। ক্রমাগত বিপুল পরিমাণে বাণিজ্য ঘাটতি মার্কিন অর্থনীতিকে ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
এর মোকাবিলায় ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেই ভারত, ইউরোপ সহ সব দেশের পণ্যের উপর উচ্চ হারে আমদানি শুল্ক চাপিয়ে দেন। পাশাপাশি জানিয়ে দেন এই বর্ধিত শুল্ক কমবে তখন যখন সংশ্লিষ্ট দেশের বাজারে মার্কিন পণ্যের প্রবেশের ব্যবস্থা হবে। অর্থাৎ যেসব দেশ মার্কিন পণ্য কিনবে সেই দেশের পণ্যের শুল্ক হ্রাস করে বাণিজ্য চুক্তি হবে। ট্রাম্প চান না কোনও দেশ, বিশেষ করে চীন, ভারত আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য করে বিপুল উদ্বৃত্ত করুক।
ট্রাম্প চান ভারতের বাজারে মার্কিন কৃষিপণ্যের রপ্তানি বাধামুক্ত হোক। মার্কিন ডেয়ারি পণ্যও ভারতের বাজারে ঢুকতে যেন বাধা না পায়। তারচেয়েও বড় কথা ভারতের স্ট্যাটেজিক আমদানি (পেট্রোপণ্য, অস্ত্র ইত্যাদি) যেন আমেরিকা থেকে আসার পথ প্রশস্ত হয়। পেট্রোলিয়াম, প্রাকৃতিক গ্যাস এবং রান্নার গ্যাস চাহিদার ৮০ ভাগেরও বেশি ভারতকে আমদানি করতে হয়। এগুলি পশ্চিম এশিয়া, আফ্রিকা থেকে প্রধানত আসে। ইউক্রেন যুদ্ধের পর অত্যন্ত সস্তায় মেলায় ভারত রাশিয়া থেকে তেল আমদানি অনেকটা বাড়িয়ে দেয়। আবার ভারতের অস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জামের বড়টাই আসে রাশিয়া থেকে। হালে ইজরায়েল ও ইউরোপ-আমেরিকা থেকে অস্ত্র আমদানি বাড়লেও এখনো অর্ধেকই আসে রাশিয়া থেকে। ট্রাম্পের দাবি ভারত রাশিয়া থেকে তেল ও অস্ত্র আমদানি বন্ধ করুক বা একেবারে কমিয়ে ফেলুক। অর্থাৎ ট্রাম্প চাইছেন ভারত তেল ও অস্ত্রের ক্ষেত্রে আমেরিকা নির্ভর হোক। তেমনি ভারতের বাজারে মার্কিন পণ্য বাধাহীন হোক। এতে একদিকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনার অঙ্গ হিসেবে ভারতকে যেমন স্ট্যাটেজিকালি বেঁধে ফেলা যাবে তেমনি মার্কিন পণ্যের বাজার সম্প্রসারিত করে মার্কিন অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা যাবে। ট্রাম্প হিসেব কষেই ভারতকে টার্গেট করেছেন।
এতে ভারতের কোনও স্বার্থ নেই। বেশি দামে তেল, অস্ত্র কিনতে হবে আমেরিকা থেকে। মার্কিন কৃষি ও ডেয়ারি পণ্যের জন্য ভারতের বাজার খুললে ভারতের কৃষকদের ও ডেয়ারি ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত বিপুল মানুষের সঙ্কট তৈরি হবে।
চীনের সঙ্গে শত্রুতার সম্পর্ক বজায় রাখতে ভারত আমেরিকাকেই সঙ্গী হিসেবে চাইছে। তাই নিজের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে আমেরিকার স্বার্থ সুরক্ষায় মার্কিন প্রকল্পের অংশীদার হচ্ছে। বাণিজ্য চুক্তি এগোচ্ছে সেই পথেই, ট্রাম্পের ইচ্ছাপূরণ করেই।
Editorial
আত্মঘাতী পথ
×
Comments :0