বইকথা
নতুনপাতা
সামাজিক রাজনৈতিক ঘাত প্রতিঘাতের গল্প
রিঙ্কু দাস
১০ নভেম্বর ২০২৫, বর্ষ ৩
‘‘না সন্দীপ আমি নৈরাশ্যবাদী নই। আশার আলোকে আমিও পথ দেখতে চাই কিন্তু পথ কোথায় ? সেই পথের সন্ধান করছি আমি। সুবর্ণরেখাতে বলেছি, এই পৃথিবীর বাইরে একটি দিগন্ত আছে। কিন্তু সেই দিগন্ত আটকে বসে আছে কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ’’। কমলেশ্বর চৌধুরির এই ভাষ্য যে অযান্ত্রিক ঋত্বিকের, পাঠক নিজের অগোচরেই তা উপলব্ধি করবে। লেখক অমর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কাঁটাতারের বেড়া ও অন্যান্য গল্প’ গল্পগ্রন্থের এই উক্তিটি মুল গল্প ‘কাঁটা তারের বেড়া’র।
মোট ১১ টি গল্প নিয়ে এই গল্পগ্রন্থের নাম ‘কাঁটাতারের বেড়া’। এই গল্পে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের জন্ম শতবর্ষে ‘কমলেশ্বর’ চরিত্রের মধ্যে দিয়ে ঋত্বিকের প্রকাশ প্রকৃত অর্থে তার প্রতি শতবর্ষের শ্রদ্ধার্ঘ বলা যায়। এই গল্পে ঋত্বিক ঘটক সম্পর্কে নানা জানা অজনা কথা, দেশভাগ, বঞ্চনা, সামাজিক রাজনৈতিক টানাপোড়েন গল্পের অঙ্গিকে ফুটে উঠেছে । লেখক সামাজিক, রাজনৈতিক ঘাত প্রতিঘাতের সঙ্গেই ব্যক্তি জীবনে তার প্রতিফলনের মধ্যে গল্পগুলির সুর বেঁধেছেন। গ্রন্থের প্রথম গল্প ‘জাফর আলি ও একটি কুকুর’। এই গল্পে প্রবল আশঙ্কার পথ পেরিয়ে জাফর আলি বিশু সাঁপুইয়ের ঘরে মেয়েকে নিরাপদ দেখে যখন বলে ‘‘যা বেটি উই তোর বাপ’’ তখন ধর্ম বর্ণ সব বিভেদ ছাড়িয়ে গভীর মানবতা বোধের জন্ম দেবে পাঠকের মনে।
সব গল্পের শিরোনাম ধরে ধরে আলোচনা না করে পাঠকের অনুসন্ধিৎসু মনের কাছে ছেড়ে দেওয়া থাকলো। গল্পে যেমন আজকের দিনে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ভাবে রুপান্তরকামী মানুষের কথা প্রতিফলিত হয়েছে, ভিন্ন ভাবে তার মধ্যে দিয়ে এক যন্ত্রণার অভিব্যক্তি হয়। তেমনি ছিন্নমূল মানুষের মানসিক দ্যোতনা, ৭০ দশকের রাজনৈতিক টানাপোড়েন এবং সামাজিক অবক্ষয় ও বঞ্চনা বোধ থেকে অপরাধ জগতে প্রবেশ আবার বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অতিবাম বিচ্যুতির বার্তা গল্পের মধ্যে দিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন লেখক। গল্প ‘কোর্ট অ্যাডর্জনড’-এ মৃত মেয়েটির বিচারালয়ে উক্তি ‘‘না,আমি মরি নি’’ সাম্প্রতিক সময়ের বিভৎস ঘটনার প্রতিচ্ছবি যেন। অবশ্যই পাঠককূল কে ভাবাবেই। এই গল্পগুলির মধ্যে ‘কবি’ গল্পটি একটু ভিন্ন সমাজের, সাহিত্যরসিক পাঠকের অবশ্যই ভালো লাগবে। ‘পারুনামা’র মাইথোলজির চরিত্রগুলি এই সমাজের বিভিন্ন সময়কার নারীদের চারিত্রিক প্রতিফলন। ফলে পারু থেকে আজকের পার্বতী যে কোনও বিচ্ছিন্ন সত্বা নয়, তা অত্যন্ত সুন্দর ভাবে পারুর কাহিনীতে এঁকেছেন লেখক। গল্পগুলি বিষয়বস্তুর দিক থেকে ভিন্ন হলেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। গল্পের বুনটে প্রথাগত বাঁধুনি কোথাও কিছু কম থাকলেও গল্পগ্রন্থের সমগ্র বিষয়বস্তু সেই খামতি কমিয়ে দিয়েছে। গল্পের গভীরে প্রবেশ করতে গেলে অক্ষর,শব্দে আর বাক্যের পথ বেয়ে শেষ পর্যন্ত যেতে হবে পাঠককে। সমগ্র বুনটের মধ্যেই আসল অর্থ নিহিত আছে। খানিকটা ছোট ছোট ঢেউ পার করে ওপারে পৌছনোর মত। গল্পবইয়ের শিরোনামের সাথে মিলিয়ে প্রচ্ছদ একেছেন মনীষ দেব, যা বইয়ের প্রধান বিষয়বস্তুকে প্রতিফলিত করেছে। ভূমিকাটি লিখেছেন সাধন চট্টোপাধ্যায়। তিনি যথার্থই বলেছেন, লেখক মূলত আখ্যান রচনা করেন, কোরকের মধ্যে থাকে কাহিনীর আভাস।
শুধু ভৌগলিক কাঁটা তারের সীমারেখা নয়, নিজের সত্বা – অস্তিত্বের সমস্ত বাধা ডিঙিয়ে নিজেকে খোঁজার কথা তুলে ধরা হয়েছে গ্রন্থে। পাঠক মনে বইটি সারা ফেলবে।
কাঁটাতারের বেড়া ও অন্যান্য গল্প
অমর বন্দ্যোপাধ্যায়। অনুভব। ফ্ল্যাট নম্বর ৬৭, ৪৬/৩, চৌধুরী পাড়া রোড, কে এম ব্যানার্জি রোড, শহর-কলকাতা, উত্তর ২৪ পরগণা, ৭০০ ০৪৯। ২৯৯ টাকা।
Comments :0