Fake ST Certificate

ভুয়ো আদিবাসী শংসাপত্রে মেডিক্যালে ভর্তি, তদন্তের দায় এড়ালো অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দপ্তর

রাজ্য

দাগি শিক্ষকদের তালিকা নিয়ে তোলপাড় যখন রাজ্য তখন ভুয়ো আদিবাসী শংসাপত্র মারফৎ ডাক্তারি পাঠক্রমে ভর্তির অভিযোগ উঠল রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে। 
তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো, ভয়াবহ এই অভিযোগ সামনে আসার পর আদিবাসী শংসাপত্র আসল না নকল তা তদন্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্য দপ্তরের ওপর। অথচ এই দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত করার দায়িত্ব রাজ্যের অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দপ্তরের। তারা এখন স্বাস্থ্য দপ্তরের কাছে তদন্তভার তুলে দিয়ে ‘অ্যাকশান টেকেন রিপোর্ট’ চাইছে! রাজ্য প্রশাসনের এক শীর্ষ আধিকারিক জানিয়েছেন, ‘‘ শুধু আদিবাসী শংসাপত্রই নয়, একইভাবে তফসিলি জাতিরও ভুয়ো শংসাপত্রে ছেয়ে গেছে। আর প্রকৃত তদন্ত হলে এখানেও শিক্ষকদের মতোই দাগি উঠে আসবে শাসকদলের ঘর থেকেই। টাকার বিনিময়ে বিক্রি হয়েছে শংসাপত্র। প্রকৃত শিক্ষকদের মতোই এখানে বঞ্চিত আদিবাসী ঘরের সন্তানরা।’’ সরকারের তদন্তের ওপর ভরসা রাখতে না পেরে বঞ্চিত তিন আদিবাসী পড়ুয়া এদিন কলকাতা হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেছে। তাঁদের একজন অভিজিৎ সোরেন জানিয়েছেন,‘‘ আমরা এমবিবিএস’এ আদিবাসী সংরক্ষিত আসনে ভর্তি হতে পারিনি। কারণ আমাদের জন্য সংরক্ষিত আসন অন্যরা ঢুকে পড়েছে। আমরা তাই মামলার পথে যেতে বাধ্য হয়েছি।’’ 
রাজ্যের অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দপ্তর থেকে ৪৫ জন ডাক্তারি পড়ুয়ার নাম উল্লেখ করে স্বাস্থ্য দপ্তরের অধীন স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিকর্তার কাছে একটি তালিকা পাঠানো হয়েছে। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিকর্তার কাছে অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দপ্তরের যুগ্ম সচিব পর্যায়ের এক আধিকারিক চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, ‘‘২০২৫ সালের নিট (ন্যাশনাল  এলিজিবিলিটি কাম  এন্ট্রান্স টেস্ট) পরীক্ষায় নিয়ে রাজ্যের এক আদিবাসী সংগঠন জাল এসটি শংসাপত্র মারফত ভর্তি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে গোটা বিষয়টি তদন্ত করে দেখা দরকার।’’ একইসঙ্গে স্বাস্থ্য দপ্তর কী পদক্ষেপ গ্রহণ করছে তা অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দপ্তরের কাছে পাঠাতে বলা হয়েছে।
এই চিঠি হাতে পাওয়ার পর রাজ্যের সমস্ত মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযুক্ত পড়ুয়াদের নামের তালিকা পাঠানো হয়েছে। স্বাস্থ্য ভবন থেকে ইমেল মারফত মেডিক্যাল কলেজগুলির কাছে পাঠানো চিঠিতে জানতে চাওয়া হয়েছে, তালিকাভুক্ত ছাত্ররা যে আদিবাসী শংসাপত্র দিয়েছে তা যাচাই করে পাঠাতে। স্বাস্থ্য ভবন সূত্রের খবর, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ছয় জন, এনআরএস মেডিক্যাল কলেজে ৬ জন, ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে ৪ জন ও সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজের ১ পড়ুয়ার নাম আছে। মেডিক্যাল কলেজ সূত্রে জানা গেছে, যে ছয় জন ছাত্রের তালিকা আমাদের কাছে পাঠানো হয়েছে কাউন্সেলিং করার সময় তাদের আদিবাসী সার্টিফিকেট যাচাই অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দপ্তরের আধিকারিকরাই যাচাই করে দিয়েছেন। ফলে আমাদের কাছে স্বাস্থ্য ভবন যা চেয়েছে আমরা তা পাঠিয়ে দিচ্ছি।
রাজ্যের আদিবাসী কল্যাণ দপ্তরের এক শীর্ষ আধিকারিক জানিয়েছেন,‘‘ স্বাস্থ্য ভবন কীভাবে আদিবাসী সার্টিফিকেট আসল না ভুয়ো তা তদন্ত করবে? তাদের সেই তদন্ত কোনও এক্তিয়ারই নেই। বরং অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দপ্তরই শংসাপত্র ভুয়ো না আসল তা তদন্ত করে দেখতে পারে। সেজন্য যে সমস্ত জেলা থেকে শংসাপত্রগুলি এসেছে সেই জেলার অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দপ্তরে পাঠানো হলেই তা সঠিক হবে। মূলত সংশ্লিষ্ট জেলার এসডিও অফিসই খুঁজে বের করতে পারবে শংসাপত্রগুলি জাল না আসল।’’ কিন্তু তা না করে রাজ্য সরকার কেনও স্বাস্থ্য দপ্তরকে তদন্ত করার দায়িত্ব ছেড়ে দিল তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
আসলে এরাজ্যে বিশেষত দুয়ারে সরকার শিবির থেকে এসসি ও এসটি সার্টিফিকেট দেওয়া শুরু হওয়ার পর থেকেই জাল শংসাপত্র নিয়ে অভিযোগ সামনে আসতে শুরু করে। কিন্তু তখন মুখ্যমন্ত্রী সেই অভিযোগকে কোনওই আমলই দেননি। তিনি তখন ব্যস্ত সরকারের শিবির থেকে কীভাবে হাজারে, হাজারে শংসাপত্র বিলি হয়েছে তা হিসাব জানাতে। ২০১২ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত রাজ্যে এসসি ও এসটি মিলিয়ে প্রায় দেড় কোটি ছাপিয়ে গেছে শংসাপত্র বিলি। রাজ্যের অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দপ্তরের এক শীর্ষ আধিকারিক জানান,‘‘ আগে এসডিও অফিসে এসসি বা এসটি সার্টিফিকেটের জন্য কাগজপত্র দিয়ে আবেদন করতে হতো। সেই আবেদনের ভিত্তিতে নোটিস পাঠানো হতো আবেদনকারীকে। একইসঙ্গে দপ্তরের পক্ষ থেকে এলাকায় গিয়ে তদন্ত করার কাজও হতো। আবেদনকারীর সমস্ত তথ্য যাচাই করার পর এলাকা থেকে তথ্য যাচাই মিলিয়ে তারপর শংসাপত্র দেওয়া হতো।’’ কিন্তু গত এক দশকে সেই নজরদারি উধাও মানছেন আধিকারিকরাই। তাঁরা বলছেন, ‘‘ দুয়ারে সরকার শিবিরে এসে আবেদন করলে কোন সরকারি কর্মচারী তথ্য যাচাই করার ঝুঁকি নেবে। কিংবা আবেদনকারী বলবে, এসটি শংসাপত্রের জন্য এইসব নথি না হলে আবেদন নেওয়া যাবে না। ফলে যে আসছে তাকেই দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার অবধারিত প্রভাবে এখন প্রকৃত আদিবাসী সন্তানরাই বঞ্চিত হতে বসেছে।’’
সম্প্রতি নবান্নে রাজ্যের আদিবাসী কল্যাণ পর্ষদের বৈঠকে ভুয়ো আদিবাসী শংসাপত্র নিয়ে ডাক্তারি পাঠক্রমে ভর্তি অভিযোগ তুলে সরব হন রাজ্যের বনমন্ত্রী বীরবাহা হাঁসদা। গত সোমবার নবান্নে মমতা ব্যানার্জির উপস্থিতিতে রাজ্যের ট্রাইবাল অ্যাডভাইসরি বোর্ডের বৈঠকে ভুয়ো শংসাপত্র দিয়ে কীভাবে সংরক্ষিত আসন দখল হয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বনমন্ত্রী। ওয়েস্ট বেঙ্গল সিডিউল ট্রাইব ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন নামে এক আদিবাসী সংগঠন সরকারের কাছে ৪৫ জনের তালিকা তৈরি করে রাজ্য সরকারের কাছে অভিযোগ করে জানায়, আদিবাসী না হয়েও ভুয়ো এসটি শংসাপত্র দিয়ে ডাক্তারি পাঠক্রমে যুক্ত হয়ে গেছেন।

Comments :0

Login to leave a comment