গল্প — নতুনপাতা
অকালপ্রয়াণ, অমর বাণী—সুকান্তের শতবর্ষের আলোকগাথা
অরিজিৎ মিত্র
এ কোনও গল্প নয়, এক অন্য গল্প ---------
প্রভাতের আকাশে আজ এক অদ্ভুত মলিন আলো—যেন কুয়াশার আবরণে ঢেকে আছে শতবর্ষের স্মৃতি। কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ায় অজস্র পদচারণা, হাওয়ায় ছাপার কালি আর পত্রের গন্ধ। মঞ্চের একপ্রান্তে শোভিত সুকান্তের সাদাকালো প্রতিচ্ছবি—চোখে জ্বলন্ত দীপ্তি, ঠোঁটে দৃঢ়তার রেখা, যেন সময়ের দেয়াল ভেদ করে তিনি আজও দাঁড়িয়ে আছেন বিপ্লবের অগ্রভাগে।
ভিড়ের মধ্যে ধীরে ধীরে অগ্রসর অর্ণব—কৈশোরের চোখে অনাবিল বিস্ময়। সে পাঠশালার পাতা থেকে প্রথম চিনেছে এই অগ্নিকবি—যার কবিতায় রুটির জন্য ক্ষুধার্ত শিশু যেমন এসেছে, তেমনি এসেছে মুক্ত আকাশের স্বপ্ন। অর্ণবের মনে পড়ে—শিক্ষক বলেছিলেন, “কবিতা যদি ক্ষুধার পাশে দাঁড়াতে না পারে, তবে সে কেবল অলংকারমাত্র।” সুকান্ত এই সত্যকে রক্তে বুনেছিলেন।
সভা শুরু হলে প্রবীণ কবি মঞ্চে উঠে ধীরে উচ্চারণ করলেন—
“মাত্র উনিশ বসন্ত পেরিয়ে চলে গেছেন, তবু তাঁর কলমের কালিতে আজও রক্তের উষ্ণতা আছে। জানো, কাগজ না পেলে তিনি হাতের তালুতেই কবিতার বীজ বুনতেন। ১৫টি বসন্তের প্রারম্ভেই প্রথম কবিতা ছাপা হয়েছিল ‘সঞ্চয়’-এর পাতায়। ফুসফুসে যক্ষ্মার শ্বাসরুদ্ধ ক্ষণেও তিনি কলম নামাননি—বলেছিলেন, ‘এখনই তো সময়, আমি থেমে গেলে বিপ্লবের জবান বন্ধ হয়ে যাবে।’”
অর্ণব প্রদর্শনীতে গিয়ে স্পর্শ করল ‘ছাড়পত্র’-এর প্রথম সংস্করণের মলাট—পাতা উল্টোতেই যেন শোনা যায় কাশির দমক, টিমটিমে আলোয় টেবিলের পাশে বসে আছেন সুকান্ত, জানালার বাইরে যুদ্ধের অন্ধকার, আর ভিতরে কালি-রক্ত মিশে জন্ম নিচ্ছে শব্দের গোলা—
"রান্নাঘরে আজ অন্ন নেই, চুলোয় আগুন নেই,
তবু আমি স্বপ্ন দেখি মুক্তির রোদ্দুরের।"
এক প্রবীণ দর্শক ধীর কণ্ঠে বললেন—
“শেষদিকে পুরনো সংবাদপত্রের ফাঁকা প্রান্তেই কবিতা লিখতেন তিনি। মৃত্যুশয্যায় বন্ধুদের বলেছিলেন—‘আমার বইয়ের টাকা দিয়ে যদি পারো, ক্ষুধার্তের হাতে একমুঠো চাল দিও।’”
অর্ণবের মনে হল—ছবির ভেতর থেকে সুকান্ত যেন ফিসফিস করে বলছেন, “যদি শতবর্ষ পরে কেউ আমার কবিতা পড়ে ক্ষুধার্ত মানুষের কথা ভাবে, তবেই আমি বেঁচে আছি।”
ফেরার পথে আকাশে মেঘ জমেছে, কিন্তু অর্ণবের অন্তরে উজ্জ্বল সূর্যের আলো। তার কাছে আজ স্পষ্ট—অকালপ্রয়াণে শরীর বিলীন হলেও বাণী অবিনশ্বর হয়, যেমন নদীর উৎস শুকিয়ে গেলেও সাগরের ঢেউ থেমে থাকে না।
রাতে খাতার পাতায় সে লিখল—
“সুকান্তের কবিতা আমাদের হাতে সেই মশাল, যা ক্ষুধা, অবিচার ও অন্ধকারের গহ্বর ভেদ করে এগিয়ে চলে। শতবর্ষের এই প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখাই আমাদের উত্তরাধিকার।”
নতুন বন্ধু, নবম শ্রেণী, কল্যাণ নগর বিদ্যাপীঠ খড়দহ, উত্তর ২৪ পরগনা, কল্যাণ নগর খড়দহ।
Comments :0