Post Editorial

দেশ ও রাজ্য 'দেউলিয়া' হওয়ার পথে এগোচ্ছে

উত্তর সম্পাদকীয়​

শ্যামলকুমার মিত্র


২০১৩-১৪ অর্থবর্ষে (অর্থাৎ ৩১.০৩.২০১৪ পর্যন্ত) ভারত সরকারের উপর ৫৫ লক্ষ কোটি টাকার ঋণ ছিল। অর্থাৎ স্বাধীনতা পরবর্তী কেন্দ্র সরকারগুলি ৬৬ বছরে ৫৫ লক্ষ কোটি টাকা অর্থাৎ বছরে গড়ে ০.৮৩ লক্ষ কোটি টাকা হারে ঋণ নিয়েছিল। কেন্দ্র সরকারের অর্থমন্ত্রক গত ১ লা ফেব্রুয়ারি তথ্য দিয়েছিল ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষের শেষে দেশের মোট ঋণ ১৯৬ লক্ষ কোটি টাকা হবে। কিন্তু গত আগষ্টে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রক নতুন তথ্য দিয়ে জানিয়েছেন, ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে ভারতের মোট ঋণ ছিল ১৮৫ লক্ষ কোটি টাকা। ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষের শেষে অর্থাৎ আগামী ৩১ মার্চ, ২০২৬ এ ভারতের মোট ঋণ দাঁড়াবে ২০০ লক্ষ কোটি টাকায়। মোদী সরকার ১২বছরে ঋণ নিয়েছেন ১৪৫ লক্ষ কোটি টাকা, বছরে গড়ে ১২.০৮ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন মোদী সরকার। আগের সরকারগুলির থেকে বছরে গড়ে ১৪.৫৫ গুন বেশি ঋণ নিয়েছেন বর্তমান সরকার। গত আগস্ট মাস পর্যন্ত ভারতের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ৭৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (লং টার্ম বা ১ বছরের বেশি সময় ধরে মেটানো যাবে এমন বিদেশি ঋণ ৬০১.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, শর্ট টার্ম বা ১ বছরের মধ্যে মেটাতে হবে এমন বিদেশি ঋণ ১৩৪.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।) ,ভারতীয় মুদ্রায় ৬৫ লক্ষ কোটি টাকা। চলতি অর্থবর্ষে (৩১.০৩.২০২৬ পর্যন্ত) দেশি-বিদেশি ঋণ মিলিয়ে শুধু সুদ বাবদ খরচ হবে ১২ লক্ষ ৭৬ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের তুলনায় ১০.১% বেশি হারে বিদেশি ঋণ চলতি অর্থবর্ষে নিচ্ছেন সরকার। শুধু সুদ মেটাতেই যদি বছরে ১২ লক্ষ ৭৬ হাজার কোটি টাকা চলে যায়,আসল মেটাতে সরকারের আরও ঋণ নেওয়ার অতিরিক্ত কোনও পথ খোলা থাকে না। অর্থাৎ কেন্দ্র সরকার এমন একটা পরিস্থিতিতে দেশকে নিয়ে গেছেন যে আগের ঋণ,ঋণের সুদ মেটাতে নতুন করে ঋণ নিচ্ছেন সরকার, প্রতি বছর লাফিয়ে লাফিয়ে ঋণের অর্থাঙ্ক বাড়ছে। দেশ,আক্ষরিক অর্থে,'দেউলিয়া' হওয়ার দিকে এগোচ্ছে। ৫৬ইঞ্চি বুকের ছাতির স্বঘোষিত নন-বায়োলজিক্যাল বিশ্বগুরু' প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভক্তকুল যতই স্বপ্ন দেখুন ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হতে যাচ্ছে, শীঘ্রই দেশের অর্থনীতি ৫ ট্রিলিয়ন (লক্ষ কোটি) মার্কিন ডলারের মাইলফলক ছুঁতে চলেছে, রূঢ় বাস্তব হলো ও সব শুধুই গল্প, স্বপ্নে বিরিয়ানি রাঁধলে প্রচুর ঘি দেওয়াই যায়,ভারতের সামনে জলন্ত সমস্যা 'দেউলিয়া' হওয়া থেকে বাঁচা, 'ঋণের দুষ্ট চক্র' থেকে দেশকে বার করে আনা। কিন্তু একটা দেশ/রাজ্যের পক্ষে ঋণ নেওয়া কি অপরাধ? না, একেবারেই নয়। প্রশ্ন হচ্ছে কোন শর্তে কোন উৎস থেকে ঋণ আসছে এবং গৃহীত ঋণের অর্থ কেন্দ্র/রাজ্য সরকার কোন খাতে ব্যয় করছেন। সরকার বেপরোয়া গতিতে বিদেশি ঋণ নিচ্ছেন, সেই ঋণ কোন দেশ/বিদেশি সংস্থা কোন শর্তে, কত সুদে, কিসের বিনিময়ে দিচ্ছেন তা গোপন রাখছেন সরকার, তখনই তথ্য গোপনের প্রয়োজন পড়ে,যখন তথ্য প্রকাশে সরকার বিব্রত হতে পারে,প্রকাশিত তথ্যে শাসক দল ও সরকারের উপর জনরোষ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। দেশের অভ্যন্তরে কাদের থেকে, কোন শর্তে, কত সুদের হারে সরকার ঋণ নিচ্ছেন সে সংক্রান্ত তথ্যও অজানা। কিন্তু যে বিপুল অর্থ শুধু ঋণের সুদ মেটাতে(বছরে ১২ লক্ষ ৭৬ হাজার কোটি টাকা) খরচ হচ্ছে,তাতে অনুমান করাই যায় যথেষ্ট চড়া সুদেই ঋণ নিচ্ছেন সরকার। মোদীজীর কৃপায় প্রতিজন দেশবাসীর মাথার উপর ১ লক্ষ ৪২ হাজার টাকার দেনা। তাহলে দেশবাসীর জানার অধিকার আছে জানার, কোন প্রয়োজনে, কোন উৎস থেকে, কোন শর্তে, কত সুদে ঋণ নিচ্ছেন সরকার। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সরকার কোন খাতে গৃহীত ঋণ ব্যয় করছেন। উৎপাদন খাতে(productive sector) ,অর্থাৎ সড়ক, রেলপথ, বিমানবন্দর সহ পরিবহণ পরিকাঠামো, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও পরিবহণ, জলপথ পরিবহণের উন্নয়ন, জলাধার নির্মাণ ও সংস্কার, নদী ও সমুদ্র বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার, শিল্পে উৎসাহবর্ধক প্রকল্প, খনিজ উত্তোলন ও বিপণন, নতুন খনিজ ও তৈলক্ষেত্র সন্ধান ইত্যাদি কাজে ঋণের অর্থ ব্যবহৃত হলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে জোয়ার আসে, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়, শিল্প স্থাপন হয়— সবমিলিয়ে রাজকোষে বিপুল অর্থ আসে। সেই অর্থে সুদসহ ঋণশোধ করেও আবার উৎপাদন খাতে বিনিয়োগের জন্য ঋণ নেওয়ার সক্ষমতা বাড়ে, দেশে  অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসে। কিন্তু গৃহীত ঋণ দৈনন্দিন খরচ মেটানো, ডোল পলিটিক্সে দান-খয়রাতির মতো অনুৎপাদক খাতে(non-productive) ব্যয়িত হলে সমূহ বিপদ, কারণ এই সব খাতে বিনিয়োগ রাষ্ট্রকে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে কোনও অর্থনৈতিক উপযোগ দেয় না। ফলে ব্যয়িত ঋণ শুধুই ফিরতি উপযোগহীন খরচ হিসাবে 'দায়' হয়ে দাঁড়ায়। সুদসহ ঋণ শোধে কোনও সাহায্যই করতে পারে না এই অনুৎপাদক খাতে ব্যয়। ফলে গৃহীত ঋণ এবং সুদ মেটাতে রাষ্ট্রকে নতুন করে ঋণ নিতে হয়। রাষ্ট্র 'ঋণের দুষ্টচক্র' এ জড়িয়ে পড়ে। দুর্ভাগ্য এবং দুশ্চিন্তার বিষয় হলো সরকার গৃহীত ঋণের সিংহভাগ অনুৎপাদক খাতে ব্যয় করছেন যা দেশের স্বার্থ এবং অর্থনীতির পক্ষে যথেষ্ট বিপদের।                                                                   ২০১০-১১ অর্থবর্ষে রাজ্যের ঋণ ছিল ১,৯২,০০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ স্বাধীনতার পরবর্তী ৬৪ বছরে পূর্বতন সরকারগুলি ১,৯২,০০০ কোটি টাকা (বছরে গড়ে ৩,০০০ কোটি টাকা) ঋণ নিয়েছিল। এই ঋণের মধ্যে ৭৯,০০০ কোটি টাকা ছিল 'কেন্দ্রীয় স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্প' থেকে তৎকালীন নিয়মে বাধ্যতামূলক ঋণ। সে সময়ে মমতা বন্দোপাধ্যায় অর্থমন্ত্রী/মুখ্যমন্ত্রী থাকলে,তাঁকেও এই ৭৯,০০০ কোটি টাকার ঋণ স্বল্প সঞ্চয় থেকে নিতে হতো। অর্থাৎ স্বেচ্ছায় পূর্বতন সরকারগুলি ঋণ নিয়েছিল ১,১৩,০০০ কোটি টাকা। বাম আমলে তৎকালীন বিরোধী দল তৃণমূল কংগ্রেস ও নেত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় এই ঋণ গ্রহণের জন্য বাম সরকারের তীব্র সমালোচনা করে বলতেন,"এটা অপরাধ, রাজ্যটাকে বিপুল ঋণের বোঝায় শেষ করে দিয়েছে বাম সরকার।" ক্ষমতায় আসার পরই রাজ্যের নতুন অর্থমন্ত্রী তৎকালীন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের কাছে দাবি করতেন রাজ্যের এই ঋণ মকুব করতে হবে। সে সময় একটা শব্দ তৃণমূল নেতাদের মুখে মুখে শোনা যেত 'মোরাটোরিয়াম' অর্থাৎ ঋণ পুনর্গঠন করে তা মকুব করে দেওয়া ২০১৪ তে বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতার আসার সঙ্গে সঙ্গে তৃণমূল এ দাবি বিস্মৃত হয়। কারণটা তারাই ভালো বলতে পারবেন। ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষের রাজ্য বাজেট বিবৃতি অনুসারে ৩১.০৩.২০২৬ এ রাজ্যের ঋণ গিয়ে দাঁড়াচ্ছে ৭,৭১,৬৭০ কোটি টাকা। অর্থাৎ বর্তমান সরকার ১৪ বছরে ঋণ নিয়েছেন ৫,৭৯,৬৭০ কোটি টাকা। বছরে গড়ে ঋণ নিয়েছেন ৪১,৪০৫ কোটি টাকা। বছরে পূর্বতন সরকারগুলির থেকে ১৩.৮০ গুন বেশি হারে ঋণ নিয়েছেন তৃণমূল সরকার। বছরে গড়ে ৩,০০০ কোটি টাকার ঋণগ্রহণ, মমতা বন্দোপাধ্যায়ের ভাষায়,'অপরাধ' হলে,বছরে গড়ে ৪১,৪০৫ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া কি 'মহা অপরাধ' বলে বিবেচিত হবে? ২০২৪-২৫ (সংশোধিত) এবং ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষের বাজেট বিবৃতি অনুসারে সরকার ঋণ শোধ করেছেন যথাক্রমে ৭৭,২২৮ এবং ৮১,৫১০ কোটি টাকা। এ দুই অর্থবর্ষে রাজ্যের নিজস্ব আয় যথাক্রমে ৯৯,৮৬৩ এবং ১,১২,৫৪৩ কোটি টাকা। রাজ্যের উন্নয়ন, দৈনন্দিন খরচ সামলানোর জন্য রাজ্যের নিজস্ব আয়ের যথাক্রমে ২২,৬৩৫ এবং ৩১,০৩৩ কোটি টাকা পড়ে থাকছে। এই যৎসামান্য অর্থে তো রাজ্য চলবে না। এই সরকারি পরিসংখ্যান বলে দিচ্ছে রাজ্য সরকারকে রাজ্য চালানোর জন্য সম্পূর্ণ নির্ভর করতে হচ্ছে কেন্দ্রীয় অনুদান, বরাদ্দ এবং কেন্দ্রীয় করে রাজ্যের অংশের উপর। বেপরোয়া ঋণগ্রহণ এ রাজ্যকে সম্পূর্ণ রূপে কেন্দ্র সরকারের উপর নির্ভরশীল করে তুলেছে যা পশ্চিমবঙ্গের সম্মান, মর্যাদা ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। এ কারণেই মমতা বন্দোপাধ্যায় ও তাঁর দল মুখে বিজেপি বিরোধিতার কথা বললেও, বাস্তবে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে বিজেপি র 'বি-টিম' হিসাবে কাজ করতে বাধ্য হন। কথায়  আছে,"Beggers may not be the chooser."আতঙ্কের বিষয়, রাজ্য সরকারও কেন্দ্রের মতো গৃহীত ঋণের সিংহভাগ অনুৎপাদক(non-productive sector) খাতে ব্যয় করে রাজ্যকে 'ঋণের দুষ্টচক্র' এ ফাঁসিয়ে দিয়েছেন। ফলে আগের ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধ করতে প্রতি বছর আগের বছরের থেকে বেশি অর্থাঙ্কে ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছেন। আরো আতঙ্কের বিষয় রাজ্য ঋণের একটা বড় অংশ নিচ্ছেন অত্যন্ত চড়া সুদে খোলা বাজার থেকে। ফলে ঋণের সুদ বাবদ অনেক বেশি অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। রাজ্য সরকারও মোদী সরকারের মতোই ঋণের সমস্ত তথ্য গোপন রেখেছেন, কারণও ঐ একই। তথ্য প্রকাশ্যে এলে সরকার ও শাসক দলের প্রতি জনরোষ তৈরি হবে। রাজ্য প্রতি জন রাজ্যবাসীর উপর ৭২,০০০ টাকার দেনা ইতিমধ্যেই চাপিয়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ কেন্দ্র-রাজ্য মিলে পশ্চিমবঙ্গের সদ্যোজাত প্রত্যেক শিশুর উপর (১,৪২,০০০+৭২,০০০) ২,১৪,০০০ টাকার দেনা চাপিয়ে দিচ্ছেন তাদের অজান্তেই। ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে সকলকে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে(ধনীদের সত্যিই সরকারি দানের কোনও প্রয়োজন নেই) সরকারি অর্থ, সুবিধা, প্রকল্প পাইয়ে দিয়ে শাসক দল অনুকুল ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করার দলীয় রাজনৈতিক লক্ষ্যে 'ডোল পলিটিক্স' করছেন মমতাদেবী, আর সেজন্য বেপরোয়া গতিতে চড়া সুদে বিপুল অঙ্কের ঋণ নিয়ে রাজ্যটাকে একদিকে
কেন্দ্র সরকারের' উপনিবেশ ' বানিয়েছেন, অন্যদিকে রাজ্যটাকে, আক্ষরিক অর্থে, 'দেউলিয়া' হওয়ার পথে দ্রুত গতিতে পৌঁছে দিচ্ছেন। যেভাবে প্রতি বছর আগের বছরের থেকে বেশি অর্থাঙ্কে ঋণ করছেন সরকার, যেভাবে সুদসহ ঋণ শোধে খরচ প্রতি বছর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, তাতে বলাই যায় অদূর ভবিষ্যতে রাজ্যের নিজস্ব আয়ের সবটুকু দিয়েও সুদসহ ঋণশোধের মতো অর্থ থাকবে না, কেন্দ্র থেকে প্রাপ্যে সুদ ও ঋণ শোধ করতে হবে। শ্রীলঙ্কাসহ অন্য একাধিক দেশ এর থেকে অনেক কম ঋণের বোঝায় 'দেউলিয়া' হয়েছে। বিজেপি ও তৃণমূলের নেতা/নেত্রীদের সচেতন ও দেশ এবং রাজ্য প্রেমী অংশ, বিরোধি রাজনৈতিক দলগুলি, নাগরিক সমাজ, কুম্ভকর্ণের নিদ্রায় থাকা বুদ্ধিজীবীরা এবার অন্তত এই বেপরোয়া ঋণগ্রহণ প্রবণতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন, নাহলে সত্যি বড় দেরি হয়ে যাবে। 
 

Comments :0

Login to leave a comment