BOOK — PRASUN BHATTACHARJEE — AKASHBANI — MUKTADHARA — 16 SEPTEMBER 2025, 3rd YEAR

বই — প্রসূন ভট্টাচার্য — তরঙ্গে অন্তরঙ্গে বেতারকাহিনী — মুক্তধারা — ১৬ সেপ্টম্বর ২০২৫, বর্ষ ৩

সাহিত্যের পাতা

BOOK  PRASUN BHATTACHARJEE  AKASHBANI  MUKTADHARA  16 SEPTEMBER 2025 3rd YEAR

বইমুক্তধারা 

 

ইলা ও গোদাবরী : একই নৌকার যাত্রী

সুবিনয় মিশ্র

১৬ সেপ্টম্বর ২০২৫, বর্ষ ৩তরঙ্গে অন্তরঙ্গে বেতারকাহিনী

 


একবিংশ শতাব্দীর এক পঞ্চমাংশ পার করে আসার পরে রেডিও নিয়ে আলোচনার একটা সমস্যা হলো, বিষয়টির সঙ্গে কেউ অনেকটাই পরিচিত, কেউ অর্ধপরিচিত, কেউ বা পুরোপুরি অপরিচিত। যারা বয়সে প্রবীণ তাঁরা নস্টালজিক হয়ে অনেক কথা বলতে পারেন, আবার এখনকার কলেজ পড়ুয়াদের কেউ কেউ বলতে পারে রেডিও সেট চোখেও দেখেনি। তারাই কিন্তু মোবাইলে এফএম রেডিও চ্যানেল শোনায় রীতিমতো অভ্যস্ত।
বই, সংবাদপত্রের মতো মুদ্রণমাধ্যমকে যদি প্রথম প্রজন্মের গণমাধ্যম বলা যায়, তাহলে শ্রবণমাধ্যম রেডিও হলো দ্বিতীয় প্রজন্মের। ভারতে যার যাত্রা শুরু ১৯২৩ সালে, তারপরে নানা চমকপ্রদ ঘটনাবহুল পথে তার অগ্রগতি। ‘তরঙ্গে অন্তরঙ্গে: কলকাতা বেতারের উপকথা’ বইটিতে লেখক সুতীর্থ দাশ আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে তার বিবরণ দিয়েছেন। বলা ভালো, রসিয়ে গল্প বলেছেন। তবে নামকরণেই তিনি দুটি বিষয় স্পষ্ট করে দিয়েছেন। প্রথমত, এই বইতে তিনি মার্কনি সহ বিজ্ঞানীদের হাত ধরে রেডিও তরঙ্গের প্রযুক্তির উন্মেষ থেকে শুরু করে বর্তমানের এফএম রেডিওর কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু যথার্থই বইয়ের নামে তিনি বলেছেন, ‘কলকাতা বেতারের উপকথা’। কারণ রেডিও’র আন্তর্জাতিক ইতিহাস তিনি এই বইতে লেখেননি, এমনকি ভারতের অন্য বেতারকেন্দ্রগুলির ইতিহাসও নয়, কলকাতা রেডিও স্টেশনের বিবর্তনের ধারাকে তিনি সযত্নে তুলে ধরেছেন।
দ্বিতীয়ত, গোড়ায় খটকা লাগছিল বইয়ের নামে উপকথা কেন? কেন ইতিহাস নয়? পড়তে পড়তেই বোঝা গেল, লেখক গল্প বলার ভঙ্গিতে স্বাধীনতা চেয়েছেন, কাল্পনিক কথোপকথন এমনকি কাল্পনিক চরিত্রের সৃষ্টির মধ্য দিয়েও লেখক ইতিহাসের বিবরণ হাজির করেছেন। নীরস প্রামাণ্য দলিল তৈরি করেননি। তা বলে ইতিহাস বিচ্যুতির অভিযোগ তোলারও উপায় নেই। ভারতে রেডিও’র ইতিহাস বলে স্বীকৃত দলিলগুলি থেকেই তথ্যগুলি সংগ্রহ করা হয়েছে। এমনকি যেখানে সংশয়, সেখানে সেটাও রাখার চেষ্টা করেছেন লেখক। নিঃসন্দেহে এটা যদি লেখকের গবেষণাধর্মীতা হয় তবে এই বইতে তাঁর আসল মুনশিয়ানা কিন্তু গল্প বলার ঢঙে। লেখক নিজে দীর্ঘদিন এফএম রেডিও’তে কাজ করেছেন, তাই রেডিও’র অন্দরমহলের টানাপোড়েন, আবহাওয়া সম্পর্কে তিনি অবহিত। সেই সব মাথায় রেখেই তিনি ‘রেডিও ফিচার’ ফরম্যাটে গল্প বলেছেন কলকাতা বেতার কেন্দ্রের। মাস কমিউনিকেশনের ছাত্রছাত্রীদের তো বটেই, এমনকি সাধারণ আগ্রহী পাঠকদের টেনে রাখার মতো এই বই।
আকাশবাণী যে সরকারি প্রচারমাধ্যম তা সবাই জানে। বর্তমানে তা প্রসার ভারতীর অধীনে স্বশাসিত। কিন্তু রেডিও ভারতে যাত্রা শুরু করেছিল বেসরকারি গণমাধ্যম হিসাবেই। কলকাতা বোম্বে মাদ্রাজে রেডিও ক্লাব তৈরি হয়েছিল, সেই ক্লাবের সদস্যরা চাঁদা দিয়ে রেডিও’র অনুষ্ঠান, মূলত গান শুনতে পারতেন। ছাপাখানার তুলনামূলক সহজসরল প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভারতীয় শিক্ষিত ব্যক্তিত্বরা সংবাদপত্র প্রকাশ করেছিলেন, তাঁরা সংবাদপত্রের শক্তিও বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু রেডিও’র প্রযুক্তি ও শক্তি তখনও তাঁদের নাগালের বাইরে ছিল। ইউরোপের অভিজ্ঞতায় ব্রিটিশরা কিন্তু প্রচারমাধ্যম হিসাবে রেডিও’র শক্তি বুঝতে পেরেছিল। তাই রেডিও ক্লাবগুলি যখন দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে, তখন ব্রিটিশ সরকার এগিয়ে এসে সেগুলিকে সরকারি মাধ্যম হিসাবে হাতে নিয়ে নেয়। রেডিও ক্লাব, ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি হয়ে ১৯৩০ সালে ব্রিটিশ সরকারের মালিকানাধীন হয় ভারতীয় বেতার, ১৯৩৬ সালে তার নামকরণ হয় ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’। ‘তরঙ্গে অন্তরঙ্গে’ বইতে এই সময়ের রেডিওর উত্থানপতন, জনপ্রিয়তা, আর্থিক লোকসান ইত্যাদির বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে।
রয়েছে নানা চমকপ্রদ কাহিনিও। অল ইন্ডিয়া রেডিও’র আকাশবাণী নামকরণের প্রচলিত ধারণা যাই হোক, এই নামকরণ রবীন্দ্রনাথ করেননি, তবে রবীন্দ্রসঙ্গীতের থেকেই এই নামকরণের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করা আছে বইতে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে রেডিও’র সম্পর্ক নিয়েও অনেক কথা রয়েছে। মাধ্যম হিসাবে রেডিও’কে নাকচ না করলেও রবীন্দ্রনাথের সন্দিহান থাকার নজির উল্লেখিত আছে, রেডিও’র জন্য কীভাবে রবীন্দ্রনাটক সম্প্রচারিত হয়েছিল সেই চমকপ্রদ কাহিনিও আছে। কেন রেডিও’র সঙ্গীতে দীর্ঘদিন হারমোনিয়াম ব্যবহৃত হতো না, শেষপর্যন্ত ১৯৮০ সালে তার অনুমতি দেওয়া হয় সেই গল্পও বলা হয়েছে। ১ নম্বর গার্স্টিন প্লেসের বেতার কেন্দ্রের নানা কাহিনী পাঠকের মন কাড়ার মতো। অনেক কিছুই অনেক জায়গায় প্রকাশিত, সেগুলি লেখক এক জায়গায় করে পরিবেশন করেছেন। সবক্ষেত্রে কালানুক্রমিক তা অবশ্য নয়।
১৯৭৬ সালের মহালয়া’র কাহিনি বহুচর্চিত ও প্রচারিত। সেবার মহালয়ায় নতুনত্ব আনতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের স্তোত্র পাঠের বদলে উত্তমকুমারকে দিয়ে মহালয়া করানোয় আকাশবাণী কলকাতা বিরাট বিক্ষোভের মধ্যে পড়েছিল। ষষ্ঠীর ভোরে ফের বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের পরিচিত মহালয়া ফিরিয়ে এনেছিল আকাশবাণী। এখনও সেই ধারাই বজায় আছে। এছাড়াও রেডিও সম্প্রচারের প্রসারণ, ভৌগোলিক এলাকা ও ভাষার নানা অনুষ্ঠানে, ক্রীড়া ধারাবিবরণী, সংবাদ, কমার্সিয়াল প্রচারের জন্য নতুন বিবিধভারতী চালু ইত্যাদি নানা কথা উঠে এসেছে বইটিতে। এরমধ্যে ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকার উল্লেখ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কীভাবে পত্রিকাটি চালু হয় এবং তা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে তা অবশ্যই রেডিও’র ইতিহাসের অংশ। ১৯২৯ সালে বেতার জগৎ প্রকাশিত হয় সাহিত্যিক প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর সম্পাদনায়। বেতার জগৎ যাতে বিক্রি হয় তার জন্য রীতিমতো পরিশ্রম করেছিলেন সঞ্চালক হিসাবে খ্যাতি অর্জন করা বীরেন রায় (যার নামে বেহালার রাস্তা বীরেন রায় রোড)। এমনকি, রাস্তায় হকারদের মতো পত্রিকা বিক্রির কাজও নাকি করেছেন।
‘তরঙ্গে অন্তরঙ্গে’ বইতে লেখক কলকাতা বেতার কেন্দ্রের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। রেডিও নামক গণমাধ্যমের পরিচালন অর্থনীতিতে আটের দশক পর্যন্ত রেডিও সেট রাখার জন্য গ্রাহকদের যে লাইসেন্স ফি দিতে হতো পোস্ট অফিসের মাধ্যমে সেকথাও উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সবকিছু দুই মলাটে ধরতে পেরেছেন এমন দাবি কোনও লেখকই করতে পারেন না, এখানেও করা সম্ভবও নয়। সামগ্রিকভাবে রেডিও’কে সরকারি দলের প্রচার যন্ত্রে পরিণত করা, এমার্জেন্সির সময়ের অপব্যবহারের নমুনা ইত্যাদি বেশ কিছু দিক আরও একটু থাকলে ভালো হতো বলে পাঠকদের মনে হতেই পারে। যারা আকাদেমিক চর্চা করেন তাঁরা ডেভেলপমেন্ট কমিউনিকেশন বা উন্নয়ন জ্ঞাপনে এখনকার রেডিও’র ভূমিকা নিয়ে কিছু প্রত্যাশা করে বিফল হতেও পারেন। আবার বেতারের কাহিনী চলতি বাংলায় বর্ণনার মাঝে কথোপকথনে হঠাৎ সাহেবদের মুখের সংলাপগুলি ইংরেজিতেই উল্লেখের যুক্তি নিয়েও কারো মনে প্রশ্ন জাগতে পারে। কিন্তু বইটি সাধারণভাবে সুখপাঠ্য তা অস্বীকারের কোনো উপায় নেই।
একবিংশ শতাব্দীতে এসে টেলিভিশন আর ইন্টারনেটের দাপটে শুকিয়ে যাওয়া রেডিও আবার এফএম চ্যানেলের মাধ্যমে জনপ্রিয় হয়েছে। লেখক নিজে বেসরকারী এফএম চ্যানেলে কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। তাই এফএম প্রযুক্তিতে উত্তরণের কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিক এফএম চ্যানেলগুলির অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার গল্পও শুনিয়েছেন। খানিকটা আবেগও প্রকাশ পেয়েছে।
সাধারণ বইয়ের থেকে আকারে সামান্য ছোটো আকারের ২২০ পৃষ্ঠার বইতে পৃষ্ঠা ও ছাপার গুণমান প্রশংসাযোগ্য। রেডিও’র মতো গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যমকে চেনা ও জানার জন্য এমন বইকে কাজের বললে একটুও অত্যুক্তি হবে না।

তরঙ্গে অন্তরঙ্গে: কলকাতা বেতারের উপকথা।  সুতীর্থ দাশ।  তবুও প্রয়াস। ৪০০টাকা।

Comments :0

Login to leave a comment