বনবাণী ভট্টাচার্য
ওরা গাজায় সংসার করছিল ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের আগে থেকেই হয়তো। পত্রিকায় ছবি, হাসিমুখে স্ত্রী, হাদিল কে এল সাবাখির সঙ্গে বছর ২৭-এর আবদেল রহমান এস জে আবু তাখিয়া। সংঘর্ষ বিরতিতে গাজার উচ্ছ্বাস অকল্পনীয়, সীমাহীন আনন্দে উদ্বেল গাজার মানুষ— তার সাথে আছে স্বজন হারানোর গভীর বেদনা। ঐ তো, ২০২৪-এর ফেব্রুয়ারি মাসে হাদিল হারিয়েছে ওর প্রিয় কাকাকে— আবদেল ও তো প্রিয়জন বিয়োগে বেদনা-বিধুর। দু’বছর ধরে আগুন আর ধ্বংসের মধ্যে চলছে ওদের বেঁচে থাকার চেষ্টা। ক্ষুধা-পিপাসা ড্রোন আর অনবরত বোমা বর্ষণের মধ্যে ওরা সবাই শ্বাস প্রশ্বাস চালিয়েছে। আজ যখন আকাশটা আকাশের মতো, বাতাসে বারুদের গন্ধ মিলিয়ে গেছে, তখন আবদেল হাদিলদের মতোই আরও কতজন আবার ঘর বাঁধা-সংসার করার স্বপ্ন দেখতে পারছে। কত আপনজনের লাশে মাটি দিয়ে-ত্রাণ শিবিরে হারিয়ে ফেলে, স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবার মরিয়া চেষ্টা ওদের— ওদের ঘর নেই- সঞ্চয়ও গেছে ফুরিয়ে। বাঁচার জন্যে সব আগে ওদের কাজ খুঁজে নিতে হবে। তবু ওরা বাঁচবে- ভাঙা বুকের পাঁজর দিয়েই ওরা গড়বে ওদের ভেঙে যাওয়া সংসার। আর নিরুচ্চারে শিশুর কলকাকলি ভরা গাজার বসতি বলবে ইজরায়েলকে, বলবে পৃথিবীর অধিপতিদের— ‘‘ভাই মরিনি তো, আমাকে মারতে পারলে কই?’’
এই প্রশ্ন তো আমার, আমি প্যালেস্তাইন, ভূমধ্য সাগরের তীরে, ৫০০০ বছরের প্রাচীন জলপাই গাছ বুকে করে, জলপাই চাষ করে ১লক্ষ পরিবারের রুজির সংস্থান জেরুজালেমের দিকে তাকিয়ে আছি আমি রক্তাক্ত-ক্ষতবিক্ষত প্যালেস্তাইন। ইহুদিদের বিরুদ্ধে আমার কোনও বিদ্বেষ নেই— আমাদের জেহাদ আগ্রাসী ইজরায়েল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। আমাদের ঘৃণা জায়নবাদের বিরুদ্ধে, যারা পবিত্র ধর্মের নামে, রক্তে পিপাসা মেটায়। কিন্তু ইভাইজমের বিরুদ্ধে নয়। আমি প্যালেস্তাইন, মানুষের অধিকারে দানবের থাবাকে ভয় করি না- বশ্যতা মানি না। আমরা ক্ষমতার মুখে পদাঘাত করে বেঁচে আছি এখনও। ১৭৫০ বছর ধরে আমার পরিচিতি। আমি দেখেছি ক্ষমতার আসুরিক শক্তির ফল। ইহুদিদের জন্যে করুণা হয়— আমাদের সমবেদনা আছে। ফ্যাসিস্ত হিটলার দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ৬০ লক্ষ ইহুদি হত্যা করেছে শুধু সেজন্যে নয়। ক্ষমতা আর আধিপত্যের লাগামহীন নেশা ওদের যুগযুগ ধরে ঠিকানাহীন করেছে। মিশরর ক্ষমতাসীন প্রভু মসনদ হারাবার ভয়ে সদ্যোজাত শিশুদের হত্যার পরেও ইহুদিদের বিতাড়িত করেছে। রোমান সাম্রাজ্যও ১৩২-১৩৬ খ্রিস্টাব্দ জুডিয়া অঞ্চল থেকে শুরু করে সংলগ্ন সমস্ত জায়গা থেকে ইহুদি হত্যা ও উৎখাত করে কি জনশূন্য করেনি জুডিয়া প্রদেশগুলিকে? রোমান শাসকদের ক্ষমতা যেমন ওদের ছিন্নভিন্ন করে দেশ দেশান্তরে তাড়িয়ে নিয়ে যাযাবর জীবনে বাধ্য করেছে, তেমনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অনুগ্রহেই ইহুদিদের ‘হোমল্যান্ড ও লাভ হয়েছে, প্যালেস্তাইনের বুকেই ওদের ১৯৪৮ সালে ইজরায়েল রাষ্ট্র হলো, যার স্বীকৃতি দিল আর এক ক্ষমতাবান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। শুধু ক্ষমতাবানদের অন্যতম নয়, এধরায় সর্বশক্তিমান।
এতো সকলেই জানে মধ্য প্রাচ্যের আরব দুনিয়া, আরবী ঘোড়ার মতোই ঘাড় বাঁকা। সাম্রাজ্যবাদীরা মনে করে, এরই বুকের তলায় লুকিয়ে আছে বিশ্বশাসনের আয়ূধ পেট্রলের স্রোতে— নানা খনিজের ভাণ্ডারে। অথচ প্রবল পরাক্রান্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরব বিশ্বে একটা ‘ইয়েস ম্যান’ বা তাঁবেদার রাষ্ট্র খুঁজে পেয়েছিল না। তাই ১৯১৭ সালে, ইহুদি বিজ্ঞানী ওয়েজম্যানের ইচ্ছে ‘‘অ্যাল্যান্ড ফর মাই পিপল’’কে সম্মান জানিয়ে, ১৯৪৭ সালে প্যালেস্তাইন ভূমির ৫৫ ভাগ সংখ্যালঘু ইহুদিদের দিয়ে পরে ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা আর সংখ্যাগুরু প্যালেস্তিনীয়দের জন্যে খেটোয় ভরা সামান্য জমির বরাদ্দ, যা ১৯৪৮ থেকে ইজরায়েল আজ পর্যন্ত ক্রমাগত দখল করে চলেছে— অথচ প্যালেস্তিনীয়রাই নিজভূমে পরবাসী হয়ে থাকল আর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ পেল তার পশ্চিম এশিয়ার ‘ওয়াচডগ’ ইজরায়েল প্রধানদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ক্রীতদাস বেঞ্জামিন নেতানেয়াহুকে।
একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে গাজা। একটু বুক ভরে বাতাস নিতে পারছে প্যালেস্তাইনের সাথে সারা মানববিশ্ব, গণহত্যাকারী ইজরায়েলের বন্ধু-দুনিয়া বাদে—একটা যুদ্ধ-বিরতি হয়েছে। মহামহিম ট্রাম্প, যিনি বিশ্বশান্তির জন্যে সদাই ব্যাকুল(?) অনেক কষ্টে-সৃষ্টে ইজরায়েল-হামাস ও প্যালেস্তাইন-প্রতিনিধি কাতার-তুরস্ক ও মিশরকে নিয়ে কায়রোয় বৈঠক করে ২০ দফা পয়েন্টের এক শান্তি প্রস্তাব পেশ করেছেন যার ফল বর্তমান সংঘর্ষ বিরতি।
বিশ্ববাসী! আপনারা বলুন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই শান্তি প্রস্তাবের মর্মবস্তুতে কার কল্যাণ? কার পৌষমাস আর কার সর্বনাশ? এ কি শান্তি জল না, ষড়যন্ত্রের জাল? ইজরায়েল গাজা স্থায়ী ও পূর্ণ দখলের ব্লুপ্রিন্টের আর্ন্তজাতিক বৈধতা অর্জনের ধূর্ত কৌশল নয়? এই নেতানেয়াহুর ইচ্ছেপূরণ, থুড়ি আ-বিশ্ব-অবধি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পশ্চিম এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তার ও গাজাকে উন্নত দেশগুলির বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত করার সুচতুর পরিকল্পনা। শান্তি প্রস্তাবের মূল কাঠামোটাই তৈরি করা হয়েছে— প্যালেস্তাইনকে বিশ্ব মানচিত্র থেকে মুছে ফেলা এবং ইজরায়েলের কুশলে ট্রাম্পের কুশল নিশ্চিত করা। ইজরায়েল ছাড়া, আরব দুনিয়ায় তো মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পা ফেলার এক সূচাগ্র জমি নেই। আমি প্যালেস্তাইন, আমি তো অন্যের উপরে কর্তৃত্ত্ব করতে চাই না, বৈভব চাই না, অনেক প্রবঞ্চনার পরেও, ১৫৬টা দেশের স্বীকৃতি নিয়ে যে স্বাধীন ভূমিতে আমার অস্তিত্ত্ব আমার সার্বভৌমত্ব, সেইটুকুই আমি রক্ষা করতে চাই—আমি কারোর দাসত্ব করি না- তাই আমার লড়াই। প্রস্তাবের বিস্তৃত ব্যাখ্যায় না গিয়েও বলুন তো এ কেমন স্বাধীনতা, কেমন সার্বভৌমত্ব, যেখানে গাজা-প্যালেস্তাইন শাসন করার অধিকার তাদের নয়, আর্ন্তজাতিক বিশেষজ্ঞ ও অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়ে একটি অস্থায়ী অন্তর্বর্তীকালীন কমিটি চালাবে বোর্ড অব ডিরেক্টর্স যার একজন সদস্য অবশ্যই প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধান মন্ত্রী টনি ব্লেয়ার। যিনি হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র বলে খ্যাত এবং তারও মাথায় থাকবেন মূর্তিমান ‘ধ্বংস’ ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিশ্ব বিবেক কি এই ‘অ্যাক্সিস অব এ ভিলস’ দিয়ে শান্তি নেমে আসবে বলে বিশ্বাস করে? একেই মৎস্য-লোভী মার্জারকে মাছ পাহারায় রাখার বন্দোবস্ত বলে তো? নেহাতই, নোবেল শান্তি পুরস্কারের লোভ আর বিশ্ব জনমতের চাপেই তো এই শান্তি প্রস্তাবের বাহানা?
গাজা প্রসঙ্গের এই বোর্ড অব পীসের প্রধান রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পই তো বিশ্বে শান্তি রক্ষা করছেন, কখনও ইউক্রেন-রাশিয়া, কখন ইজরায়েল-ইরান, কখনও লিবিয়া-সিরিয়া, কখনও ভারত-পাকিস্তান, যুদ্ধ বাঁধিয়ে, তারপর মোড়ল হয়ে আপাতঃ যুদ্ধ থামানো। ভারতের অপারেশন সিঁদুরের কথা সগর্বে তিনি অন্তত পঞ্চাশবার বলেছেন। তারই তো বিশ্বশান্তি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার কথা। কিন্তু যা হোক হয়নি তা। মন খারাপ চটে আছেন।
এরকম যুদ্ধ ব্যবসায়ীর নির্দেশে আজকের এই সংঘর্ষবিরতির আয়ু কতদিনের? অতীতে ইজরায়েলের রেকর্ড তো ভালো নয়, বারে বারে তারা চুক্তি লঙ্ঘন করে আক্রমণ করেছে। বিশিষ্ট ধূমপায়ী রাজনীতিক ও সাহিত্যিক স্যার ওয়াল্টার র্যা লে নাকি বলতেন সিগারেট ছাড়া খুব সোজা, তিনি তো কতবার ছেড়েছেন। অর্থাৎ যতবার ধূমপান ছেড়েছেন ততবারই আবার তা শুরু করেছেন। আর এবার তো কথাই নেই— বোর্ড অব পীসের প্রধান, ট্রাম্প শান্তি প্রস্তাব পেশের সময় রাষ্ট্রসঙ্ঘকে ‘ফালতু’ বলে অশ্রদ্ধা করেছেন এবং তার তল্পিবাহক নেতানেয়াহুর মন্তব্য, প্যালেস্তাইনকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দান সন্ত্রাসবাদকে পুরস্কার দেওয়ার সমান। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সংগঠনকে অসম্মান এবং শান্তিপ্রিয় ১৫৬টি দেশকে প্রকারন্তরে সন্ত্রাসবাদী বলে চিহ্নিত করার এই ঔদ্ধত্য ও স্পর্ধায় বিশ্ব বিবেকের নীরবতাও কম অপরাধ নয়, মানবিকতার দিকে থেকে।
পৃথিবীর সারা শরীর জুড়েই আধিপত্যকামীদের মুনাফাখোরেদের ক্ষত। সভ্যতা উপনিবেশের যুগ কাটাবার পরও সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বায়ন/উদারবাদ/ফিন্যান্স পুঁজির মুখোশে উপনিবেশবাদীর চরিত্র ও মেজাজ ধরে রেখেছে। আর তারই মধ্য দিয়ে দক্ষিণপন্থী ফ্যাসি অর্থনীতির স্রোতে ফ্যাসিবাদ তার স্বার্থের রণতরী ভাসিয়ে দিতে চাইছে। কিন্তু বিশ্ব পরিস্থিতির আজকের মতো দুর্দিনের অন্ধকার অতীতে ঘনিয়ে আসেনি যে, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সম্মান নোবেল শান্তি পুরস্কার তুলে দেওয়া হলো ভেনেজুয়েলার সেই বিরোধী নেত্রী মারিয়া কোরিণা মাচাদোর হাতে, যিনি ইজরায়েলের গাজা-গণহত্যার সমর্থক এবং বিশ্বশান্তির সব থেকে বড় শত্রু ডোনাল্ড ট্রাম্পের হয়ে যিনি এই পুরস্কার গ্রহণ করেছেন। তিনি ঘোষিত কমিউনিস্ট বিরোধী। কমিউনিস্টরা তার শত্রু, কিন্তু তিনি কি মানবতার মিত্র এবং রক্ষক হতে পারেন যিনি বিশ্বশান্তি ও মানবতার সংহারক, সেই ট্রাম্পকে তার পুরস্কার উৎসর্গ করেছেন? ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী শুল্কের চাপে গোটা পৃথিবীকে শ্বাসরুদ্ধ করে চলেছেন যিনি, তারই বন্ধু ও অনুগামী কিভাবে শান্তির দূত হয়ে বিশ্বে শান্তির বারি সিঞ্চন করবেন?
তবে, আমি প্যালেস্তাইন, সুদীর্ঘ মুক্তি সংগ্রাম চালিয়ে আমি বিশ্বাস করি মানবতার মৃত্যু নেই, নেই শান্তি-সংহতির প্রয়াসের অবসান। তাই, গণহত্যাকারী ইজরায়েলের বিপরীতে মার্কিন সঙ্গী ইউরোপীয় দেশগুলি আজ আমাকে দিচ্ছে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি। মার্কিন মদতে ইজরায়েল, এই দু’বছরে গণহত্যা-খাদ্য-জল-ওষুধ সহ অবরোধের যে বর্বর নজির সৃষ্টি করেছে তাতে বিশ্ব হৃদয় ঘৃণায় শিউরে উঠেছে-ক্রোধে কেঁপে উঠেছে। তাই জাতিসঙ্ঘ থেকে শুরু করে বিশ্বের শুভ শক্তিগুলি ত্রাণ পৌঁছে দিতে অবিরাম চেষ্টা করেছে। কখনও পেরেছে, কখনও পারেনি। আমি তাদের সকলের কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমি বিস্ময়ে হতবাক আমার চিরকালের বন্ধু ভারতের গণহত্যাকারী ইজরায়েল ঘেঁষা ভূমিকায়।
একই সঙ্গে আমি গর্বিত ও ব্যথিত সবচেয়ে বড়, ঐতিহাসিক নৌবহর, ৪২টি নৌকো আর ৫০০ মানুষের ত্রাণ অভিযানের ‘গ্লোবাল সুমুদ্ ফ্লোটিলার’ দৃঢ়তা ও দুঃসাহসে। আগস্টের শেষ থেকে ২০ অক্টোবর পর্যন্ত ইউরোপের বিভিন্ন বন্দর থেকে এসে চূড়ান্ত যাত্রা শুরু করে নৌবহর ক্রিটদ্বীপ থেকে সেপ্টেম্বর শেষে যতক্ষণ না ইজরায়েল আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধ, মানবিক সাহায্যের জেনেভা সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে একে একে ৪২টি নৌকো বন্দি, এমনকি জাহাজ ডুবিয়ে দেবার হুমকি না দেখায়, গাজা থেকে অল্প দূরত্বে। যখন ইজরায়েলী সেনা সুমুদকে আটকাতে গভীর সমুদ্রে নেমে পড়েছে, সারা বিশ্ব প্রতিবাদে উদ্বেল। ৪৬২ জন নিরস্ত্র যাত্রী হাত তুলে আত্মসমর্পণ করছে-কিন্তু ইজরায়েলী সেনার বন্দুকের নিশানা তারাই। প্রতিবাদে ইতালিতে শ্রমিক ইউনিয়নের ডাকে একদিনের সাধারণ ধর্মঘট যেমন, তেমনি তুরস্ক, দক্ষিণ আফ্রিকা, কলম্বিয়া, মালয়েশিয়া সহ দেশে দেশে এই বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের গর্জন আকাশ ছেয়েছে গাজাবাসী হয়েছে উৎসাহিত। ২০১৮ সালের ১৫ বছরের সেই সুইডেনের গ্রেটাথুন বার্গ, রিমাহাসানরা কি অপরিমেয় সাহসে বিধ্বস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে চেষ্টা করেছে পরিবেশ আন্দোলনের মুখ ‘ফ্রাই ডে ফর ফিউচার’ ধ্বনি দিয়ে মাঝ দরিয়ায় নেমেছে ন্যায়ের পক্ষে গ্রেটা। ওকে চুল ধরে টেনে ৫০০ বন্দির আবাসযোগ্য স্থানে নিয়ে, ইজরায়েলের পতাকা চুম্বনে বাধ্য করেছে— তবু ছোট্ট আমার সেই মেয়ে, আজ তারুণ্যের শক্তিতে জেদে সব নির্যাতন-অপমান, তুচ্ছ করে বিশ্ববাসীকে আহ্বান জানিয়েছে প্যালেস্তাইনের মুক্তি সংগ্রামের পাশে দাঁড়াতে, কারণ তাদের পাশে আছে সত্য, নৈতিকতা, ন্যায় বিচার, ভালোবাসা, বিশ্বের সংহতি ও মানবিকবোধ। ইতিহাসে সব থেকে অপমানজনক বন্দিত্বও এর কাছে ম্লান। ২৬০ সালে পারস্য সম্রাট শাপুর ১ম, রোমান সম্রাট ভ্যালেরিয়ানকে বন্দি করে এমন ব্যক্তিগত দাসে পরিণত করে যে ঘোড়ায় চাপার সময়ে রোমান সম্রাটের পিঠে পা দিয়ে সে উঠত। পরে তাকে হত্যা করে পশু-পাখির শব চামড়ায় ভরে রাখার মতো নিহত সম্রাটকে ঐ taxidermy করে পারস্যের রাজপ্রাসাদে ট্রফির মতো প্রদর্শনের জন্যে রেখে দেয়। কিন্তু ২২ বছরের তরুণী কোনও হুমকি কোনও নির্যাতন কোনও আইনের বেড়ি আটকে রাখতে পারেনি তো। কোনও দেশের জাতীয় পতাকার সম্মান করা, শিষ্টাচার কিন্তু জোর করে বাধ্য করা বর্বরতা, বিশেষ করে সেই রাষ্ট্র যখন অপরের নিজের ভূখণ্ড থেকে তাকে উচ্ছেদ করে। পরাক্রমশালী অত্যাচারী শাসক ট্যাক্সিডার্মি হয়েছে — আর গ্রেটার বিশ্বের কুর্নিশ আর হয়েছে অদম্য জেদ, স্পর্ধা আর স্বাধীন অস্তিত্বের প্রতীক।
আমি প্যালেস্তাইন, আমার পরিচয় আমার অপরাজিত স্বাধীন চিত্তে, তাই আমি অসম যুদ্ধ করে টিকে আছি। আমি যুদ্ধ চাই না। কারণ যুদ্ধে কেউ জেতে না। ঘরছাড়া আবদেলদের কষ্ট আমাকে ব্যথা দেয় - ইজরায়েলী বন্দিদের পরিজনের বেদনা আমারও ব্যথার কারণ। ওদের নীল-সাদা পতাকা জড়ানো মুক্তির আনন্দের হাসি মুখ-ঠিক প্যালেস্তাইনি আবদেলদের হাসি মুখের মতো আমাকে আনন্দ দেয়। কিন্তু তবু আমি যুদ্ধ করি। আমার জলপাই বাগিচায় পাতা ঝরে, আবার নতুন পাতা গজায়। আমার সন্তান মরে আর এক সন্তান সেই স্বাধীনতার পতাকা মুঠো করে ধরে তোলে। আমি মনে রাখি মহান নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার বাণী — ‘‘দি গ্রেটেস্ট গ্লোরি ইন লিডিং লাইজ্ নট ইন নেভার ফলিং, বাট ইন রাইজিং এভরি টাইম উই ফল।’’ আমি পরাভুত হই, পরাজিত নই তবু।
বিশ্ব মানবতার-বিশ্ব শান্তির কারণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রক্তকরবী নাটকের শতবর্ষ। নাম করণের প্রসঙ্গে বলেছেন — ‘‘আমার ঘরের কাছে একটি লোহালক্কর জাতীয় স্তূপ ছিল, তার নিচে একটা ছোট্ট করবী গাছ চাপা পড়েছিল। ... পরে লোহাগুলি সরিয়ে আর চারাটুকুর সন্ধান পাওয়া গেল না। কিছুকাল পরে হঠাৎ একদিন ওই লোহার জালজঞ্জাল ভেদ করে একটি সুকুমার করবী শাখা উঠেছে। একটি লাল ফুল বুকে করে। ... সে বললে, ‘ভাই মরিনি তো, আমাকে মারতে পারলে কই?’ ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন সংঘর্ষের শতবর্ষ হতে সিকি পথ বাকি। আমরা আক্রান্ত, রক্তাক্ত তবু আমরা রণাঙ্গনে, শান্তির প্রতীক জলপাই পাতা ছুঁয়ে ছুঁয়ে। আমাদের পবিত্র ভূমি দখল হয় - আমরা হই অবরুদ্ধ। ইয়াসের আরাফতের প্যালেস্তাইন বারে বারে ঠেলে, বন্ধু দরজা খোলার লক্ষ্যে। রঞ্জন-নন্দিনীর প্রাণ প্রাচুর্যে ভরা ঐ তাজা রক্তকরবীর মতো আমি আপসহীন প্যালেস্তাইন বলছি বিশ্বশান্তির শত্রুদের— ‘‘আমাকে মারতে পারলে কই?’’
Highlight : আমি প্যালেস্তাইন, আমার পরিচয় আমার অপরাজিত স্বাধীন চিত্তে, তাই আমি অসম যুদ্ধ করে টিকে আছি। আমি যুদ্ধ চাই না। কারণ যুদ্ধে কেউ জেতে না। ঘরছাড়া আবদেলদের কষ্ট আমাকে ব্যথা দেয় - ইজরায়েলী বন্দিদের পরিজনের বেদনা আমারও ব্যথার কারণ। ওদের নীল-সাদা পতাকা জড়ানো মুক্তির আনন্দের হাসি মুখ-ঠিক প্যালেস্তাইনি আবদেলদের হাসি মুখের মতো আমাকে আনন্দ দেয়। কিন্তু তবু আমি যুদ্ধ করি। আমার জলপাই বাগিচায় পাতা ঝরে, আবার নতুন পাতা গজায়। আমার সন্তান মরে আর এক সন্তান সেই স্বাধীনতার পতাকা মুঠো করে ধরে তোলে।
Comments :0