সু ওয়েই
এক মাস আগে, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ২০ তম কেন্দ্রীয় কমিটির চতুর্থ পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন বেজিঙে সফলভাবে অনুষ্ঠিত হয়। এই অধিবেশনে ১৫তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রস্তাবটি অনুমোদিত হয়েছে, যা কেবল আগামী পাঁচ বছরের জন্য চীনের পথনির্দেশই করবে না, বরং বিশ্বের জন্য ব্যাপক উন্নয়নের সুযোগকেও উন্মোচিত করবে।
নতুন দিগন্তে জাগরিত দুটি প্রাচীন সভ্যতা হিসাবে, চীন ও ভারত কেবল পাহাড়ের দু’পারের প্রতিবেশীই নয়, বরং ভবিষ্যৎকে রূপ দেওয়ার অংশীদার। উভয় দেশই এখন জাতীয় উন্নয়ন ও পুনরুজ্জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে রয়েছে। বর্তমানে, চীন ‘চীনা আধুনিকায়ন’-এর মাধ্যমে সর্বক্ষেত্রে জাতির মহান পুনরুজ্জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে ভারত তার ‘বিকশিত ভারত ২০৪৭’ লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে চায়। বলা যায়, উন্নয়ন হলো উভয় দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাধারণ ভিত্তি এবং অগ্রাধিকার।
১৪তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার (২০২১–২০২৫) সময়ে চীন এক ঐতিহাসিক মাইলফলক অর্জন করেছে। এর অর্থনীতি বার্ষিক গড়ে ৫.৫শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এই বছর সেটা RMB ১৪০ ট্রিলিয়ন (গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সরকারি মুদ্রা) অর্থাৎ প্রায় ২০ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। মাথাপিছু জিডিপি টানা দুই বছর ধরে ১৩,০০০ মার্কিন ডলারের উপরে রয়েছে, যা চীনকে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানীয় অবস্থানে এনেছে। বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে জোরদার হয়েছে, এবং বর্তমানে চীন বিশ্ব উদ্ভাবন সূচকে (Global Innovation Index) শীর্ষ দশের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। সবুজায়নেও (green development) অসাধারণ অগ্রগতি হয়েছে। উল্লেখ্য, মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার প্রায় ৬০ শতাংশ এখন অ-প্রচলিত শক্তি (Renewable Energy) থেকে আসে এবং এর ফলে বায়ু, জল ও মাটির গুণমান ক্রমাগত উন্নত হচ্ছে। ভারত সহ ১৫৭টি দেশ ও অঞ্চলের সাথে চীন বর্তমানে শীর্ষ তিন বাণিজ্য অংশীদারের অন্যতম। বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে প্রায় ৩০ শতাংশ অবদান রেখে চীন বিশ্বের অর্থনীতিতে একটি নোঙর এবং ইঞ্জিন হিসাবে কাজ করে চলেছে।
চীনের সাফল্যের মূল কারণ হলো, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীভূত এবং ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্ব এবং যতক্ষণ না পরিকল্পনাগুলি বাস্তবায়িত হচ্ছে, ততক্ষণ পরিকল্পনাগুলির ওপর নজরদারি রাখার নীতিতে তাদের অবিচল থাকা। এছাড়াও বৈজ্ঞানিকভাবে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং ধারাবাহিকভাবে তা বাস্তবায়ন করাও সাফল্যের অন্যতম কারণ। রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং যেমন উল্লেখ করেছেন, "১ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা থেকে ১৪তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা পর্যন্ত, ধারাবাহিক লক্ষ্য ছিল, চীনকে একটি আধুনিক সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসাবে গড়ে তোলা।" এই প্রক্রিয়া জুড়ে, চীন একটি কার্যকরী বাজারের সাথে একটি সু-পরিচালিত সরকারের সমন্বয় ঘটিয়েছে, উচ্চ-পর্যায়ের পরিকল্পনা গ্রহণের (top-level design) সাথে জনসাধারণের মতামতের সংমিশ্রণ করেছে, নীতির স্থিতিশীলতা ও ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে এবং একটি উন্নত জীবনের জন্য জনগণের ক্রমবর্ধমান আকাঙ্ক্ষার সাথে তাল মিলিয়ে চলেছে।
১৫তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রস্তাবে বলা হয়েছে চীন উচ্চ মানের উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য নিজেদের আরও বেশি উন্মুক্ত করার কাজকে উৎসাহিত করে যাবে, যা বিশ্বব্যাপী দেশগুলোর জন্য অনুমানযোগ্য এবং স্থিতিশীল সহযোগিতার সুযোগ এনে দেবে। সম-উন্নয়নশীল অর্থনীতি এবং প্রধান উন্নয়নশীল জাতি হিসাবে, চীন ও ভারতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতার ব্যাপক সম্ভাবনা ও বিশাল সুযোগ রয়েছে। এর ফলে বিশ্বজুড়ে অন্যান্য দেশগুলোর জন্যও অনুমানযোগ্য ও স্থিতিশীল সহযোগিতার সুযোগ (predictable and stable cooperation opportunities) তৈরি হবে। যেহেতু চীন ও ভারত উভয়েই উদীয়মান অর্থনীতি এবং গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়নশীল দেশ, তাই বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতার ব্যাপক সম্ভাবনা এবং বিশাল সুযোগ রয়েছে।
প্রথমত, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সহযোগিতা একটি দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। চীন ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদার। ২০২৪ সালে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ১৩৮.৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। এই বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত, বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১২৭.৬৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা গত বছরের তুলনায় ১১ শতাংশ বৃদ্ধি। ভারত থেকে চীনে রপ্তানি— যেমন লঙ্কা, চাল, চিংড়ি মাছ, আকরিক লোহা এবং সুতির সুতো ইত্যাদি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। আমরা ভারতীয় ব্যবসায়ী বন্ধুদের ক্যান্টন ফেয়ার, চায়না ইন্টারন্যাশনাল ইম্পোর্ট এক্সপো, চায়না ইন্টারন্যাশনাল ফেয়ার ফর ট্রেড ইন সার্ভিসেস এবং চায়না ইন্টারন্যাশনাল কনজিউমার প্রোডাক্টস ফেয়ার-এর মতো মঞ্চগুলোকে সম্পূর্ণভাবে ব্যবহার করে উভয় দেশের উপভোক্তাদের জন্য আরও উচ্চ মানের পণ্য ও পরিষেবার আদান-প্রদানকে স্বাগত জানাই।
দ্বিতীয়ত, শিল্পগত সহযোগিতা পরিপূরক শক্তির দ্বারা সংজ্ঞায়িত। বিশ্বের বৃহত্তম উৎপাদন অর্থনীতির দেশ চীনের ইলেকট্রনিক্স, অবকাঠামো (Infrastructure), নতুন জ্বালানি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারে সবচেয়ে সম্পূর্ণ শিল্প ব্যবস্থা এবং শক্তিশালী সক্ষমতা রয়েছে, যা গর্ব করার মতো। অন্যদিকে ভারত তথ্য প্রযুক্তি, সফটওয়্যা র উন্নয়ন এবং বায়োফার্মাসিউটিক্যালসে উন্নত। নতুন প্রযুক্তির বিপ্লব এবং শিল্প রূপান্তরের পটভূমিতে, চীন ও ভারতের মধ্যে সমন্বয় পারস্পরিক সুবিধা এনে দেবে এবং বিশ্বের শিল্প, মূল্য ও সরবরাহ শৃঙ্খলে উভয় দেশের অবস্থানকে উন্নত করবে।
তৃতীয়ত, উভয় দেশের জনগণের মধ্যে আদান-প্রদান সমৃদ্ধ ফল এনেছে। জনগণের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগে প্রোথিত বন্ধুত্বই হলো সু-সম্পর্কের চাবিকাঠি। চীন ও ভারতের মধ্যে হাজার হাজার বছরের বন্ধুত্বপূর্ণ আদান-প্রদানের ইতিহাস রয়েছে, যা একে অপরের উন্নয়ন এবং বিশ্ব সভ্যতাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। ভারতের বৈচিত্রময় সংস্কৃতি চীনের জনগণের কাছে গভীরভাবে আকর্ষণীয়। সেখানে যোগ, বলিউড সিনেমা এবং দার্জিলিঙ চা দারুণ জনপ্রিয়। এই বছর, চীন তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের পবিত্র পর্বত ও পবিত্র হ্রদে ভারতীয়দের জন্য তীর্থযাত্রা পুনরায় শুরু করেছে এবং ভারতও চীনের নাগরিকদের জন্য পর্যটন ভিসা প্রদান আবার শুরু করেছে। সম্প্রতি, উভয় দেশের মধ্যে বেশ কয়েকটি সরাসরি ফ্লাইট চালু হয়েছে, যা সামগ্রিক আদান-প্রদানকে আরও সুবিধাজনক করেছে। আমরা পর্যটক, শিল্পী, পণ্ডিত এবং তরুণদের আরও বেশি করে দ্বিপাক্ষিক সফর প্রত্যাশা করি, যা চীন-ভারত বন্ধুত্বের জন্য জনগণের সমর্থনের ভিত্তিকে আরও জোরদার করবে।
চতুর্থত, বহুপাক্ষিক সহযোগিতা আমাদের বৃহত্তর সাধারণ স্বার্থকে পূরণ করে। আজকের অস্থির বিশ্বে প্রকৃত অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন প্রতিকূলতার সম্মুখীন হচ্ছে। ব্রিকস (BRICS), এসসিও (SCO) এবং জি২০ (G20)-এর মতো বহুপাক্ষিক ব্যবস্থাগুলির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসাবে, আমাদের দুই দেশেরই উচিত, প্রধান আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিষয়গুলোতে যোগাযোগ ও সমন্বয় বৃদ্ধি করা। জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্য নিরাপত্তা এবং জনস্বাস্থ্যের মতো চ্যালেঞ্জগুলিকে যৌথভাবে মোকাবিলা করা, এবং মানব সভ্যতার অগ্রগতির জন্য একটি অভিন্ন ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষ্যে একটি সমতা ভিত্তিক ও সুশৃঙ্খল বহুমেরুর বিশ্ব এবং একটি সর্বজনীনভাবে উপকারী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের জন্য একসাথে কাজ করা।
একশো বছর আগে, যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম চীনে পদার্পণ করেন, তিনি বলেছিলেন, "আমি জানি না কেন চীনে আসা আমার কাছে যেন আমার জন্মভূমিতে ফিরে আসার মতো মনে হয়। আমি সর্বদা অনুভব করি যে ভারত চীনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের মধ্যে একজন এবং চীন ও ভারত দীর্ঘকাল ধরে এক স্নেহময় ভ্রাতৃত্ব উপভোগ করছে।" এই বছর চীন ও ভারতের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ৭৫তম বার্ষিকী। গত ৭৫ বছর ধরে, বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতা সবসময়ই আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মূল ধারা বজায় রেখেছে।
যখন ড্রাগন এবং হাতি একই তালে পা ফেলে, তখন তাদের নৃত্য কেবল এশিয়ার জন্যই স্থিতিশীলতা এবং অগ্রগতি নিয়ে আসে না, বরং আমাদের এই বিভক্ত বিশ্বের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করবে। আমাদের নেতাদের কৌশলগত পরিকল্পনায়, চীন-ভারত সম্পর্ক ক্রমাগত উন্নত ও বিকশিত হয়েছে। কলকাতাস্থিত চীনের কনস্যুলেট জেনারেল, পূর্ব ভারতের সর্বস্তরের বন্ধুদের সাথে কাজ করতে প্রস্তুত, যাতে চীনের উন্নয়নে নতুন সুযোগগুলো কাজে লাগানো যায়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে গভীরতর আদান-প্রদান ও সহযোগিতাকে উৎসাহিত করা যায় এবং উভয় দেশ ও জনগণের উপকারের জন্য ড্রাগন–হাতির যুগল ছন্দবদ্ধ নৃত্যের একটি নতুন অধ্যায় লেখা যায়।
(লেখক কলকাতায় অবস্থিত চীনের কনস্যুলেট জেনারেল।)
Comments :0